স্টাফ রিপোর্টার ॥ সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর মামলার রায়ের খসড়া ফাঁসের মামলায় বেকসুর খালাস পেয়েছেন তার স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরী ও ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী। অন্যদিকে তাদের আইনজীবীসহ পাঁচজনকে বিভিন্ন দ- দিয়েছেন আদালত। এর মধ্যে ট্রাইব্যুনালে সাকা চৌধুরীর আইনজীবী ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলামকে দশ বছরের কারাদ-, সেই সঙ্গে এক কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ওই অর্থ দিতে ব্যর্থ হলে তাকে আরও ছয় মাসের সাজা ভোগ করতে হবে। আর সাকা চৌধুরীর ম্যানেজার মাহবুবুল আহসান, ফখরুলের সহকারী মেহেদী হাসান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কর্মচারী নয়ন আলী ও ফারুক হোসেনকে দেয়া হয়েছে সাত বছরের কারাদ-। পাশাপাশি তাদের প্রত্যেককে দশ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। তা না দিলে আরও এক মাস জেলে কাটাতে হবে তাদের। দুই দফা পেছানোর পর বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক কে এম শামসুল আলম আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।
রায় ঘোষণার সময় জামিনে থাকা সাকা পতœী ফারহাত কাদের চৌধুরী রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত হন। আর তার ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরীকে পলাতক দেখিয়েই আদালত রায় ঘোষণা করে, যদিও পরিবারের দাবি, তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গত আগস্টের শুরুতে তুলে নিয়ে গেছে। ফারহাত ও হুম্মামের আইনজীবী এ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেও বাকি আসামিদের আইনজীবীরা আপীল করার কথা বলেছেন। অন্যদিকে পূর্ণাঙ্গ রায় দেখে তারপর আপীলের সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা বলেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী।
রায় ঘোষণার পর ফারহাত ও হুম্মামের আইনজীবী আমিনুল গণী টিটো তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এ মামলায় যে অভিযোগ, তার সঙ্গে ফারহাত বা হুম্মাম জড়িত ছিলেন না। রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। যে শুনানি হয়েছে, তাতে খালাস পাওয়ারই কথা। অন্যদিকে আসামি ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম, নয়ন আলী ও ফারুক হোসেনের আইনজীবী এম এ বি এম খায়রুল ইসলাম লিটন জানিয়েছেন, আমরা সংক্ষুব্ধ, এ রকম রায় হওয়া উচিত হয়নি। আমরা উচ্চ আদালতে যাব। রাষ্ট্রপক্ষের বিশেষ কৌঁসুলি নজরুল ইসলাম শামীম জানিয়েছেন, ‘এখনই কোন মন্তব্য করতে চাই না। রায়ের পুরো কপি এখনও পাইনি। কপি হাতে পাওয়ার পর তা পর্যবেক্ষণ করে আপীলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।’
সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে মৃত্যুদ- বহাল থাকায় গত বছর নবেম্বরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ মামলার রায় হয়েছিল ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর। ওই রায়ের দিন সকালেই তার স্ত্রী, পরিবারের সদস্য ও আইনজীবীরা রায় ফাঁসের অভিযোগ তোলেন। তারা রায়ের ‘খসড়া কপি’ও সংবাদকর্মীদেরও দেখান। তারা আদালতের রায় নিয়ে কটাক্ষও করেন। রায় ঘোষণার পরদিন ট্রাইব্যুনালের তৎকালীন রেজিস্টার এ কে এম নাসির উদ্দিন মাহমুদ বাদী হয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে শাহবাগ থানায় একটি জিডি করেন। পরে ৪ অক্টোবর ডিবি পুলিশের পরিদর্শক ফজলুর রহমান শাহবাগ থানায় মামলা করেন।
এর আগে তৎকালীন রেজিস্টার একেএম নাসির উদ্দিন মাহমুদ ২০১৩ সালের ২ অক্টোবর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর বিরুদ্ধে রায়ের খসড়া কপির অংশ বিশেষ কোন না কোনভাবে ‘লিকড’ (ফাঁস) হতে পারে। তিনি বলেন, একটি সংঘবদ্ধ দুষ্ট চক্র যারা ট্রাইব্যুনাল ও এর বিচারিক কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায় এবং যারা এই অপকর্মের সুবিধাভোগী তারাই এটি করেছে বলে ট্রাইব্যুনাল মনে করে। আশা করছি সত্য বেরিয়ে আসবে। অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রাজধানীর শাহবাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। যারা এর সঙ্গে জড়িত, তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।
একে এম নাসিরউদ্দিন মাহমুদ তখন বলেছিলেন, চূড়ান্ত রায় প্রকাশের আগে সেটা ট্রাইব্যুনালের কম্পিউটারে খসড়া আকারে প্রস্তুত করা হয়। চূড়ান্ত রায়ের সঙ্গে কথিত ফাঁস হওয়া রায়ের অনেক জায়গাতেই মিল নেই। যেমনÑ মূল রায়ে অনুচ্ছেদ নম্বর থাকে। কিন্তু কথিত ফাঁস হওয়া রায়ে অনুচ্ছেদ নম্বর নেই। তিনি আরও বলেন, আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি যে, যথারীতি রায় ঘোষণার পর অভিযুক্ত সাজাপ্রাপ্ত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে নিয়োজিত আইনজীবী এবং অভিযুক্তের স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের মিডিয়াকে দেয়া বক্তব্য থেকে জানা যায যে, রায় আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণার পূর্বে তা ইন্টারনেটে কিছু ওয়েবসাইটে পাওয়া গেছে। তারা এটিও দাবি করেছেন যে, কথিত রায় আইন মন্ত্রণালয়ের কম্পিউটারে সংরক্ষিত আছে। প্রসিকিউটর এবং অভিযুক্ত পক্ষের নিযুক্ত আইনজীবীগণ কোর্টের অফিসার। রায় ঘোষণার জন্য ট্রাইব্যুনাল আসন গ্রহণের পর অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবীর দায়িত্ব ছিল কোন কোন ওয়েবসাইটে কথিত খসড়া রায় আগের দিন রাতে আপ-লোডেড পাওয়া গেছে। সেই বিষয়টি ট্রাইব্যুনালের নজরে আনা। কিন্তু তিনি তা না করে আনুষ্ঠনিক রায় ঘোষণার পর কথিত খসড়ার হার্ডকপি দেখিয়ে মিডিয়ার সামনে এটি দাবি করেন যে, রায় আগেই লিকড হয়েছে। এটি আইন মন্ত্রণালয়ের কম্পিউটারে আছে। এবং এটি একটি ডিকটেটেড রায়।
জিডিতে বলা হয়, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে প্রচারিত সমস্ত রায় ট্রাইব্যুনালেই প্রস্তুত করা হয়। রায় ঘোষণার আগে রায়ের কোন অংশের কপি অন্য কোনভাবে প্রকাশের সুযোগ নেই। কিন্তু তারপরও কথিত খসড়া রায়ের অংশ কীভাবে ইন্টারনেটে প্রচারিত হলো বা কীভাবে ট্রাইব্যুনাল থেকে খসড়া রায়ের অংশবিশেষ ফাঁস হলো তা উদ্বেগের বিষয়। জিডিতে বলা হয়, কথিত খসড়া রায়ের অংশবিশেষ িি.িঃৎরনঁহধষষবধশং.নব নামের একটি ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয়েছে। ওই ওয়েবসাইটে প্রকাশিত কথিত রায় ১৬৫ পৃষ্ঠার। আর ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায়টি ১৭২ পৃষ্ঠার। কথিত রায়ে দোষী সাব্যস্ত করা বা দ-ের বিষয়ে কোন কথা উল্লেখ করা হয়নি। মূল রায়ে অভিযোগ ধরে ধরে প্রমাণ, দোষী সাব্যস্তকরণ ও দ-ের উল্লেখ রয়েছে।
রায়ের প্রথম অংশে বিচারকের নাম, প্রসিকিউটরদের নাম, আসামিপক্ষের আইনজীবীদের নাম, ভূমিকা, কার্যবিবরণী, ঐতিহাসিক পটভূমি, ১৯৭৩ সালের ট্রাইব্যুনাল আইনের নানা বিষয়ের সংজ্ঞা, বিভিন্ন বিদেশী আইনের প্রসঙ্গ, ত্রিপক্ষীয় চুক্তি এবং ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীর ক্ষমা, এই বিচার বিলম্বিত হওয়ার কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। কথিত রায়ে এসব থাকলেও হুবহু মিল নেই। রায়ে আদালতে সাকার ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের কথা উঠে এলেও ফাঁস হওয়া রায়ে তা এসেছে আংশিকভাবে।