ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রাষ্ট্রনায়কদের অশালীন ভাষা

প্রকাশিত: ০৩:৩৪, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬

রাষ্ট্রনায়কদের অশালীন ভাষা

ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট রডরিগো দুতার্তে সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে ‘গণিকার সন্তান’ আখ্যায়িত করেছেন। এ নিয়ে ফিলিপিন্স ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়েছে এবং কূটনৈতিক মহলের লোকজন দুচোখ কপালে তুলেছেন। তবে দুতার্তের এমন শিষ্টাচারবহির্ভূত অশোভন উক্তি বা মন্তব্য উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক বাক্যালাপের ক্ষেত্রে একেবারে নতুন কিছু নয়। গ্রীকদের হাতে গণতন্ত্রের উন্মেষ ঘটার পর থেকে রাজনীতিকরা অপর রাজনীতিক, জাতীয় নেতৃবৃন্দ, জননেতা ও তাদের দেশের বিরুদ্ধে অপমানজনক, কুৎসিত, অশোভন মন্তব্য এবং হালকা ও চটুল উক্তি করে আসছেন। শেক্সপিয়ারের ‘চতুর্থ হেনরি’ নাটকের প্রথম পর্বে ফলস্টাফ মাতাল হয়ে ইংল্যান্ডের ভাবী রাজা তরুণ প্রিন্স অব ওয়েলসকে বলেছেন ‘ষাঁড়ের পুরুষাঙ্গ’। হেনরিও তাঁকে পাল্টা গালি দিয়ে বলে উঠেছেন বেজন্মা পুরুষ। ছয় শ’ বছর পর দুতার্তের অশালীন উক্তি থেকে তা খুব একটা ভিন্ন কিছু ছিল না। আমেরিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে ওবামা নানা ধরনের গালিগালাজ শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। তাঁকে ভেতরে ভেতরে মুসলমান, ব্ল্যাক প্যান্থার, ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর মিথ্যা কাহিনী রটনাকারী, মাদকের টাকায় নিজের নির্বাচনী প্রচার চালানো ইত্যাকার হাজারও অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। একটি অপপ্রচারমূলক টিশার্টে ওবামার ছবি ছাপিয়ে লেখা ছিল : ‘কেনিয়ার কোন এক জায়গার এক গ্রামের আহাম্মকটিকে পাওয়া যাচ্ছে না।’ তবে ওবামাও যে একেবারে ছেড়ে কথা বলেছেন তা কিন্তু নয়। ২০০৮ সালে তিনি তাঁর তৎকালীন ডেমোক্র্যাট প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি ক্লিনটনকে ‘ওয়ালমার্টের বোর্ডে বসে থাকা বাস্তবতাবিবর্জিত কর্পোরেট আইনজীবী’ বলেছিলেন। এ বছর তিনি তাঁর সুর পাল্টে মহাউৎসাহে হিলারি ক্লিনটনের প্রার্থিতার পক্ষে দাঁড়ান। এ বছরের নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্পর্কেও ওবামা কঠোর নিন্দাসূচক উক্তি করেছেন। গত মাসে তিনি বলেছেন : ‘আমি মনে করি উনি (ট্রাম্প) প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনে অনুপযুক্ত। গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো সম্পর্কে তার মৌলিক কোন ধারণা নেই। এই দায়িত্ব পালনে তাঁর প্রস্তুতির শোচনীয় রকমের অভাব আছে।’ প্রার্থীর যোগ্যতা সম্পর্কে এমন প্রশ্ন তোলার মধ্যে সিনিয়র জর্জ বুশের কৌশলই প্রতিধ্বনিত হয়। ১৯৯২ সালে প্রেসিডেন্ট থাকাকালে বুশ তাঁর ডেমোক্র্যাট প্রতিদ্বন্দ্বী বিল ক্লিনটন ও আল গোরকে ‘ঐ দুই আহাম্মক’ আখ্যায়িত করেছিলেন। কিছু কিছু মার্কিন ভাষ্যকারের মতে, হিলারি ক্লিনটনকে ট্রাম্প যেরূপ অমার্জিত ও স্বভাবগত মিথ্যাবাদী বলেছেন এবং আরও অনেক ব্যক্তিগত অপমান ছুড়ে দিয়েছেন তাতে ২০১৬ সালের নির্বাচনী প্রচারণার ধরন-ধারণ নজিরবিহীন নিম্নস্তরে নেমে এসেছে। শীর্ষস্থানীয় ব্রিটিশ ও ইউরোপীয় রাজনীতিকরাও পরিস্থিতি চাইলে যে নীচুতে নেমে আসতে পারেন না, তা নয়। ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া মিতেরাঁ মার্গারেট থ্যাচার সম্পর্কে একদা উক্তি করেছিলেন যে, তার মুখটা মেরিলিন মুনরোর এবং চোখজোড়া ক্যালিগুলার। উক্তিটা বহু আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। মিতেরাঁর উত্তরসূরি নিকোলাস সারকোজি ২০০৯ সালে এক লাঞ্চ পার্টির ডেজার্ট চলাকালে একসঙ্গে তিন গুরুত্বপূর্ণ মিত্রকে অপমান করে বসেন। বলেন, ‘সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা দক্ষতার দিক দিয়ে ওবামা সর্বদা আশানুরূপ মানের নন, স্পেনের জোস লুই রোডরিগুয়েজ জাপাটেরো সম্ভবত তেমন বুদ্ধিমান নন এবং জার্মানির এ্যাঞ্জেলা মের্কেলের বিশ্ব অর্থনৈতিক সঙ্কট সম্পর্কে উপলব্ধির অভাব আছে।’ বিদেশী নেতাদের নিয়ে বাজে বা অশোভন কথা বলা পরে লন্ডনের সাবেক মেয়র ও বর্তমান ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব বরিস জনসনের একটা বিশেষত্ব হয়ে দাঁড়ায়। একবার তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানকে ইঙ্গিত করে তিনি একটা লিমেরিক লিখেছিলেন- সেখানে বলা হয়েছিল যে, তিনি ছাগলের সঙ্গে যৌনক্রিয়া উপভোগ করে থাকেন। এ নিয়ে তুরস্কে সবিশেষ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ও হাস্যরস দুটোরই জন্ম হয়েছিল। ইতিহাসগতভাবে জাতীয় দ্বন্দ্ব বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকেও অনেক সময় একটা জাতি সম্পর্কে অশোভন বা বাজে মন্তব্য করা হয়ে থাকে। ফরাসী নেতা নেপোলিয়ন অবজ্ঞা ও ঘৃণার সঙ্গে ইংরেজদের ‘দোকানিদের জাত’ আখ্যায়িত করেছিলেন। অন্যদিকে সাবেক প্রেসিডেন্ট জ্যাক শিরাক ব্রিটিশদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে মন্তব্য করেছিলেন : ‘এমন বিচ্ছিরি যাদের রান্না তাদের বিশ্বাস করা যায় না। ইউরোপের কৃষির জন্য একমাত্র যে কাজটা তারা করেছে তাহলো ম্যাড কাউ রোগ।’ হাঙ্গেরীয় ভাষ্যকার জর্জ মাইকস আরও এককাঠি সরস মন্তব্য করেছেন ইংরেজদের সম্পর্কে। বলেছেন, ‘কন্টিনেন্টাল মানুষদের সেক্স-লাইফ আছে আর ইংরেজদের আছে হট ওয়াটার বোতল।’ দুতার্তের মতো সেসব রাজনীতিক তাদের আচরণ বা নীতির জন্য অন্যান্য রাজনীতিকের সমালোচনার পাত্র হন তারা, অনেক সময় বিষয়গুলোকে ব্যক্তিগতভাবে নেন। সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জন মেজর টোরিদের মধ্যে যারা ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিয়ে সন্দেহগ্রস্ত তাদের বেজন্মা আখ্যা দিয়েছিলেন। আর থ্যাচার তাঁর মন্ত্রিসভার যেসব সদস্যের সমালোচনা করার বাতিক ছিল তাদের ‘বিছানা ভাসানো অভ্যাসের লোক’ বলে উড়িয়ে দিতেন। এ জাতীয় শিষ্টাচারবহির্ভূত উক্তির ক্ষেত্রে যৌনতাকে প্রায়শই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কমন্স সভায় উইনস্টন চার্চিলের বিরুদ্ধে মাতলামির অভিযোগ আনা হলে যিনি অভিযোগটি করেছিলেন সেই এমপি বেসি ব্রাডককে চার্চিল নাকি বলেছিলেন : ‘মহাশয় আপনি কুৎসিত স্বভাবের এবং আরও বড় কথা এমনই কুৎসিত স্বভাবের যে ভাবতেও ঘেন্না লাগে। কিন্তু কাল আমি মাতলামি করব না, থাকব শান্ত সংযত। অথচ তখনও আপনি ভয়ানক কুৎসিত স্বভাবের থাকবেন।’ বহু বছর পর ক্লিমেন্ট ফ্রয়েড মার্গারেট থ্যাচারকে বিদ্রƒপভরে আখ্যা দিয়েছিলেন ‘এটিলা দ্য হেন।’ কিছু কিছু রাজনীতিবিদ অবিবেচনাপ্রসূত অপমানজনক উক্তি করেছেন ভোটারদের সম্পর্কে যাদের সমর্থন তারা এত ব্যাকুলভাবে কামনা করে থাকেন। প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউনকে জনৈক বিগড়ে যাওয়া মহিলা ভোটার সম্পর্কে ‘গোড়া’ শব্দটা ব্যবহার করতে শোনা গিয়েছিল। এ নিয়ে হৈচৈ শুরু হলে তিনি সেই মহিলার কাছে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হন। প্রাক্তন ফরাসী প্রেসিডেন্ট সারকোজি ২০০৮ সালে এক বৈরী ভোটারের সঙ্গে কথা কাটাকাটি চলার সময় মাথা গরম করে ফেলেন। লোকটি করমর্দন করতে অস্বীকৃতি জানালে প্রেসিডেন্ট বলে ওঠেন : ‘ক্যাসি-টোই এলয়স, পভরে কন, ভা।’ অর্থাৎ ‘যা ভাগ ব্যাটা ফুটো কোথাকার, ভাগ এখান থেকে।’ তারপরও কেউ যদি মনে করেন যে রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়ি বা গালিগালাজ আধুনিক যুগের ব্যাপার তাহলে তাদের ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন আমেরিকান প্রেসিডেন্টের অভিজ্ঞতার কথা জানা উচিত যার বিবরণ শিকাগো ট্রিবিউনে দিয়েছেন জিওফ্রে স্টোন। প্রেসিডেন্টকে ক্ষিপ্ত কণ্ঠে মিথ্যাবাদী, স্বৈরাচারী, জবরদখলকারী, চোর, দানব, শপথভঙ্গকারী, নির্বোধ, জোচ্চর, অত্যাচারী, অজ্ঞ, কাপুরুষ, ভাঁড়, কসাই, জলদস্যু, জাতির বিশ্বাসঘাতক প্রভৃতি বিশেষণে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। কিন্তু তাতে সেই প্রেসিডেন্টের সুনাম এতটুকু ম্লান হয়নি। তাঁর নাম আব্রাহাম লিঙ্কন। সূত্র : গার্ডিয়ান
×