ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ বিদায় হজের ভাষণের তাৎপর্য

প্রকাশিত: ০৩:৩৪, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ বিদায় হজের ভাষণের তাৎপর্য

১০ হিজরীর ৯ জিলহজ শুক্রবার প্রিয়নবী নূরে মুজাস্্সম হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়াসাল্লাম আরাফাত ময়দানে প্রায় ১ লাখ চল্লিশ হাজার সাহাবায়ে কিরামের ঐতিহাসিক হজ সমাবেশে হজের যে খুত্বা দেন সে খুতবাই বিদায় হজের ভাষণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহর নির্দেশে হজের প্রবর্তন করেন মুসলিম জাতির জনক হযরত ইবরাহীম আলায়হিস সালাম। তিনি আল্লাহর নির্দেশে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী হযরত হাজরা ‘আলায়হাস সালাম এবং সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুপুত্র হযরত ইসমাঈল আলায়হিস্্ সালামকে ফিলিস্তিন থেকে বহু দূরে আরবের মক্কা উপত্যকায় এক বিরান ভূমিতে রেখে যান। সেই শিশু প্রায় ১১ বছর বয়সে উপনীত হলে আল্লাহ্্ হযরত ইবরাহীম ‘আলায়হিস সালামকে হযরত নূহ আলায়হিস্্ সালামের আমলে মহাপ্লাবনের তোড়ে বিলুপ্ত কাবা গৃহকে পুনর্নির্মাণের নির্দেশ দেন। হযরত ইবরাহীম (আ.) তার পুত্র ইসমাঈল ও স্ত্রী হাজরার সহযোগিতায় পাথর খ- গেঁথে গেঁথে সেই গৃহ নির্মাণ করলে আল্লাহ্্ এই গৃহ হজ করার ঘোষণা দিলেন। সেই তখন থেকে হজ পালন চালু হয়ে যায়। হজের মাস হিসেবে মাসেরও নাম হয় জিলহজ। কিন্তু কালে কালে এর তওহিদী বৈশিষ্ট্য হারিয়ে গিয়ে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস অনুপ্রবেশ করে, কল্পিত ৩৬০টি মূর্তি স্থাপন করে কাবা ঘর ও এর আশপাশে। হাজীদের পানি পান করানোর জন্য বিরাট পাথরের গামলা লাতও বিগ্রহ হয়ে যায়। মেয়ে-পুরুষ উলঙ্গ হয়ে নর্তন কুর্দন করত। মক্কার কুরায়েশ নেতারা আরাফাতে না গিয়ে মুযদালিফায় রাত্রি যাপন করত। এমনি তরো অসংখ্য কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস ছিল। সে ছিল ঘন অন্ধকার যুগ বা আইয়ামে জাহিলিয়াত। ৬১০ খ্রিস্টাব্দে কুরান নাযিল শুরু হয়। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়াসাল্লাম তওহীদের বাণী প্রচার করা শুরু করেন। কাফির মুশরিকরা এই সত্য প্রচার করা থেকে বিরত থাকার জন্য তাঁকে নানা ধরনের প্রলোভন দিতে থাকলে তিনি তাদের জানিয়ে দেন আমার ডান হাতে সূর্য এবং বাম হাতে চন্দ্র এনে দিলেও আমি আমার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেই যাব। ৬২২ খ্রিস্টাব্দে তিনি আল্লাহর নির্দেশে মক্কা থেকে ২৯৬ মাইল উত্তরে অবস্থিত মদিনায় হিজরত করেন। সেখানে মসজিদে নববী স্থাপিত হয়। এই মসজিদকে কেন্দ্র করে তিনি একটি আদর্শ কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করেন। এই রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য ইয়াহুদী, খ্রীস্টান এবং মদিনার মুহাজির ও আনসারদের সমন্বয়ে প্রণীত হয় একটি শাসনতন্ত্র যা পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র যা মদিনার সনদ নামে সমধিক পরিচিত। এই সনদকে চার্টার অব লিবারটিও বলা হয়। কিন্তু ইসলামের শত্রুরা জোটবদ্ধ হয়ে মদিনা আক্রমণ করতে থাকে। সব আক্রমণ প্রতিহত করতে যেয়ে অনেকগুলো যুদ্ধের মুকাবেলা করতে হয়। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দের রমাদান মাসে মক্কা জয় হয়। ৬৩১ খ্রিস্টাব্দে মদিনা থেকে ৭২০ কিলোমিটার দূরে রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াসের আক্রমণ প্রতিহত করতে তাবুক অভিযান পরিচালিত হয়। এই সময় হজ বিধান নাযিল হয়। মদিনা প্রত্যাবর্তন করে প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হিস সালাম হযরত আবুবকর সিদ্দীক রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহুর নেতৃত্বে তিন শত সাহাবায়ে কেরামের এক হজ কাফিলা মক্কা মুকাররমা প্রেরণ করলেন এবং হযরত আলী রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহুকে পাঠালেন মিনা প্রান্তরে সূরা তওবার কয়েকখানি আয়াতে কারিমা ঘোষণা করার জন্য যাতে চার মাসের সময় বেঁধে দিয়ে এই চার মাসের মধ্যে মুশরিকরা তওবা করে ইসলামে দাখিল হবে অথবা মক্কা থেকে চিরতরে চলে যাবে। ইরশাদ হয়েছে : ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, মুশরিকরা তো অপবিত্র, সুতরাং এই বছরের পর তারা যেন মসজিদুল হারামের নিকট না আসে। (সূরা তওবা : আয়াত ২৮) এর পরের বছর প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়াসাল্লাম হজ পালনের নিয়তে ২৫ জিলকদ মক্কা মুকাররমার উদ্দেশে রওনা হলেন। হাজার হাজার মুসলিম প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে হজ পালন করার জন্য সমবেত হলেন। ৫ জিলহজ তিনি মক্কায় এলেন, ৯ জিলহজ আরাফাত ময়দানে প্রায় ১ লাখ চল্লিশ হাজার হজ পালনরত সাহাবায়ে কেরামের বিশাল সমাবেশে তিনি হজের খুতবা প্রদান করলেন। তিনি তাঁর সেই ভাষণ মানবজাতিকে সম্বোধন করে উপস্থাপন করলেন। সেই ঐতিহাসিক দীর্ঘ ভাষণের শুরু করলেন হাম্দ ও নাত পেশ করার মাধ্যমে। তিনি বললেন : আইউহান নাস! হে মানুষ! আমার কথাগুলো মনোযোগ সহকারে শ্রবণ কর। এমনও হতে পারে যে, এই বছরের পরে এই স্থানে আমি তোমাদের সঙ্গে আর মিলিত হব না। আজ অন্ধকার যুগের সমস্ত কুসংস্কার অন্ধবিশ্বাস শিরক, কুফর আমার পদতলে দলিত-মথিত হলো। হে মানুষ! আজকের এই দিনটির মতো, এই মাসটির মতো, এই জনপদের মতো তোমাদের একের রক্ত, মান-ইজত, ধন-সম্পদ অন্যের নিকট অলঙ্ঘনীয় পবিত্র। তিনি বললেন : তোমরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি কর না। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কারণে তোমাদের পূর্ববর্তী অনেক জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। তোমাদের স্ত্রীদের তোমরা গ্রহণ কর আল্লাহকে সাক্ষী রেখে। তোমাদের তাদের ওপর যতটুকু অধিকার তাদেরও তোমাদের ওপর ততটুকু অধিকার। তিনি বললেন : কোন কর্তিতনাশা কাফ্রী গোলামও যদি তোমাদের আমির হয় আর যদি সে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করে তাহলে তোমরা অবশ্যই তার অনুগত থাকবে। তাঁর সেই দীর্ঘ ভাষণের একপর্যায়ে তিনি বললেন : কোন কালোর ওপর কোন সাদার শ্রেষ্ঠত্ব নেই, কোন সাদার ওপর কোন কালোর শ্রেষ্ঠত্ব নেই। সবাই আদম থেকে এবং আদম মাটি থেকে। শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হচ্ছে তাকওয়া। হে মানুষ! আমি তোমাদের জন্য রেখে যাচ্ছি আল্লাহর কিতাব আর তাঁর রসূলের সুন্নাহ। তোমরা যদি তা আঁকড়ে ধর তা হলে পথভ্রষ্ট হবে না। তিনি বললেন : আল্লাহ্ যদি আমার সম্পর্কে সাক্ষ্য গ্রহণ করেন তাহলে তোমরা কি সাক্ষ্য দেবে? সেই বিশাল জমায়েত থেকে ধ্বনিত হলো : হে আল্লাহর রসূল! আমরা সাক্ষ্য দেব আপনি আল্লাহর দেয়া সব দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হিস সালাম আবেগতাড়িত কণ্ঠে আসমানের দিকে শাহাদত অঙ্গুলী তুলে ধরে বললেন : হে আল্লাহ্ আপনি সাক্ষী থাকেন। এই বলে তিনি সবাইকে হাত তুলে ধরে বললেন, আল বিদা। এমন সময় ওহী নাযিল হলো : আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দীন পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত সম্পূর্ণ করলাম এবং দীন ইসলামকে সানন্দে অনুমোদন দান করলাম। এখানেই বিদায় হজের ভাষণের তাৎপর্য নিহিত রয়েছে। লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ উপদেষ্টা, ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা.) সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
×