ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

রাজশাহীর পুকুরে বিপুল সম্ভাবনা

বরেন্দ্রের মিঠা পানিতে গলদা চাষ অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা

প্রকাশিত: ০৬:৪৬, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৬

বরেন্দ্রের মিঠা পানিতে গলদা চাষ অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ গত কয়েক বছরে কার্প জাতীয় মাছ চাষে বিপ্লব ঘটেছে রাজশাহী অঞ্চলে। লাভজনক হওয়ায় এ খাতে প্রায় এক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে মাছ রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে সরবরাহ করা হচ্ছে রাজশাহীর মাছ। শুধু তাই নয়, রাজশাহীর মাছ দেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে রফতানির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি এবার রাজশাহীর বরেন্দ্রের পুকুরের মিঠা পানিতে বিপুল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে গলদা চিংড়ি চাষের। এরই মধ্যে এ অঞ্চলের পুকুরে গলদা চিংড়ির পরীক্ষামূলক চাষও শুরু হয়েছে। এতে সফল হলে পুকুরের চিংড়িতে যোগ হবে অর্থনীতির নতুন মাত্রা। এরইমধ্যে রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলের গোদাগাড়ি ও পবা উপজেলায় মিঠা পানিতে গলদা চিংড়ি চাষ শুরু হয়েছে। লাভের মুখও দেখেছেন তারা। মৎস্য বিভাগের সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে মিঠা পানিতে চিংড়ি চাষ আরও বাড়বে। খুলে যাবে এ অঞ্চলের মৎস্যচাষীদের ভাগ্য। রাজশাহীর দুই উপজেলায় সীমিত আকারে পরীক্ষামূলক গলদা চিংড়ির চাষে সফলতার আভাস মিলেছে। পুরো পুকুরে নেট দিয়ে ঘিরে সেখানে চাষ হচ্ছে গলদা চিংড়ির। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এই মাছ চাষে চাষী ও সরকার এগিয়ে আসলে এ অঞ্চলে ভাগ্য বদলাবে- এমনটাই আশা করছেন মৎস্য সংশ্লিষ্টরা। পুকুরের মিঠা পানিতে চিংড়ি চাষ সম্ভব কিনা এ নিয়ে চাষীরা প্রথমে দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকলেও পরীক্ষামূলক চাষের শুরুতেই সফলতার আভাস পাওয়া গেছে। কয়েক বছর আগেও এ অঞ্চলের মৎস্যচাষীরাও চিংড়ি চাষে লোকসানের ভয়ে নিরুৎসাহিত হয়েছেন। তবে গত বছর স্থানীয় মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তাদের উৎসাহে চিংড়ি চাষের প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রথমবারের মতো পবার কর্ণহারের শহিদুল ইসলাম ও হরিয়ানের আলী আকবর পরীক্ষামূলকভাবে পৃথক পুকুরে চিংড়ি চাষ শুরু করেন। সকল আশঙ্কা ও ভীতিকে পেছনে ফেলে এখন মিঠা পানির গলদা চিংড়ি আশার সঞ্চার করেছে তাদের। পবা উপজেলার কর্ণহারের চিংড়ি চাষী শহিদুল ইসলাম জানান, তিনি নাটোর থেকে পিএল (পোস্ট লার্ভি বা পোনা চিংড়ি) সংগ্রহ করেন। আগে থেকে চিংড়ি চাষে উপযোগী করে রাখা পুকুরে ওইসব পিএল ছেড়ে দেন। পিএলগুলো মাত্র ২০ থেকে ৪৫ দিনে সুষ্ঠুভাবেই বেড়ে উঠে কিশোর চিংড়িতে পরিণত হয়। তিনি সাধারণত এই কিশোর চিংড়িই বিক্রি করেন। হরিয়ানের আলী আকবর বলেন, তিনি শহিদুলের কাছে থেকে কিশোর চিংড়ি সংগ্রহ করে পুকুরে ছাড়েন। তিনি মিশ্র হিসেবে চাষ করেই ভাল লাভ পান। মাত্র ৫ থেকে ৭ মাসেই এসব চিংড়ি বাজারে বিক্রি করা যায়। তিনি বলেন, জেলায় এখন ২০ থেকে ২৫ জন চাষী চিংড়ি চাষ করছেন। তারাও চিংড়ি চাষে সফলতা পেয়েছেন। অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এ অঞ্চলে এখনও চিংড়ি চাষ ব্যাপকভাবে না হলেও ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে জানান তিনি। রাজশাহী জেলা মৎস্য কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলার ২০ জন মৎস্য চাষী এবার প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলক গলদা চিংড়ির চাষ শুরু করেছেন। এখনও লাভের দিকটা তেমন না হলেও পুকুরের চিংড়িতে সফলতার ঈঙ্গিত পাওয়া গেছে। গোদাগাড়ি ও পবা উপজেলার বরেন্দ্রভূমির পুকুরের মিঠা পানিতে গলদা চিংড়ি চাষ করে ব্যাপক সফলতার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে এরই মধ্যে। মৎস্য বিভাগ সূত্র জানায়, গলদা চিংড়ি চাষে বিশেষ কোন পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না। অন্যান্য কার্পজাতীয় মাছের সঙ্গেই চিংড়ি সহজে চাষ করা যায়। তবে আলাদা চাষ করলে তুলনামূলক ভাল ফল পাওয়া যায়। খাদ্যের ক্ষেত্রেও বিশেষ কোন পার্থক্য নেই। গলদা চিংড়ি পাঁচ-ছয় মাসের মধ্যেই পরিপক্ব হয়ে ওঠে। ছয় মাসের মধ্যে এদের ওজন ১২০ থেকে ১৪০ গ্রাম পর্যন্ত হয়। পুকুরে মাছের বৃদ্ধিও ভাল হয়। লাভও প্রচুর। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এই মাছ চাষে চাষী ও সরকার এগিয়ে আসলে এ অঞ্চলে ভাগ্য বদলাবে বলে মনে করছেন মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা। রাজশাহী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সুভাষ চন্দ্র সাহা জানান, বরেন্দ্র অঞ্চলসহ জেলায় পুকুরের মিঠা পানিতে গলদা চিংড়ির চাষ সম্ভব। কারণ গলদা চিংড়ি স্বাদু পানিতেই বেড়ে ওঠে। তবে বাজারজাতে এখনও অসুবিধা আছে। জেলায় এখনও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে তাজামাছ বাজার দখল করে আছে। নতুন কিছু স্থায়ী করতে কিছুটা সময় লাগবে। মৎস্যচাষীদের সহযোগিতা দেয়ার জন্য মৎস্য বিভাগের যথেষ্ট প্রস্তুতিও আছে। তিনি জানান চিংড়িচাষে চাষীদের উৎসাহী করতে পারলে দক্ষিণাঞ্চলের মতো বরেন্দ্র অঞ্চলও চিংড়ি চাষের উৎকৃষ্ট ক্ষেত্র হয়ে উঠবে। খুলে যাবে এ অঞ্চলের মৎস্যচাষীদের ভাগ্য। এদিকে রাজশাহীতে মাছ চাষে কয়েক বছরের ব্যবধানে ঘটেছে বিপ্লব। লাভজনক হওয়ায় এ খাতে প্রায় এক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। রাজশাহীর তাজামাছ এখন রাজধানীর বাজারেও সাড়া ফেলেছে। সম্প্রতি নেয়া হয়েছে আরও বড় উদ্যোগ। আন্তর্জাতিক বাজারে রফতানির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে রাজশাহীর মাছ। আশা করা হচ্ছে, এ বছরের শেষনাগাদ রাজশাহীর মাছ বিদেশের বাজারে স্থান করে নেবে। জেলা মৎস্য সম্পদ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী রাজশাহীতে বার্ষিক মাছের চাহিদা ৫৩ হাজার ৯৯৩ মেট্রিক টন। উৎপাদন হয় ৬৬ হাজার ৮২২ মেট্রিন টন। ফলে উদ্বৃত্ত থাকে ১২ হাজার ৮৮৯ মেট্রিক টন। মোট জলাশয়ের সংখ্যা ৪৮ হাজার ৪২৭টি। এর মধ্যে সরকারী পুকুর ও দীঘি আছে ৪ হাজার ৯১৫টি। এ ছাড়া আছে ৩৬ হাজার ৯৬১টি পুকুর ও দীঘি। তাছাড়া মাছচাষ হয় ধানক্ষেত, বিল এবং নদীতে। মোট মৎস্যজীবীর সংখ্যা ১১ হাজার ৮৬৬ জন। আর মাছচাষের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় এক লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহীর নয়টি উপজেলার মধ্যে পবার পারিলা, দুর্গাপুর, পুঠিয়া, তানোর এবং গোদাগাড়ীর বরেন্দ্র অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি মাছচাষ হচ্ছে। উৎপাদন হওয়া মাছের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাষ হচ্ছে রুই, কাতল, মৃগেল, সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প ও জাপানী রুই। প্রতিদিন রাজশাহীর এসব উপজেলায় মাছ ধরছেন চাষীরা। এরপর বিশেষ পদ্ধতিতে জীবন্ত অবস্থায় তা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হচ্ছে। জেলা মৎস্য সম্পদ কর্মকর্তা বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে রাজশাহীর মাছ রফতানির জন্য পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে লক্ষ্যণীয় অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে।
×