ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এম. নজরুল ইসলাম

শুভ জন্মদিন শেখ রেহানা ॥ যাঁকে স্পর্শ করেনি কোন মোহ

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৬

শুভ জন্মদিন শেখ রেহানা ॥ যাঁকে স্পর্শ করেনি কোন মোহ

মঞ্চে পাদপ্রদীপের আলো যেখানে পড়ে সে জায়গাটি জ্বলজ্বল করে। পাশেই অন্ধকার। সেই অন্ধকারেও এমন কেউ কেউ থাকেন, যাদের আলোয় মঞ্চ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সাদা চোখে সে আলোর বিচ্ছুরণ দেখা যায় না, অনুভব করা যায়। তেমনই একজন মানুষ শেখ রেহানা। আগামীকাল ১৩ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্মদিন। যে পরিবারে তাঁর জন্ম, সেখানে তাঁর ওপরও আলো পড়ার কথা। কিন্তু নিজেকে সে আলো থেকে সযতেœ সরিয়ে রেখেছেন তিনি। কেন? কারণ তাঁকে স্পর্শ করেনি কোন মোহ। যেন এক অন্তর্গত মানুষ হিসেবেই নিজেকে গড়ে তুলেছেন তিনি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে পঁচাত্তরে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা, বড় বোন শেখ হাসিনার রাজনীতিতে যোগদান, আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ তাঁকেও সমানভাবে আলোড়িত করার কথা, করেও হয়ত। কারণ, রাজনীতির অন্যরকম টান থাকে। রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হিসেবে রাজনীতির পথটিই তিনি বেছে নিতে দ্বিধা করবেন না, এটাই স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু এই সরল সমীকরণটি তিনি বিবেচনায় না এনে বেছে নিলেন আটপৌরে গার্হস্থ্য জীবন। আপাতত এই চিত্রটিই উন্মুক্ত সবার সামনে। আমরা যদি একটু আলাদা করে বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ রেহানার অবদান উপেক্ষা করার মতো নয়। প্রত্যেক রাজনৈতিক নেতৃত্বের নেপথ্যে আরও একজনকে পাওয়া যায়, যাঁর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা ছাড়া সাফল্য প্রায় অসম্ভব। শেখ রেহানা তেমনই একজন, যিনি সবসময় বড় বোনের পাশে থেকেছেন, তাঁকে সাহস যুগিয়েছেন। প্রবাসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব সবসময় তাঁকেই পেয়েছে কা-ারি হিসেবে। অন্যরকম হওয়ার কথা ছিল তাঁর জীবন। জাতির জনকের কন্যা তিনি। রাজনীতির চড়াই-উৎরাই দেখেছেন খুব কাছ থেকে। সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবনে বঙ্গবন্ধুকে বার বার কারাবরণ করতে হয়েছে। এসব সময়ে তাঁর পরিবারকে নানা সমস্যায় পড়তে হয়েছে। শেখ রেহানা খুব কাছ থেকে দেখেছেন কিভাবে তাঁর মা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব একা সামলেছেন সব ঝড়-ঝাপ্টা। দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক পরিবারের শীর্ষ নেতার পরিবারটিও আর দশটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মতোই ছিল। সেখানে মনের দীনতা ছিল না। বরং আড়াল থেকে নিজেকে উজাড় করে দেয়ার শিক্ষা তিনি পারিবারিক পরিম-ল থেকেই পেয়েছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর নির্বান্ধব পরবাসে নিজেদের মতো করে জীবন যাপনের অভিজ্ঞতাও তাঁকে ঋদ্ধ করেছে। অভ্যস্ত করেছে পরিমিত জীবনাচারে। কৈশোর-উত্তীর্ণ বয়সেই অনুভব করতে হয়েছে শূন্যতা। যে শূন্যস্থান পৃথিবীর কোন সম্পদ দিয়ে পূরণ করা যায় না। কিন্তু রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হিসেবে কাউকে তা বুঝতে দেননি। বরং বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে খুঁজে ফিরেছেন আত্মার আত্মীয়দের। যে কথা তিনি এক সাক্ষাতকারেও উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, ‘আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। জনগণের মধ্যে থেকে তৃণমূল থেকে রাজনীতি করে আমার বাবা হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের জনক। আমরা সেই বঙ্গবন্ধুর সন্তান, জনগণের মধ্যে এখনও আমরা খুঁজে ফিরি আমাদের মা-বাবা ও পরিবার সদস্যদের, সেই জনগণের ভালবাসা নিয়েই জীবনের বাকি সময়টুকুও পাড়ি দিতে চাই। আমাদের জীবনে সবচেয়ে বড় পাওয়া আমরা বঙ্গবন্ধুর কন্যা। এই লন্ডনেও যখন রাস্তায় বের হই, তখন দেখি বিভিন্ন বর্ণের অনেকেই বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে সম্মান করছে। সঙ্গে নিয়ে একটি ছবি তুলতে চাইছে। এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে আমাদের।’ অর্থাৎ অর্থভা-ারের মূল্যবান কোন সামগ্রী নয়, স্মৃতিভা-ারের সম্পদই তাঁর কাছে মহামূল্যবান। তিনি গৃহকোণচারিণী কিন্তু গৃহসীমানার মধ্যে সঙ্কুচিত নয় তাঁর জীবন। ঘরে ও বাইরে সমানভাবে চিরায়ত কল্যাণী তিনি। সর্বক্ষেত্রে তিনি অপরিসীম ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়েছেন। সত্যিনিষ্ঠায় সুদৃঢ় থেকেছেন। মিথ্যাকে আশ্রয় করেননি। সত্যের নির্মলতম আদর্শ রক্ষা করেছেন সবসময়। নিজের ছেলেমেয়েদের মানুষ করে তোলার ব্যাপারে আপস করেননি। মিথ্যা সুবিধার ভোগবাদিতায় আকৃষ্ট হননি। প্রতিকূল পরিবেশে লড়াই করেছেন। প্রকৃতিই বোধকরি তাঁকে আদর্শ এক মানুষে পরিণত করেছে। জীবনের যে সময়ে উচ্ছলতায় ভেসে যাওয়ার কথা, তখনই পেয়েছেন সবচেয়ে বড় আঘাত। এর পর থেকেই তো শুরু হয়েছে জীবন-সংগ্রাম। যে সংগ্রাম এখানও শেষ হয়নি তাঁর। কষ্ট হয়েছে, কিন্তু সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। তাঁরা সবাই আজ নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। সব কিছুর পর তাঁকে রাজনীতিবিমুখ ভাবার কোন অবকাশ কিন্তু নেই। রাজনীতি যাঁর রন্ধ্রে তাঁকে কি রাজনৈতিক কর্মকা- থেকে সরিয়ে রাখা যায়। তিনি নেপথ্যের একজন হয়ে গেলেন, প্রকাশ্যে না এসেও সম্পৃক্ত হলেন রাজনৈতিক কর্মকা-ে। তিনিই তো প্রথম মানুষ যিনি প্রবাসে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের বিচার চেয়েছিলেন ১৯৭৯ সালের ১০ মে। দেশের প্রয়োজনে সবসময় তিনি পাশে থেকেছেন। আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যখন গ্রেফতার করা হয়, তখন তিনি প্রবাসী নেতৃত্বের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখেছেন। সাহস যুগিয়েছেন। লন্ডনে স্থায়ীভাবে বসবাস করলেও আমরা জানি, এখনও তিনি আছেন বড়বোনের পাশে, ছায়ার মতো। তাঁর মতো নির্মোহ মানুষ বাংলাদেশের রাজনীতিতে বড় প্রয়োজন। তিনি কি সেই প্রয়োজন অনুভব করেন? তিনি কি শুনতে পান বাংলাদেশের অন্তরাত্মার আহ্বান? আড়াল ভেঙ্গে তিনি প্রকাশ্যে আসবেন কোনদিন? জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাই তাঁকে। শুভ জন্মদিন আপা। লেখক : অস্ট্রিয়া প্রবাসী মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক হধুৎঁষ@মসী.ধঃ
×