ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

ঈদ-উল-আযহার তাৎপর্য

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৬

ঈদ-উল-আযহার তাৎপর্য

মানব সভ্যতার ইতিহাসে কোরবানি অতি প্রাচীন রীতি। আরবী কুরব শব্দের অর্থ নৈকট্য। এর থেকে কুরবান বা কোরবানি। এর অর্থ আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ। এক নারীকে পাবার তীব্র বাসনাকে কেন্দ্র করে হযরত আদম আলায়হিস সালামের দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের মধ্যে দ্বন্দ্ব বেধে যায়। হযরত আদম আলায়হিস সালাম পুত্র দু’জনকে নির্দেশ দিলেন তোমরা কোরবানি দাও। যার কোরবানি আল্লাহ কবুল করবেন সেই ঐ নারীকে শাদী করতে পারবে। কাবিল কিছু শস্যাদি পাহাড়ের ওপর কোরবানির নিয়তে রেখে এলেন এবং হাবিল রেখে এলেন একটি মোটাসোটা ভেড়া। নিয়ম অনুযায়ী আকাশ থেকে বিদ্যুত পড়ে হাবিলের কোরবানি গৃহীত হবার নিদর্শন ঘোষিত হলো। এটা সহ্য করতে পারল না কাবিল। সে তার বিশ বছর বয়স্ক ভাই হাবিলকে হত্যা করল। এটাই মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রথম হত্যার ঘটনা। কোরআন মজীদে এই ঘটনার উল্লেখ আছে। ইরশাদ হয়েছে : হে রসূল! আপনি আদমের দুই পুত্রের বৃত্তান্ত তাদের যথাযথভাবে শুনিয়ে দিন। যখন তারা উভয়েই কোরবানি করেছিল তখন তাদের একজনের কোরবানি কবুল হলো এবং অন্যজনের কবুল হলো না। সে বলল, আমি তোমাকে হত্যা করবই। অপরজন বলল, অবশ্যই আল্লাহ মুত্তাকীদের কোরবানি কবুল করেন। (সূরা মায়িদা আয়াত ২৭)। কোরআন মজীদে বিভিন্ন জাতির মধ্যে উৎসর্গ করার উল্লেখ রয়েছে। হযরত মূসা আলায়হিস সালামের নিকট একটি মোটাসোটা সুবর্ণ গাভী কোরবানির হুকুমও নাযিল হয়েছিল। সূরা বাকারায় সে বৃত্তান্ত রয়েছে। বাকারা শব্দের অর্থও গাভী। মানব সভ্যতার শ্রেষ্ঠ ঘটনা মুসলিম জাতির জনক আল্লাহর খলীল হযরত ইবরাহীম আলায়হিস সালাম কর্তৃক আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নিজের প্রায় ১১ বছর বয়স্ক জ্যেষ্ঠপুত্র হযরত ইসমাঈল আলায়হিস সালামকে মক্কা মুকাররমা থেকে তিন মাইল পূর্বদিকে মিনা উপত্যকায় একটি পাথর খ-ের ওপর কাত করে শায়িত অবস্থায় ধারালো ছোরা দিয়ে কোরবানি করতে উদ্যত হলে আল্লাহর তরফ থেকে আহ্বান নায়িল হলোÑ হে ইবরাহীম, তুমি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছো। কোরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : (ইবরাহীম বলেছিল) হে আমার রব! আমাকে এক সৎকর্মপরায়ণ সন্তান দান করুন। অতঃপর আমি তাকে এক স্থির বুদ্ধি পুত্রের সুসংবাদ দিলাম। অতঃপর সে (পুত্র) তার পিতার সঙ্গে কাজ করবার মতো বয়সে উপনীত হলো তখন ইবরাহীম তাকে বলল : বৎস! আমি স্বপ্নে দেখলাম যে, আমি তোমাকে যবেহ্ করছি, এখন এ ব্যাপারে তোমার মতামত বলোতো দেখি? সে বলল : হে আমার আব্বাজান! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন সেটাই করুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। যখন তারা (পিতা-পুত্র) উভয়েই আনুগত্য ব্যক্ত করল এবং ইবরাহীম তার পুত্রকে কাত করে শায়িত করল, তখন আমি (আল্লাহ) তাকে আহ্বান করে বললাম, হে ইবরাহীম! তুমি তো স্বপ্নাদেশ সত্যই পালন করলে। এভাবে আমি সৎকর্ম পরায়ণদের পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয়ই এটা ছিল এক স্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাকে মুক্ত করলাম এক মহান কোরবানির বিনিময়ে। আমি এটা পরবর্তীদের স্মরণে রেখেছি। ইবরাহীমের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। (সূরা সাফফাত : আয়াত ১০০-১০৯) এই ঘটনার স্মরণেই প্রতিবছর জিলহজ মাসে মুসলিম বিশ্বজুড়ে ঈদ-উল-আযহা বা কোরবানির ঈদ পালিত হয়। ৯ জিলহজ মক্কা মুকাররমার সোজা পুবদিকে ১৫ কিলোমিটার দূরে আরফাত ময়দানে জোহর থেকে সূর্য অস্ত যাবার আগ পর্যন্ত অবস্থান করা অবশ্য কর্তব্য। এটাই হজের মূল অনুষ্ঠান। আরাফাত থেকে ১০ জিলহজ সারা রাত্রি যাপন শেষে মিনায় এসে বড় শয়তানকে ৭টি কংকর মেরে পশু কোরবানি দিয়ে মাথার চুল কেটে গোসল করে স্বাভাবিক পোশাক পরিধান করতে হয়। আর এরই মধ্যদিয়ে ঈদ-উল-আযহার আনন্দ বৈভব আন্দোলিত হয় সর্বত্র। এই ঈদ-উল-আযহা মুসলিম দুনিয়ার সর্বত্র পালিত হয় নানা নামে যেমন, মিসরে একে বলা হয় ঈদ-উল-বাকারা, সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে একে বলা হয় ঈদে কুরবান, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ইরান প্রভৃতি অঞ্চলে বাকরা ঈদ, বাংলাদেশে সাধারণত একে বলা হয় কোরবানির ঈদ, তুরস্কে বলা হয় কুরবান বায়রাম, এ্যারাবিয়ান গালফ এলাকায় ইয়াওমুন নাহর, ঈদ মানে পুনরাবৃত্ত আনন্দ উৎসব। এই ঈদে পশু কোরবানি দেয়া সামর্থ্যবানদের জন্য ওয়াজিব। কুরবানকৃত পশুর গোশত তিন ভাগ করে এক ভাগ গরিব মিসকিনদের মধ্যে বিতরণ করতে হয় যাতে তারাও এই আপ্যায়নে শরিক হতে পারে। পশু কোরবানির মাধ্যমে শয়তান প্ররোচিত পাশবিকতা দূর হয়। এর দ্বারা তাকওয়া অর্জিত হয়। কোরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে; আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না ওগুলোর গোশত এবং রক্ত, বরং পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া। (সূরা হজ : আয়াত ৩৭), ঈদ-উল-আযহা মানবিক মূল্যবোধকে জাগ্রত করে। লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ
×