ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

দাম কমে আসায় বেড়েছে কেনাকাটা, সেলফি তোলার হিড়িক

অবশেষে কোরবানির পশুতে সয়লাব ঢাকার সব হাট

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৬

অবশেষে কোরবানির পশুতে সয়লাব ঢাকার সব হাট

রহিম শেখ ॥ রাত পোহালেই ঈদ-উল-আযহা। আর এই উৎসব ঘিরে ইতোমধ্যে কোরবানির পশুতে সয়লাব হয়ে গেছে রাজধানী ঢাকা। এক কথায় বলা যায়, জমে উঠেছে কোরবানির পশুর হাট। প্রতিটি হাটেই উপচেপড়া গরু, ক্রেতাও ছিল ঠাসা। দরকষাকষি শেষ। কোরবানির পশু কিনে এখন বাড়িমুখী হওয়ার পালা। হচ্ছেনও তাই। দাম কিছুটা কমায় আগের তুলনায় বিক্রিও বেশ। অনেকেই বলছেন, শেষ পর্যন্ত ভারতীয় গরু হাটে আসার খবরে খামারীরা দাম কমিয়েছেন। এবার এমনিতেই হাটে গরু আমদানি বেশি হওয়ায় দাম শেষ পর্যন্ত কমতির দিকে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। আর সেই ধারণা নিয়ে গরুর দাম হাঁকাচ্ছেন বেপারিরা। এদিকে রাজধানীর সবচেয়ে বড় পশুর হাট গাবতলীতে বিপুলসংখ্যক পশু ওঠায় রাখার জায়গা পাচ্ছেন না বিক্রেতারা। একই চিত্র রাজধানীর অধিকাংশ হাটের। বৈধ হাটের সঙ্গে মিশে গেছে অবৈধ হাট। সকাল-সন্ধ্যা কিংবা মধ্য রাতে গরুবাহী ট্রাক ঢুকছে ঢাকায়। হাটের সীমানা ছাড়িয়ে আশপাশের রাস্তায়, অলিগলিতেও এখন শুধু কোরবানির পশু। রবিবার রাজধানীর কয়েকটি গরুর হাট ঘুরে দেখা গেল, সাধ আর সাধ্যের সমন্বয় ঘটিয়ে পছন্দের পশু কিনে খুশিতে বাড়ি ফিরছেন ক্রেতারা। হাট শুরুর কয়েকদিনের খরা কাটিয়ে রবিবার থেকেই মূলত গরু কেনার ধুম পড়েছে। বিক্রেতারাও প্রত্যাশিত দাম পেয়ে সন্তুষ্ট। আর ক্রেতারা জানিয়েছেন, গরু-ছাগলের দাম গতবারের চেয়ে কিছুটা বেশি হলেও তা নাগালের বাইরে নয়। রাজধানীর হাটগুলো দেশী গরুতে ভরপুর। চাহিদাও এগুলোরই বেশি। প্রতিটি হাটে এখনও ট্রাক বোঝাই করে গরু ও ছাগল আসছে। হাটের সীমানা ছাড়িয়ে আশপাশের রাস্তায়, অলিগলিতেও পশু রাখা হচ্ছে। অধিকাংশ হাটেই গরু রাখার জায়গা নির্দিষ্ট জায়গা পূরণ হয়ে গেছে। ফলে আশপাশের সড়ক ও খালি জায়গা দখল করছেন বেপারিরা। বেশি গরু ওঠায় ইজারাদাররা খুশি থাকলেও বেপারিরা স্বস্তিতে নেই। বরং আমদানি বেশি হওয়ায় তারা কিছুটা চিন্তিত। নগরীর সব হাট কোরবানির পশুতে কানায় কানায় পূর্ণ। কোন কোন হাট নির্দিষ্ট সীমানা ছাড়িয়ে বহু দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। অস্থায়ী হাট চলে এসেছে মূল সড়কে। গাবতলীর মূল হাট ছেড়ে ট্রাকস্ট্যান্ডসহ আশপাশের সড়কের পাশে গরু রাখা হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকায় প্রবেশের বিভিন্ন মহাসড়কে দীর্ঘ যানজটেও শত শত গরুর ট্রাক আটকা পড়ে আছে। সীমান্তপথে ভারত, মিয়ানমার ও নেপাল থেকেও গরু আসছে। ক্রেতারা বলছেন, বাজারে যেহেতু গরু অনেক, তাই শেষ সময়ে দাম আরও কমে যেতে পারে। বিক্রেতাদের দাবি, আগের চেয়ে পশুখাদ্যের দাম বেশি। বেড়েছে পরিবহন খরচও, তাই গরুর দাম একটু বেশিই রাখতে হচ্ছে। এদিকে বেপারিরা বলছেন, পথে পথে গরুর ট্রাকে চাঁদাবাজি হচ্ছে। কুষ্টিয়া থেকে ১৭ গরু নিয়ে আসা ইব্রাহিম খলিল বলেন, পথে অন্তত পাঁচ জায়গায় বখশিশের নামে চাঁদা দিতে হয়েছে। একই অভিযোগ করেছেন উত্তরাঞ্চল থেকে রাজধানীতে গরু নিয়ে আসা খামারীরা। কুষ্টিয়া থেকে গাবতলী হাটে গরু নিয়ে এসেছেন সামাদ বেপারি। বিকেলে দুটি গরু বিক্রি করেছেন তিনি। একটি ৫২ হাজার, অন্যটি ৮৫ হাজার টাকায়। তারপরও খুশি নন এ বেপারি। তার মতে, এবার লাভ দূরে থাক, আসল ওঠানোই দায় হয়ে পড়েছে। গাবতলী হাটে লাখ টাকার ওপর পশু বিক্রি নেই বললেই চলে। বড় গরুর দিকে ক্রেতারা তেমন নজরই দিচ্ছেন না। তবে উট-দুম্বা নিয়ে ব্যাপক উৎসাহ হাটে আসাদের। এবার উটের পাল নিয়ে হাটে এসেছেন মাত্র এক বেপারী। আর দুম্বা এনেছেন হাতেগোনা কয়েকজন। ক্রেতারা হাট ঘুরে ঘুরে উটের কাছে যাচ্ছেন। দরদাম জানছেন আর সেলফি তুলছেন। রবিবারও হাটের এপাশ-ওপাশ ঘুরে গরু কিনেছেন অনেক ক্রেতাই। কেউ দিনভর করেছেন দরকষাকষি। রবিবার দুপুরে ৬৭ হাজার টাকা দিয়ে একটি গরু নিয়ে যাচ্ছিলেন মিজানুর রহমান নামের এক ক্রেতা। এর আগে টানা তিনদিন হাটে এসেছিলেন তিনি। জানালেন, চড়া দামের কারণে গরু কেনা হয়নি। তিনি জানান, এখন দাম একটু কমতির দিকে থাকায় ভাল দামেই গরু কিনেছি। এ হাটে কয়েকজন ক্রেতাকে অবশ্য দেখা গেল ঘুরে ঘুরে মোটাতাজা গরুগুলোকে পরখ করছেন। তাদের একজন বললেন, প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে তিনি এই গরুগুলোর সঙ্গে অন্য গরু মিলিয়ে দেখছেন। তিনি জানান, সবাই স্বাস্থ্যকর গরু কিনতে চায়। এ হাট থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা দিয়ে মাঝারি মানের তিনটি দেশি গরু কিনেছেন কল্যাণপুর এলাকার বাসিন্দা ছায়েদ আহমদ। তিনি জানান, হাটে কৃত্রিমভাবে মোটাতাজা করা গরু থাকলেও মাঝারি মানের তিনটি গরু কিনেছি। সবাই এখন জানে কিভাবে গরু মোটাতাজা করা হয়। কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা থেকে গত বুধবার ২২টি গরু নিয়ে এসেছেন হাকিম আলী বেপারি। গত দুদিনে ৬টি গরু বিক্রি করতে পেরেছেন তিনি। জানালেন, সবাই এখনও দরদাম করছে। অথচ প্রতিদিন নিজের হোটেল ভাড়া ও খাবার বাবদ দুই হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। আর ১৬টি গরুর পেছনে প্রতিদিন এক হাজার টাকার বেশি খরচ হচ্ছে। এক আঁটি খড় কিনতে হচ্ছে ৪০ টাকায়। খৈল ও কাঁচা ঘাস কিনতে হচ্ছে ৫০০ টাকার। দুই হাজার টাকা দিয়ে বৃষ্টি থেকে গরুকে রক্ষায় পলিথিন কিনেছি। হাকিম আলী জানালেন, এবার লাভ দূরে থাক, আসল ওঠানোই দায় হয়ে পড়েছে। এই হাটে ১০টি গরু নিয়ে এসেছেন কুষ্টিয়ার সাইদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ভারতের গরু আসবে না, তাই এবার গরুর ভাল দাম পাব- এমন আশায় তিন মাস আগে ১০টি গরু কিনেছিলাম। কিন্তু এখন বাজারের যে অবস্থা, তাতে মনে হয় ভালো দাম পাবো না। নিজের পালা পাঁচটি গরু নিয়ে এই হাটে বৃহস্পতিবার এসেছেন কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের ইউসুব আলী। তিনি বলেন, আশা করছিলাম ৮০-৯০ হাজার টাকা করে গরু বিক্রি করব। কিন্তু কেউ ৫০ হাজার টাকার বেশি বলে না। তবে শেষ পর্যন্ত ভারতীয় গরু না এলে ভাল দাম পাওয়া যাবে বলে আশা করছেন এই বিক্রেতা। মিরপুরের মনিপুর এলাকার ব্যবসায়ী আসিফ হোসেন গাবতলী থেকে ৬৭ হাজার টাকায় মাঝারি আকারের একটি গরু কিনেছেন। তিনি বলেন, এবার গরুর দাম গতবারের চেয়ে সামান্য চড়া থাকলেও তা ক্রয়ক্ষমতার বাইরে নয়। গত বছর তিনি এ রকম সাইজের একটি গরু ৫২ হাজার টাকায় কেনেন বলে জানান। কুষ্টিয়ার বেপারি আব্দুর রহিম বলেন, সকাল থেকে হাটে মানুষের ভিড় বেড়েছে। গরুও ভাল বিক্রি হচ্ছে। সময় যতো গড়াবে, ভিড় আর বিক্রি দুটোই বাড়বে। তবে ক্ষোভ প্রকাশ করে এ বিক্রেতা বলেন, মানুষ দাম বলছে ৪ ভাগের ১ ভাগ। এখন পর্যন্ত গরুর দাম স্বাভাবিক আছে। শেষ পর্যন্ত দামের খুব বেশি তারতম্য হবে না বলে আশা করেন তিনি। ঈগল এ্যাগ্রো ফার্মের ম্যানেজার রুহুল আমিন বলেন, শেষ সময়ে ভারতীয় গরু প্রবেশের খবর শোনা যাচ্ছে। তবে এর প্রভাব পড়বে না। কারণ বর্ডার থেকে ঢাকায় আনার সময় খুব বেশি পাবে না। আর এখনই গরু পর্যাপ্ত আছে। তবে অনেক ক্রেতাই জানালেন, শেষ পর্যন্ত ভারতীয় গরু হাটে আসার খবরে খামারীরা দাম কমিয়েছেন। সূত্র বলছে, এবার ভুটান, মিয়ানমান, নেপাল ছাড়া ভারতীয় গরু আগেভাগেই আসলেও রাজধানীতে আসা শুরু করেছে গত শনিবার থেকে। ফলে হাটে এখন দাম কিছুটা কমদির দিকে রয়েছে বলে অনেক ক্রেতাই জানালেন। এছাড়া নগরীর কমলাপুরে স্টেডিয়ামের পাশের মাঠ, খিলগাঁওয়ের মেরাদিয়া বাজার, সাদেক হোসেন খোকা খেলার মাঠ, আফতাবনগর ও মেরাদিয়া পশুর হাট, মিরপুর সেকশন-৬ ইস্টার্ন হাউজিংয়ের খালি জায়গা ও মহাখালীর কড়াইল এলাকার টিএ্যান্ডটি মাঠসংলগ্ন পশুর হাট ঘুরে দেখা গেছে, কোরবানির পশুতে কানায় কানায় পূর্ণ। রাজধানীতে যেভাবে গরু আসছে তাতে অধিকাংশ হাট আরও সম্প্রসারিত হবে বলে মনে করছেন অনেকেই। অধিকাংশ হাট পরিচালনা কমিটির সদস্যরা বলছেন, এ বছর বাজারের চরিত্র বোঝা যাচ্ছে না। এখনও পর্যন্ত গরুর দাম বেশি। কিন্তু যে হারে কোরবানির পশু রাজধানীতে আসছে তাতে শেষ পর্যন্ত দাম কিছুটা কমতির দিকে থাকতে পারে বলে তারা জানান।
×