ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মোঃ ওবায়েদ উল্লাহ্

‘জয় বাংলা’য় কেন এত ভীতি ॥ অভিমত

প্রকাশিত: ০৭:২৫, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৬

‘জয় বাংলা’য় কেন এত ভীতি ॥ অভিমত

১৯৭১ সালের অক্টোবরের একটি ঘটনা। স্থান ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের শেষদিক। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী বুঝতে পেরেছিল তাদের দিন ফুরিয়ে এসেছে। তাই তারা মরণকামড় দেয়ার জন্য রাত দুটার সময় ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট থেকে ১২০ মি.মি. গান দিয়ে এ্যাটাক শুরু করল। উদ্দেশ্য-আগরতলার সাপ্লাই লাইন বন্ধ এবং আগরতলা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একমাত্র বৃহৎ পেট্রোল স্টেশন ধ্বংস করে দেয়া। একে একে ৯টি শেল পর পর এসে পড়ল তার আশপাশে। পুরো আগরতলা শহর শেলের বিকট শব্দে কেঁপে উঠল। আতঙ্কে মানুষের ঘুম ভেঙ্গে গেল। একটি শেল এসে পড়ল আমরা যে টিনশেড দালানে ছিলাম তার একেবারে পাশে। আমাদের শোয়ার জায়গা থেকে মাত্র ২০ হাত দূরে আমরা পরিখা করে রেখেছিলাম। শেলটি সেই পরিখার মধ্যে পড়ায় নিশ্চিত মৃত্যু থেকে সবাই রেহাই পেলাম। তখনও আমরা বুঝে উঠতে পারিনি। কারণ, মাটি এসে পড়ল আমাদের টিনের ওপর ও দেয়ালে। মনে হলো পুরো টিনশেড দালান আমাদের ওপর ভেঙ্গে পড়বে। আমার পাশে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সেলিম। তাকে বললাম উপুড় হয়ে শোয়ার জন্য। দালান ভেঙ্গে পড়লেও হয়ত আমরা বাঁচতে পারব। না, দালান ভেঙ্গে পড়ল না। এ যাত্রায় রক্ষা পেলাম। আর বম্বিং না হওয়াতে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। কিন্তু বেশিক্ষণ ঘুমাতে পারলাম না। ভোর না হতেই আগরতলার আবালবৃদ্ধবনিতা শেলের তা-ব দেখার জন্য দলে দলে হুমড়ি খেয়ে ছুটতে লাগল। ঘুম ভেঙ্গে গেল। বের হয়ে দেখি, মানুষ আর মানুষ। তাদের সামনে একটি ছোটখাটো পুকুর। যা দানব শেলের কারণেই। আর ইস্পিøন্টারের আঘাতে পাশের একতলা দালানের এক দিকের দেয়াল ছাদসহ উড়ে গেছে। এ তা-ব দেখে তাদের মুখে একটাই শব্দ ও আক্ষেপÑ জয় বাংলার লোকদের এত বিপদ! বার বার তারা আমাদের জয় বাংলার লোক বলে সম্বোধন করছিল। তারা কেউই আমাদের দেশের নাম বাংলাদেশ বলেনি। বলেছে জয় বাংলার লোক। তা হলে কি দাঁড়াল? আমাদের দেশের অন্য নাম জয় বাংলা। জয় বাংলা হলো মুক্তি সংগ্রামের মূল চেতনা। এই জয় বাংলা সেøাগানে সারাদেশের মানুষকে বাঙালী জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাই ’৭০-এর নির্বাচনে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও বাংলার মানুষ তার পক্ষে রায় দেয়। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ভাষণের ছবিতে দেখা যায় সভায় উপস্থিত সবাই জয় বাংলা সেøাগান দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান। মুক্তি সংগ্রামের নয় মাস বাংলার হাট-বাজারে, পথে-ঘাটে ও যুদ্ধক্ষেত্রে সবাই বলেছে জয় বাংলা। যুদ্ধক্ষেত্রে কোন মুক্তিযোদ্ধা শত্রুর গুলি খেয়ে মরার সময় বলেছে জয় বাংলা। তাই বিদেশীদের কাছে আমাদের দেশের নাম হয়ে যায় জয় বাংলা। আপসোস, সেই জয় বাংলা বলতে আমরা ভুলে গেছি। আজ সেই জয় বাংলা বলতে অনেকে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগে। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানের দালালরা একই সঙ্গে বাংলাদেশটিকে হত্যা করল। সঙ্গে সঙ্গে জয় বাংলাকেও হত্যা করল। মেজর জিয়াউর রহমান জয় বাংলার বদলে পাকিস্তান জিন্দাবাদের আদলে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ সেøাগান প্রবর্তন করলেন। উদ্দেশ্য একটিইÑ মুক্তি সংগ্রামের মূল চেতনা জয় বাংলা মানুষের মন থেকে মুছে দিতে হবে। তাহলেই দেশটাকে আবার মিনিপাকিস্তান বানানো যাবে। জিয়ার পর এরশাদ সাহেবও ক্ষমতায় বসে জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করে খুব জোরে জিন্দাবাদ বলতেন। তারপর জিয়ার বেগম খালেদা জিয়া যিনি পাকিস্তানপ্রেমে মত্ত, তিনিও জিন্দাবাদ বহাল রাখতে ভালবাসেন। এর সঙ্গে দেশের কিছু বুদ্ধিজীবী ও টিভি উপস্থাপক মুক্তি সংগ্রামের মূল চেতনা জয় বাংলাকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে মুক্তি সংগ্রামের চেতনা বলে বক্তব্য দেন। এ চারটি হলো মুক্তি সংগ্রামের আদর্শ, চেতনা নয়। আবার এক টকশোতে এক প্রাক্তন কূটনীতিক মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও স্বাস্থ্যকে মুক্তি সংগ্রামের চেতনা বলে উল্লেখ করে। এসব বলা হয় শুধু মুক্তি সংগ্রামের মূল চেতনা জয় বাংলাকে খাটো করার প্রয়াসে। তারা কেউই বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে বিশ্বাস করে না। এর বড় প্রমাণ তারা কখনও দলীয়ভাবে বা ক্ষমতায় থাকাকালে রাষ্ট্রীয়ভাবে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবস পালন করেনি। আজও তারা তা পালন করে না। এর প্রধান কারণ, মেজর জিয়াউর রহমান মুক্তি সংগ্রামের সময় তাদের অধীনে যুদ্ধ করেছেন। অথচ ১৯৭১ সালের সেই দিনে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে যে সরকার অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে মুক্তি সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে ও স্বাধীনতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে, তারা মুজিব নগরের আম্রকাননে শপথ নিয়েছিল। তাই এটি জাতির জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন। ফলে সমাজের একটা প্রজন্ম স্বাধীনতার মূল চেতনা জয় বাংলা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অবহিত নয়, তারা দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে এ বিষয়টি সম্পূর্ণ প্রকাশ পায় গত বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলায়। যখন আমাদের দামাল ছেলেরা বিশ্বের বড় বড় দলকে নাস্তানাবুদ করে তখন গ্যালারিতে বসা বাঙালী দর্শক ছেলেমেয়েরা জয় বাংলা না বলে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ বলেছে। শুধু বলে বাংলাদেশ বাংলাদেশ। হ্যাঁ, একদিন কিছু দর্শক জয় বাংলা বলেছে। তখন সত্যিই বড় ভাল লেগেছে। আজ এই জয় বালা সেøাগানকে অনেকেই ভয় পান। তাদের ধারণা হলো, দেশের সব লোক যদি জয় বাংলা বলে তাহলে পুরো দেশটাই আওয়ামী লীগের হয়ে যায়। তাই গণজাগরণ মঞ্চ যখন জয় বাংলা সেøাগান দিয়ে শাহবাগ চত্বর মাতাল করে ফেলল, তখনই বেগম খালেদা জিয়া ও এরশাদ সাহেব তাদের বিরুদ্ধে লেগে গেল। বলে ফেলল তারা নাস্তিক ও তাদের রুখতে হবে। আমার দেশ পত্রিকায় মাহমুদুর রহমান তাদের বিরুদ্ধে উদ্ভট ছবি ছাপিয়ে পুরো দেশবাসীকে খেপিয়ে তুলল। কিছুটা হলেও জয় বাংলা সেøাগানের সফল যাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করে। স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল চেতনা জয় বাংলা সেøাগানকে দাবিয়ে রাখা যাবে না। বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে সবাইকে জয় বাংলা বলতে হবে। সবাইকে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা মানতে হবে। সবাইকে তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী ও জন্মবার্ষিকী দলীয়ভাবে পালন করতে হবে। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবস সবাইকে দলীয়ভাবে পালন করতে হবে। জাতীয় এই ইস্যুগুলোতে সব রাজনৈতিক দলকে এক হতে হবে। জয় বাংলা! লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক মহাব্যবস্থাপক, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিঃ
×