ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আমাদের ৫ পোশাকের ৫০ বিলিয়নের সমান

প্রকাশিত: ০৭:২৫, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৬

আমাদের ৫ পোশাকের ৫০ বিলিয়নের সমান

॥ দুই ॥ গত সপ্তাহে আমরা বাংলাদেশের সফটওয়্যার রফতানির কথা বলেছি। এবার বিষয়টিকে আরও বিস্তৃত করে ব্যাখ্যা করছি। দুটিই একটি নিবন্ধের দুই ধারা। আলাদা বা একসঙ্গে পাঠ করেও মূল বিষয়টি বোঝা যাবে। এই বিষয়ে দৈনিক সমকালের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বছর কয়েক আগেও সফটওয়্যার খাতে বিদেশী কোম্পানি বাংলাদেশে একচেটিয়া ব্যবসা করত। কিন্তু ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্প বাস্তবায়নের পথ ধরে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। দেশে ব্যাংকিং, ই-গভর্নমেন্ট কার্যক্রমে দেশী কোম্পানির অংশগ্রহণ যেমন বেড়েছে তেমনি বহির্বিশ্বেও সমাদৃত হচ্ছে বাংলাদেশী সফটওয়্যার। কোর ব্যাংকিং কার্যক্রমে একাধিক ব্যাংক এখন বাংলাদেশী সফটওয়্যার ব্যবহার করছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের সহযোগী অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান আলম সমকালকে জানান, ব্যাংকিং খাতে ৩৬ ভাগ দেশীয় সফটওয়্যার, ৫৭ ভাগ ব্যাংকে ব্যবহার হচ্ছে বিদেশী সফটওয়্যার। কোর ব্যাংকিংয়ে দেশের অন্যতম শীর্ষ সফটওয়্যার নির্মাতা কোম্পানি মিলেনিয়াম ইনফরমেশন সল্যুশন লিমিটেড। ইসলামী ব্যাংকিংয়ে প্রতিষ্ঠানটির ডেভেলপ করা আবাবিল সফটওয়্যার সমাদৃত। কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মাহমুদ হোসাইন সমকালকে বলেন, তারা আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক এবং ইউনিয়ন ব্যাংকে পূর্ণাঙ্গ ব্যাংকিং সল্যুশন দিচ্ছেন। পাশাপাশি দ্য সিটি ব্যাংক, এবি ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক ও রূপালী ব্যাংকে আবাবিল সফটওয়্যার ব্যবহার হচ্ছে। ব্যাংকিং কার্যক্রমে দেশী সফটওয়্যারের সম্ভাবনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিদেশী সফটওয়্যার যেখানে ৮ থেকে ১০ কোটি টাকায় কিনতে হয় সেখানে ৩ থেকে ৫ কোটি টাকায় দেশী সফটওয়্যার পাওয়া যাচ্ছে। মেইনটেন্যান্স ও কাস্টমাইজেশনেও বিদেশীর তুলনায় দেশীয় সফটওয়্যারে খরচ কম। এক্ষেত্রে সরকার উদ্যোগী হলে ব্যাংকিং খাত পুরোটাই দেশীয় সফটওয়্যারের আওতায় আসতে পারে। এজন্য দেশীয় কোম্পানিকে সহজ শর্তে ঋণ, সরকারী ব্যাংকে দেশীয় সফটওয়্যার ব্যবহারে নীতিমালা প্রণয়নের পাশাপাশি বিদেশী সফটওয়্যারে বর্ধিত কর আরোপের পরামর্শ দেন তিনি। সফটওয়্যার খাতে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশী কোম্পানির সাফল্য তুলে ধরতে গিয়ে বেসিসের সদ্য বিদায়ী সভাপতি শামীম আহসান বলেন, বাংলাদেশের সফটওয়্যার কোম্পানি বিশ্বজুড়ে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গ সংস্থায় কাজের অভিজ্ঞতাপুষ্ট বাংলাদেশী আইটি কোম্পানি দোহাটেক নিউমিডিয়া বর্তমানে ভুটানে ই-জিপি বাস্তবায়নে সফটওয়্যারসহ কারিগরি সেবা দিচ্ছে। নেপালে যানবাহন নিবন্ধন ডিজিটালাইজেশনের কাজ করছে বাংলাদেশী কোম্পানি টাইগার আইটি। ভিওআইপি সফটওয়্যারে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ কোম্পানি বাংলাদেশের রিভ সিস্টেমস। কোম্পানিটির যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ ৯টি দেশে আঞ্চলিক অফিস রয়েছে। এসব অফিসের মাধ্যমে ৮০টি দেশে সফটওয়্যার বিক্রি করছে প্রতিষ্ঠানটি। জাপানে নিজস্ব অফিস চালু করেছে ডাটাসফট সিস্টেমস বাংলাদেশ লিমিটেড। সরকারী টেন্ডার কার্যক্রম ডিজিটালাইজেশন কার্যক্রম বাস্তবায়নকারী দোহাটেক নিউ মিডিয়ার চেয়ারম্যান লুনা সামসুদ্দোহা বলেন, দাতাগোষ্ঠীর চাপসহ নানা কারণে সরকারের ডিজিটালাইজেশন কার্যক্রমে অনেক ক্ষেত্রে বিদেশী কোম্পানি কাজ পেয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে দেশী কোম্পানি কাজ পেলে সরকারের ব্যয় কম হতো। একই সঙ্গে টাকাটাও দেশেই থাকত। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মোস্তাফা জব্বার বলেন, সফটওয়্যার খাতে রফতানি আয় বাড়লেও স্থানীয় বাজার থেকে আয় কমেছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বেসিস সদস্য কোম্পানি দেশ থেকে ৮০ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে। অথচ গত অর্থবছরে তা ২৭ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। সফটওয়্যার খাতে স্থানীয় কোম্পানির দেশীয় বাজারের আয় বৃদ্ধিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরী হয়ে পড়েছে। শামীম আহসান বলেন, বাংলাদেশে সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর সেবা তৈরিতে তুলনামূলক খরচ কম। বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশী সফটওয়্যারের প্রতি আগ্রহী হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হাজার কোটি টাকার কাজ নিয়ে যাচ্ছে বিদেশী কোম্পানি। বিদেশী অর্থায়নে সরকারী আইসিটি প্রকিউরমেন্টে দাতা সংস্থাগুলো কঠিন শর্ত জুড়ে দিচ্ছে। এজন্য অনেক কাজে দেশীয় যোগ্য কোম্পানি অংশগ্রহণেরই সুযোগ পাচ্ছে না। অথচ সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের অনেক দেশেই পাবলিক প্রকিউরমেন্টের ন্যূনতম ৫০ শতাংশ দেশী কোম্পানিকে দিয়ে করাতে হয়। এ মর্মে সেখানে নীতিমালা রয়েছে। দেশীয় আইটি প্রতিষ্ঠানকে অগ্রাধিকার দিয়ে নতুন আইন ও নীতিমালা প্রণয়নের দাবি জানান তিনি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে তিনিও চান দেশীয় কোম্পানি অগ্রাধিকার পাক। এজন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু করতে সরকার প্রস্তুত রয়েছে। তিনি জানান, ২০১৮ সাল নাগাদ সফটওয়্যার ও সফটওয়্যারনির্ভর সেবা খাত থেকে এক বিলিয়ন ডলার আয় করতে চায় বাংলাদেশ। এজন্য সফটওয়্যার পার্ক তৈরিতে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। দেশজুড়ে ১২টি সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক নির্মাণাধীন। রাজধানীর কাওরান বাজারে জনতা সফটওয়্যার পার্কে ১৭টি কোম্পানি ইতোমধ্যে ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করেছে। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি থেকে আগামী বছরই পণ্য ও সেবা উৎপাদন এবং ডেভেলপের কাজ শুরু হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। যশোরে শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে আগ্রহী কোম্পানিগুলোকে এরই মধ্যে জায়গা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এছাড়া মহাখালী আইটি ভিলেজ, বরেন্দ্র সিলিকন সিটি রাজশাহী, ইলেকট্রনিক সিটি সিলেট, চন্দ্রদীপ ক্লাউড চর নির্মাণাধীন। তিনি আরও বলেন, বেসরকারী খাতের সাতটি প্রতিষ্ঠানকে সফটওয়্যার পার্ক হিসেবে ঘোষণা দিয়ে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে। সম্ভাবনাময় এ খাতে দক্ষ জনবল তৈরিতে এক লাখ তরুণ-তরুণীকে আইসিটি বিভাগের বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। যঃঃঢ়://নধহমষধ.ংধসধশধষ.হবঃ/২০১৬/০৯/০২/২৩৪৮০৩ অবকাঠামো : অন্যদিকে সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ হলো, বেসরকারী খাত বা সরকার কেউই অবকাঠামোর কথা মোটেই ভাবে না। সেই ৯৭ সালে বরাদ্দ দেয়া কালিয়াকৈরের হাইটেক পার্ক এখনও চালু হয়নি। ২০১৭ সালে সেটি চালু হতে পারে বলে এক ধরনের আশাবাদ তৈরি হয়েছে। একটি হাইটেক পার্ক চালু করতে যাদের ২০ বছর লাগে তারা কি বিলিয়ন ডলরের স্বপ্ন দেখতে পারে? মহাখালী আইটি ভিলেজের কথা তো ভুলেই থাকলাম। তবে এরই মাঝে যশোরের হাইটেক পার্ক চালু হয়েছে। চালু হয়েছে জনতা টাওয়ার। বিনামূল্যে প্রশিক্ষণও ব্যাপকভাবেই শুরু হয়েছে। এলআইসিটি ও হাইটেক পার্ক ছাড়াও বেসিসের নিজস্ব প্রশিক্ষণ রয়েছে। তবে সকল ক্ষেত্রেই বড় সঙ্কটটির নাম কর্মসংস্থান। এর আগে লার্নিং এ্যান্ড আর্নিং প্রকল্প থেকে কর্মসংস্থান বস্তুত করাই যায়নি। কেউ কি অনুগ্রহ করে এটি অনুভব করবেন যে, অভ্যন্তরীণ বাজার তৈরি না হলে কর্মসংস্থান তৈরি হবে না? প্রশিক্ষণের পর যে চাকরি পাওয়া যায় না তার কারণ অভ্যন্তরীণ বাজার সম্প্রসারিত হয়নি। অবকাঠামোর কথা বললে আরও একটি বিশাল বিষয়ের কথা বলতে হবে। সেটির নাম ইন্টারনেট ব্যান্ডউইদথ। সারাদেশে দ্রুতগতির ইন্টারনেট ব্যান্ডউইদথ নেই। থ্রিজি বস্তুত এক ধরনের প্রতারণায় পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে সরকার ব্যান্ডউইদথের দাম কমালেও গ্রাহক পর্যায়ে এটি গলাকাটা। বিটিআরসি এক্ষেত্রে কোন মনোযোগই দেয়নি। একই সঙ্গে ৪জি ও কেবল ইন্টারনেটের দিকে নজর দিতে হবে। দেশের সকল প্রান্তে ইন্টারনেট না পৌঁছে বিলিয়ন ডলারের বাজারের কথা ভাবাটাই সঠিক নয়। এক্ষেত্রে একটি কথা সবিনয়ে বলা দরকার, সেটি অর্থ বিনিয়োগ। বস্তুত তথ্যপ্রযুক্তিতে এলসি করার ক্ষেত্র ছাড়া কোন বিনিয়োগ নেই। মেধাস্বত্বের মূল্যায়ন নেই। আইসিবির ইইএফ ফান্ডসহ কোন তহবিলই এই খাতের তেমন কোন কাজে লাগে না। একটু ভেবে দেখুন পোশাক শিল্পে বিনিয়োগ কত। এই খাতে বস্তুত গ্যারেজ কোম্পানি জন্ম নিচ্ছে। বিলিয়ন পার করেছি : যদিও বিশ্বাস করবেন না তবুও আমার কাছে আসা তথ্য অনুসারে আমরা রফতানি আয়ে বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছি। বেসিস অফিস আমাকে চমকে দিয়েছে। ওদের হিসাব অনুসারে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বেসিসের ২৭৭ সদস্য বিদেশ থেকে আয় করেছে ১৬৮.৬৫ মিলিয়ন ডলার (১৩২০,৯৭,৬৫,৩৪০ টাকা)। এই সময়ে তারা দেশের বাজারে আয় করেছে ৮০.৮২ মিলিয়ন ডলার (৬৩৩, ০২, ৭৬,৪৭০ টাকা)। পরের অর্থবছরে ৩৮২টি কোম্পানির হিসাবে বিদেশ থেকে আয় হয়েছে ৫৯৪.৭৩ মিলিয়ন ডলার (৪৬৫৮,৩১,৩৬,৮৩৭ টাকা)। অথচ দেশের আয় কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২৭.২৪ মিলিয়ন ডলারে (২১৩,৩৭২৮,৬৯৬ টাকা)। এর মানে এক বছরে বিদেশের আয় বেড়েছে ৩ গুণ আর দেশের আয় কমে হয়েছে এক-তৃতীয়াংশ। আমি যদি আমার হাতের তথ্যটাকে পুরো দেশের তথ্যে দ্বিগুণ হিসেবে রূপান্তর করি তবে রফতানি আয় প্রায় ১.২ বিলিয়ন ডলার হবে। দ্বিগুণ করার কারণটাও বলতে চাই। আমার বেসিসের সদস্য সংখ্যা হাজারের ওপরে। বেসিসের সদস্য নয় এমন প্রতিষ্ঠানও হাজারের ওপরে। আমি কেবল ৩৮২ প্রতিষ্ঠানের হিসাব পেয়েছি। অথচ আমার প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২ হাজার। এটি যদি আমি সামনের দিকে প্রবাহিত করি তবে আমার গতি আরও বাড়বে এবং সেজন্য আমি ২১ সালে ৫ বিলিয়ন ডলার আয়ের স্বপ্ন দেখতেই পারি। আমরা যখন এমন হিসাব করছি তখন গত ১ সেপ্টেম্বর ফেসবুকে আমরা তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমদ পলককে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে জানাতে দেখলাম যে, সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে আমরা ১ বিলিয়ন ডলরের সফটওয়্যার ও সেবা রফতানি করেছি। যারা পোশাক শিল্পের সঙ্গে আমাদের বিনিয়োগটাকে তুলনা করেন তাদের জন্য বলছি। আমরা যদি ৫ বিলিয়ন ডলার কামাই করি তবে সেটি পোশাক শিল্পের ৫০ বিলিয়নের সমান। কারণ আমাদের মূল্য সংযোজন শতভাগ আর পোশাকের ১০ ভাগ। কিন্তু পাশাপাশি এটিও ভাবতে হচ্ছে অভ্যন্তরীণ বাজার আমার কাছ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ সরকার ডিজিটালে রূপান্তরের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছে। সরকার ডিজিটাল হচ্ছে। কিন্তু আমার নিজের দেশের প্রতিষ্ঠানের কাজ কমছে। বিদেশীরা আমি যা রফতানি করি তার চাইতে বেশি টাকা বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাচ্ছে। তারা কেবল আমার মুখের ভাত কেড়ে নিচ্ছে না, তারা আমার দেশের বেকারত্ব বাড়াচ্ছে। আমি নীতিনির্ধারকদের কাছে অনুরোধ করব তারা যেন আমাদের নিজের কাজ নিজেরা করতে পারি তার আয়োজন করেন। রফতানির বিষয়টি তারা আমাদের ওপর ছেড়ে দিলেই পারেন।
×