ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দেশী আর অতিথি গরুতে বাজার সরগরম

প্রকাশিত: ০৬:০২, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৬

দেশী আর অতিথি গরুতে বাজার সরগরম

সমুদ্র হক ॥ দেশী গরু আছে, অতিথি গরু আছে। ক্রেতা আছে- ক্রেতা নেই। এবারের কোরবানির হাটের দৃশ্য এমনই। হাট বোঝাই গরু। তারচেয়ে কয়েক গুণ বেশি মানুষ। গরু আর মানুষে একাকার। এক গরুর সঙ্গে অন্তত তিন জন মানুষ, মালিক, বেপারি ও দালাল। কখনও দালালের সংখ্যা বেড়ে কয়েকজন। গরুর ওপর চাপাবাজ দালালের ধারা বর্ণনা। কান ঝালাপালা। গরুর ওজন কত, কয়টি দাঁত, কয় মণ গোশত্ হবে ইত্যাদি মুখস্থ। দাম গগনচুম্বি, কখনও তারও ওপরে। মনে হবে দাম শুনে গরু হাসে, হাম্বা ডাকে। আম পাবলিক লাফিয়ে ওঠে। মাথায় হাত দিয়ে বসে। উচ্চ বিত্তের ক্রেতারা উঁচু লম্বা নাদুস নুদুস গরু খোঁজে। এমন ক্রেতা দালালের দৃষ্টিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই গরুর লেজের সঙ্গে দালালের লেজ জুড়ে যায়। অন্য ক্রেতা সরিয়ে দিয়ে গরুর ফ্যাশন শো শুরু হয়। গলায় মালা শিংয়ে জরি দিয়ে সাজানো গরু ইতি উতি তাকিয়ে পরখ করে নেয়। দুষ্টু গরু সুযোগ খোঁজে কিভাবে শিংয়ের গুঁতো দেয়া যায়। কোন গরু এই ভিড়ের মধ্যেই বড় টয়লেট ছোট টয়লেট সেরে নেয়। কখনও গো মূত্র ও গোবর গিয়ে পড়ে ক্রেতার গায়ে। গরুর হাটে গিয়েছে অথচ পায়ে গোবর দলেনি বা শিংয়ের গুঁতো খায়নি এমন হাটুরে কম। হাট বেলার শুরু থেকে মধ্য বেলা পর্যন্ত দাম উঠতেই থাকে। তারপর দামের ব্যারোমিটার নামে। ক্রেতাদের অনেকেই এই সুযোগটি খুঁজে নেয়। মাইকে কোরবানির হাটের প্রচার চলে শহরে ও শহরতলিতে। হাটে যত বড় গরু ছাগল উঠুক প্রচারকারী বলে এই ভাবে “বিরাট গরু ছাগলের হাট...”। মনে হবে ওই হাটে বিরাট গরু ছাগল ওঠে। গরু ছাগলের বিরাট হাট উল্টে দিয়ে এই অবস্থা। হাটে বেপারি, খামারীদের থাকা খাওয়ার সু-ব্যবস্থা থাকে। এবারের কোরবানির হাটে গরুর দাম নিত্যদিনই ওঠানামা করছে। অনেকের ধারণা শেষের বেলায় দাম কমবে। যে কারণে হাটে যত ক্রেতা যায় তার তিন ভাগের এক ভাগ গরু কেনে। বাকিরা ফিরে যায়। পথ নেয় আবার কোন হাটের দিকে। গরু পরখ করার এই পালা শেষ হয় ঈদের আগের দিনের হাটে। যিনি গরু কেনেন তাকে দাম মুখস্থ রাখতে হয়। জনে জনে দাম জানার কৌতূহলে ক্রেতার মুখে ওঠে ফেনা। যারা গরু কেনেননি তারা গতবারের দামের সঙ্গে এবারের দাম মিলিয়ে দেখেন। হিসাব কষেন কতটা বেড়েছে কমেছে। বগুড়া অঞ্চলে এবারের হাটগুলোতে খামারীদের গরু বেশি আসছে। গ্রামে গরু পালন বেড়েছে। কোরবানির ঈদের মাস ছয়েক আগে গ্রামের সচ্ছল কৃষক বাড়তি রোজগারে গরু পালন করে। মেঘাগাছা ও চককাতুলি গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই এক থেকে দশটি করে গরু লালন পালন হয়েছে। বাড়িগুলো ডেইরি ফার্ম নয়, তবু মনে হবে মিনি ডেইরি। গরু রাখার ও পালনের সকল সুযোগ আছে। কোন বাড়িতে গরুর ঘরে ইলেকট্রিক ফ্যান আছে। কয়েক মাস পালনে গরু হৃষ্টপুষ্ট করে হাটে তোলা হয়। গরু পালনকারী কৃষক মনসুর আলী বললেন, এ বছরের শুরুতে দুটি গরু কিনেছিলেন ৭৮ হাজার টাকায়। পালন করার পর দু’টি গরু বিক্রি করেছেন ১ লাখ ৩১ হাজার টাকায়। এভাবে গ্রামের অনেক গৃহস্ত ও সচ্ছল কৃষক গরু পালনে লাভবান হয়েছেন। জেলা প্রাণী সম্পদ বিভাগ জানায়, বগুড়া অঞ্চলে দিনে দিনে গরুর খামারের সংখ্যা বাড়ছে। গত বছর গরুর খামার ছিল ২৬ হাজার ৩৮টি। সেখানে গরু ছিল ১ লাখ ৬২ হাজার ৮শ’ ৮৭টি। এ বছর গরুর খামার বেড়ে হয়েছে ২৭ হাজার ৪শ’ ৫১টি। সেখানে গরু পালন হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার। এই গরুর বড় অংশটিই এবারের কোরবানির হাটে উঠেছে। এবারের কোরবানির হাটে দেশী গরুর চাহিদা বেশি। অতিথি গরু বা ভারতীয় গরুর আধিক্য কম। তবে বেপারিরা বলছেন, ওপার থেকে যে অতিথি গরু আসছে তার সিংহভাগই চলে যাচ্ছে ঢাকা ও চট্টগ্রামের দিকে। উত্তরাঞ্চলের ক্রেতারা দেশী গরু বেশি কিনছেন। মোটামুটি মাঝারি সাইজের গরুর দাম ৫৮ থেকে ৬৫ হাজার টাকা। বড় গরুর দাম এক থেকে দেড় লাখ টাকা। কখনও তারও বেশি। ষাড় আকৃতির বড় গরুর দাম হাঁকা হয় ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা। তবে এই দামে কখনই গরু বিক্রি হয় না। এক বড় হাটের ইজারাদার বললেন, হাটের প্রচারের জন্য বড় গরু উঠলে সেই গরুর দাম আকাশচুম্বি হাঁকিয়ে হাটের একটা প্রচার করা হয়। উত্তরাঞ্চলে গরুর অন্যতম বড় হাট বগুড়ার মহাস্থানগড়। প্রতিবারই সেখানে দেশী গরুর পাশাপাশি অতিথি গরু ওঠে। তবে এবার এই হাটে অতিথি গরু বা ভারতীয় গরুর আমদানি কম। খোঁজ খবর করে জানা যায়, সীমান্ত গলিয়ে যে গরু আসছে তা সীমান্ত থেকেই ট্রাকে লোড হয়ে যাচ্ছে ঢাকার দিকে। ঢাকার গাবতলি হাটের মহাজন শফিকুল ইসলাম বললেন, রাজধানীতে শেষের বেলা হাট জমে ওঠে। কখনও এই দাম পড়ে যায় কখনও লাফিয়ে ওঠে। এবার কি হবে বলা যাচ্ছে না। তবে প্রতিটি হাটেই এবার গরু আমদানি বেশি। গরুর কোন ঘাটতি নেই। সাধারণ ক্রেতাদের কথা বহু অঙ্কের টাকায় যারা গরু কিনছেন তারা গরু না টাকা কোরবানি দিচ্ছেন ! কোরবানির ঈদে মানুষের টাকা আর গরু একাকার...।
×