ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জলির আত্মহত্যার ‘চিরকুট’ মানতে চাইছে না কেউ

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৬

জলির আত্মহত্যার ‘চিরকুট’ মানতে চাইছে না কেউ

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ সব ধরনের নিপীড়নের বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার ছিলেন আকতার জাহান জলি। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ সেলের সদস্য ছিলেন তিনি। অথচ ‘মানসিক ও শারীরিক’ চাপের কারণ দেখিয়ে তিনিই চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তার এ চলে যাওয়া মেনে নিতে পারেননি রাবির শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও বন্ধুরা। আকতার জাহান জলির মৃত্যুর কারণ হিসেবে প্রাথমিকভাবে বিষক্রিয়ার প্রমাণ মিলেছে। শনিবার ময়নাতদন্ত শেষে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে এ তথ্য জানিয়েছেন ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ডাঃ এনামুল হক। তবে আত্মহত্যার বিষয়টি ভিসেরা রিপোর্টে নিশ্চিত হওয়া যাবে। বিকেলে রাবি কেন্দ্রীয় মসজিদে তার প্রথম জানাজা হয়েছে। এ ঘটনায় বিকেলে মতিহার থানায় আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ এনে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। জলির ভাই কামরুল হাসান রতন বাদী হয়ে এ মামলা দায়ের করেন। তবে মামলায় কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি। শনিবার ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখা যায় ঈদের ছুটিতে এখন প্রায় ছাত্রশূন্য। প্রিয় শিক্ষকের মৃত্যুতে অনেকে আবার ক্যাম্পাসে এসেছেন। সবাই শোকে মুহ্যমান। তার এমন মৃত্যু কেউ বিশ^াস করতে পারছেন না। সবার মুখ থেকে একই কথা বেরিয়ে আসছে, ম্যাডাম এভাবে চলে যেতে পারেন না। তার সুইসাইড নোটে মানসিক চাপের বিষয় নিয়েও ভাবছেন অনেকে। চাপটা কী ছিল সেটা নিয়েও কথা উঠেছে। তার যন্ত্রণা ও চাপের পেছনে কার অদৃশ্য ইশারা সেটা নিয়েও কথা উঠছে। মূলত তার সাবেক স্বামী একই বিভাগের শিক্ষক তানভীর আহমদের দিকেই আঙ্গুল তুলছেন অনেকে। স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়াকেই তার আত্মহত্যার কারণ বলে মনে করছেন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। বেশিরভাগ শিক্ষক ও শিক্ষার্থী জলির আত্মহত্যার পেছনে পরোক্ষভাবে দায়ী করেছেন তানভীর আহমদকেই। বিয়ে বিচ্ছেদের পর তানভীর তাকে উত্ত্যক্ত করতেন কি-না এ বিষয়ে স্পষ্ট কিছু খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকেই ধারণা করছেন, কোন না কোনভাবে তার মাধ্যমেই নিগৃহীত হতেন আকতার জাহান। এসব কারণে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হন তিনি। নারী নেত্রী এ্যাডভোকেট দিল সেতারা চুনি বলেন, শেষদিন পর্যন্ত রাবির যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ সেলের সদস্য ছিলেন তিনি। সব সময় সোচ্চার ছিলেন। নিজে এবং সবাইকে নিয়ে যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে কাজ করেছেন। জুলাই মাসেও জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি আয়োজিত এক কর্মশালায় উপস্থিত ছিলেন তিনি। তার ‘সুইসাইড নোটে’ও পরোক্ষভাবে উঠে এসেছে সাংসারিক জীবনের নিপীড়নের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে ১৯৯৭ সালে শিক্ষক হিসেবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন আকতার জাহান জলি। চাকরিতে যোগ দেয়ার আগেই তার বিয়ে হয় তানভীর আহমদের সঙ্গে। বর্তমানে তিনিও একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। সহকর্মীরা জানান, তানভীরের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হলে ২০১২ সালে জুবেরী ভবনের ৩০৩ নম্বর কক্ষে ওঠেন তিনি। স্কুলপড়ুয়া ছেলে তখন বাবার সঙ্গে থাকলেও মাঝে মাঝে মায়ের কাছে আসত। গত বছরের শেষদিকে তানভীর আবার বিয়ে করেন। এর পর চলতি বছরের শুরুতে ছেলেকে ঢাকায় তার নানার বাড়িতে পাঠিয়ে দেন আকতার জাহান। বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ঈদের ছুটি শুরু হয়ে যাওয়ায় সহকর্মীদের ধারণা ছিল আকতার জাহান ঢাকায় তার বাবার বাড়িতে গেছেন। কিন্তু তার ছেলে শুক্রবার কয়েক শিক্ষককে ফোন করে জানায়, বুধবার সন্ধ্যার পর সে তার মাকে ফোনে পাচ্ছে না। এর পর শিক্ষকরাও ফোন করে না পেয়ে বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জানায়। পরে তার ঘর থেকেই লাশ উদ্ধার হয়। একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও গণসংযোগ বিভাগের প্রশাসক মশিহুর বলেন, জুবেরী ভবনে গিয়ে ঘরের দরজায় নক করে সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আর পুলিশ এসে দরজা ভেঙ্গে তাকে ওই কক্ষ থেকে অচেতন অবস্থায় বের করা হয়। আরেক সহযোগী অধ্যাপক আঃ আল মামুন বলেন, মাঝেমধ্যেই প্রচ- ‘ব্যাক পেনে’ ভুগতেন আকতার জাহান। তাছাড়া ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও সমস্যায় ছিলেন। এসব কারণে তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারেন। রাবি প্রশাসনের শোক ॥ অধ্যাপক আকতার জাহান জলির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর মুহম্মদ মিজানউদ্দিন ও উপ-উপাচার্য প্রফেসর চৌধুরী সারওয়ার জাহান। বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দফতরের প্রশাসক মশিহুর স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য নিশ্চিত করেন। ফেসবুকে শোকের বার্তা, নানা প্রতিক্রিয়া ॥ প্রিয় শিক্ষক ও সহকর্মীকে হারিয়ে অনেকে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। শোকে পাথর হয়ে পড়েছে বিশ^বিদ্যালয় পরিবার। তার মৃত্যু নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে শুরু হয়েছে শোকগাথা। নানা মন্তব্য, নানা কথা উঠে আসছে তার আত্মহত্যা নিয়ে। এর পেছনের রহস্য উদ্ঘাটনের দাবিও জানিয়েছেন কেউ কেউ। শিক্ষার্থীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে থেকে ফেসবুকের ওয়াল ভরছেন মতিহারকে ঘিরে। ফেসবুকে তাদের লেখা বলছে, তারা শোকাহত, তারা মর্মাহত, তারা নির্বাক, তাদের হৃদয় যেন বেদনায় লীন। সুইসাইড নোটে তিনি তার সাবেক স্বামীর প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেছেন এমন ঈঙ্গিত থেকেও অনেকে শিক্ষক তানভীরের দিকেই আঙ্গুল তুলছেন। প্ররোচনার নেপথ্যে সন্দেহ ॥ অধ্যাপক আকতার জাহান জলির মৃত্যুতে সাবেক স্বামী ও বিভাগের শিক্ষক তানভীর আহমদের বিরুদ্ধে প্ররোচনার ঈঙ্গিত করছেন অনেকেই। বিভাগের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা এমন অভিযোগ তুলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদের দাবি, তানভীর বিভিন্ন সময় জলিকে মুঠোফোনে হুমকি দিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করতেন। সুইসাইড নোটে এ ধরনের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষক হিসেবে পরিচিত আকতার জাহান ছিলেন শান্ত স্বভাবের। সব সময় সবার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলতেন। শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত সমস্যা জানার চেষ্টা করতেন। কয়েক শিক্ষার্থী জানান, ম্যাম ছিলেন মায়ের মতো। তানভীর স্যারের সঙ্গে ডিভোর্স হওয়ার পর ম্যাম খুবই নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করতেন। ম্যামের একাডেমিক কাজে স্যার যে কোনভাবে বাধা সৃষ্টি করতেন। মুঠোফোনে, মেসেজে বিভিন্নভাবে তাকে হুমকি-ধমকি দিতেন। ম্যাম বলতেন, ‘ওরা আমাকে শান্তিতে থাকতে দেবে না। আমি যতই নিরিবিলি থাকতে চাই, ওরা ততই ঝামেলার সৃষ্টি করে। আমার ছেলে ক্লাস টেনে উঠলে ওর বাবার দেয়া মেসেজ দেখাব। জানতে চাইব, কোন মানুষ মানুষকে এমন মেসেজ দিতে পারে? তখন আমার ছেলেই ওর বাবার বিচার করবে।’ শিক্ষার্থীরা আরও বলেন, সর্বশেষ বিভাগের চতুর্থ বর্ষের খাতা দেখা নিয়ে ম্যাম খুব ঝামেলায় ছিলেন। তিনি শারীরিকভাবে প্রচ- অসুস্থ ছিলেন। ম্যাম বলছিলেন, ‘ইচ্ছা করে আমাকে হ্যারাস করার জন্য ওরা খাতায় ভুল করে দিয়েছে। খুব সহজ একটা কাজ এভাবে কঠিন করে দিয়েছে আমাকে বিপদে ফেলার জন্য। আমাকে অসুস্থ শরীর নিয়ে প্রতিদিন প্রশাসন ভবনে দৌড়াতে হচ্ছে। আর ওরা দেখে আনন্দ উপভোগ করছে।’ এসব বিষয়ে তানভীর আহমেদ বলেন, ‘আমরা দুজন মানুষ জেনে-বুঝে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে আলাদা হয়ে গেছি। আমি তাকে ধরে রাখিনি।’ মেসেজে হুমকির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি মেসেজ দিয়ে থাকলে আইনী বিচার হবে। আমি তা মেনেও নেব।’ ছেলের গলায় ছুরি ধরার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সবার কাছে শুনলেই বুঝতে পারবেন আমার সঙ্গে সোয়াদের সম্পর্ক কেমন। সুতরাং এটা বাস্তবসম্মত নয়।’ ময়নাতদন্ত সম্পন্ন, বিষক্রিয়ার আলামত ॥ অধ্যাপক আকতার জাহানের মৃতদেহ ময়নাতদন্তের রিপোর্টের পর বিষক্রিয়ায় মৃত্যুর কথা জানালেন ডাক্তার। শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ময়নাতদন্তের পর সাংবাদিকদের এ কথা বলেন রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ডাক্তার এনামুল। তিনি বলেন, সুরতহাল এবং ময়নাতদন্তের রিপোর্টে স্পষ্ট যে, বিষক্রিয়ার কারণে মৃত্যু ঘটেছে। তবে ভিসেরা রিপোর্টের জন্য একটু অপেক্ষা করা লাগবে। শনিবার বিকেল সাড়ে তিনটায় রাবি কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে জানাজা হয়েছে। আরএমপির উপ-কমিশনার আমীর জাফর জানান, তার লাশের সুরতহাল করা হয়েছে। সুরতহাল প্রতিবেদনে শরীরে কোন আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। প্রাথমিকভাবে আমরা ধারণা করছি তিনি আত্মহত্যা করেছেন। পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ দিলে সে অনুযায়ী তদন্ত করে পুলিশ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। পরিবারকে দেয়া হলো জলির লাশ ॥ সুইসাইড নোটে আকতার জাহান তার লাশ রামেক হাসপাতালে দেয়ার অনুরোধ করে গেলেও শেষ পর্যন্ত ময়নাতদন্ত শেষে লাশ তার পরিবার ও রাবির শিক্ষকদের কাছে তুলে দেয়া হয়েছে। দুপু দুটোর দিকে রামেক হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে আকতার জাহানের ছোট ভাই কামরুল হাসান রতনের কাছে লাশ হস্তান্তর করে। মামলা করা হবে কি-না এ বিষয়ে কামরুল হাসান রতন বলেন, আমরা এখনও ময়নাতদন্ত রিপোর্ট হাতে পায়নি। হাতে পেলে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। প্রসঙ্গত, শুক্রবার বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে বিছানার ওপর মশারির ভেতর পড়ে থাকা অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবেরী ভবনের ৩০৩ নম্বর কক্ষ থেকে পুলিশ শিক্ষিকা আকতার জাহান জলির লাশ উদ্ধার করে।
×