ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আজ পবিত্র হজ

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৬

আজ পবিত্র হজ

আজাদ সুলায়মান ॥ আজ (রবিবার) পবিত্র হজ। লাখ লাখ হজযাত্রী আজ মীনা থেকে আরাফাতের ময়দানে যাবেন। মীনায় ফজরের নামাজ আদায় করেই লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক-ধ্বনিতে হজযাত্রীরা আরাফাতের ময়দানে গিয়ে নিজ নিজ খিমায় আশ্রয় নেবেন। এখানেই দিন ভর এবাদত বন্দেগীতে মশগুল থাকবেন তারা। আল্লাহর অশেষ রহমতের ময়দান আরাফাতে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করার নামই হজ। এর আগে-পরে অন্য আনুষঙ্গিক কাজ করার মাধ্যমে হজের পরিপূর্ণতা দেয়া হয়। গতকাল (শনিবার) মিনার মাঠে দিনভর ইবাদত বন্দেগীতে মশগুল ছিলেন সব হজযাত্রী। এ সম্পর্কে মীনার মাঠ থেকে হজ অফিস পরিচালক ডক্টর আবু সালেহ মোস্তফা কামাল জনকণ্ঠকে বলেন, এবার কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে হজ পালনের সুব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। রবিবার বাদ ফজর হজ যাত্রীরা আরাফাতের ময়দানে গিয়ে সমবেত হবেন। তাদের বহন করার জন্য রয়েছে বিশেষ ট্রেন সার্ভিস। রয়েছে বাসেরও ব্যবস্থা। মীনা থেকে আরাফাতের দূরত্ব বেশি না হওয়ায় অনেকে হেঁটেও রওনা হবেন। তবে বাংলাদেশী হজযাত্রীদের বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করে দেয়া হয়েছে। কিছু হজযাত্রী ভিড় এড়াতে মসজিদে নামিরাহর কাছে অবস্থান করার জন্য ফজরের নামাজের আগেই রাত তিনটার দিকে মীনার মাঠ থেকে আরাফাতের উদ্দেশে রওনা হবেন। আরাফাতের অবস্থান সম্পর্কে হাদিস শরীফে বলা আছে, হজের মোট ফরজ কাজ হচ্ছে ৩টি। ইহরাম বাঁধা, ৯ জিলহজ নির্দিষ্ট সময়ে উকুফে আরাফায় অবস্থান করা ও কাবাঘর তাওয়াফ করা। শনিবার মীনায় ছিল প্রায় বিশ লাখ হজযাত্রীর মিলনমেলা। এ বছর সারাবিশ্ব থেকে ১৫ লাখ হজযাত্রী এবং সৌদি আরবের নিজস্ব আরও প্রায় ২ লাখ হজযাত্রী হজ আদায় করবেন। তারা সবাই মীনার মাঠে শনিবার এবাদত বন্দেগীতে ব্যস্ত ছিলেন। লাখ লাখ হজযাত্রী সাদা তাঁবুতে সবাই পাশাপাশি অবস্থান করেন। ইসলামী শরিয়াহ মোতাবেক হজের প্রধান রুকন উকুফে আরাফায় অবস্থান করাটা ফরজ। তাই আজ মীনার মাঠ থেকে ফজরের নামাজের পর পরই হজযাত্রীরা আল্লাহর নৈকট্য লাভ ও তামাম জিন্দেগীর গুনাহ মাফ করার একান্ত বাসনা নিয়ে রওনা দেবেন আরাফাত অভিমুখে। এখানে জোহরের ওয়াক্ত থেকে শুরু হবে উকুফের সময়। এদিন জোহরের ওয়াক্ত থেকে সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যে যে ব্যক্তি আরাফায় উপস্থিত হবেন- তার জন্য সূর্যাস্ত পর্যন্ত উকুফ করা ওয়াজিব। কেউ সূর্যাস্তের পূর্বে পৌঁছতে না পারলে- আগত রাতের সুবেহ সাদিক পর্যন্ত সময়ের মধ্যে জ্ঞাত ও অজ্ঞাতসারে কিছুক্ষণ অবস্থান করলেও উকুফের ফরজ আদায় হয়ে যাবে। হাদিস মোতাবেক আরাফায় পৌঁছে উকুফের আগে গোসল করা সুন্নত। অনেকে গোসল না করে শুধু অজু করেই সামান্য খাবার খেয়ে নামাজের প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন। আরাফাতের মাঠে আজকের করণীয় হচ্ছে-আরাফার কেন্দ্রবিন্দু মসজিদে নামিরার জামায়াতে অংশগ্রহণ করা। ইমামের পেছনে এক সঙ্গে একই আজানে জোহর ও আছর আদায় করতে হয়। কিন্তু মসজিদে নামিরায় জায়গা সঙ্কুলান না হওয়ায় নিজ নিজ খিমায় বা তাঁবুতে জোহর ও আছর আলাদা পড়ার নিয়ম। তবে এ নিয়ে মতবিরোধও রয়েছে। নিজের তাঁবুতে যদি কেউ মসজিদে নামিরার জামায়াতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জোহর ও আছর একত্রে পড়তে চান, সেটাও সহীহ হয়ে যায়। এ নিয়ে বিবাদে না জড়ানোই শ্রেয় বলে মনে করেন মসজিদে নামিরার খতিব। তবে আজ আরাফাতের ময়দানে কে হজের খুতবা দেবেন সেটা এখনও নিশ্চিত নয়। বিগত পঁয়ত্রিশ বছর ধরে মসজিদে নামিরাহ থেকে খুতবা পাঠ করে আসছিলেন সৌদির গ্র্যান্ড মুফতি আবদুল আজিজ আল আশেক।। তিনি এবার খুতবা পড়বেন না বলে শনিবার আরব নিউজের এক সংবাদে বলা হয়েছে। হাদিস অনুযায়ী উকুফে আরাফায় অন্যতম করণীয় হচ্ছে দোয়া-মোনাজাত করা। এখানে দোয়া কবুল হওয়ার ওয়াদা রয়েছে। তাই পূর্ণ এক্বিনের সঙ্গে দোয়া করতে হয়। উত্তম হচ্ছে কিবলামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে একেবারে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দোয়া করা। এত দীর্ঘ সময় দাঁড়ানো কঠিন হওয়ায় প্রয়োজনে বসে বিশ্রাম নিয়ে আবার দাঁড়িয়ে দোয়া শুরু করা যেতে পারে। হাদিসে রয়েছে-আরাফাতের ময়দানে সূর্যাস্ত পর্যন্ত থাকার পর একজন হজযাত্রীর আসল হজ হয়ে যায়। সূর্যাস্তের পর সবাই হাজী হিসেবে গণ্য হবেন। আরাফাত ময়দান থেকে সূর্যাস্তের পর মাগরিবের নামাজ না পড়েই মুজদালিফার দিকে সব হাজী রওনা হবেন। মুজদালিফার আমল ॥ আরাফাত থেকে এসে ৯ জিলহজ দিবাগত রাতে মুজদালিফায় অবস্থান করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা। এদিন মাগরিব ও এশার নামাজ এক আজান ও এক ইকামতে মুজদালিফায় একত্রে পড়তে হবে। তবে অতিশয় বৃদ্ধ, নিতান্ত দুর্বল কিংবা অধিক পীড়িত রোগীর জন্য মুজদালিফায় অবস্থান না করে আরাফা থেকে সোজা মীনায় চলে যাওয়ার অনুমতি আছে। এ রাতে ঘুমানো ও আরাম করাই প্রধান আমল। কেননা মুসলিম শরীফের এক হাদিসে আছে, রাসূল (স) এ রাতে এশা পড়ে শুয়ে গেছেন। যেন সুবেহ সাদিকের পর উকুফের সময় দোয়া ও জিকিরে মশগুল থাকা যায়। তবে বর্তমানে দেখা যায়, মুজদালিফায় হাজীরা সারারাতই বিছানায় সজাগ অবস্থায় শুয়ে থাকেন। এ ছাড়া এখান থেকেই সংগ্রহ করতে হয় কঙ্কর। এসব কঙ্কর মারতে হবে মীনার মাঠের জামারায়। মুজদালিফায় ফজর নামাজ শেষে আগামীকাল সোমবার দশই জিলহজ সব হাজী একত্রে রওনা দেবেন ফের মীনার মাঠে। এ দিন শুধু বড় শয়তানের ওপর কঙ্কর মারতে হয়। হজের ইহরাম বাঁধার পর থেকেই এ পর্যন্ত সবচেয়ে উত্তম জিকির তালবিয়া পড়া এখানেই শেষ করতে হয়। কঙ্কর বা পাথর মারার নিয়ম হচ্ছে ১০ জিলহজ সূর্যোদয়ের পর থেকে সূর্য ঢলে পড়া পর্যন্ত অর্থাৎ জোহরের সময়ের পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যে পাথর মারা উত্তম। তবে অসুস্থ ব্যক্তিরা সূর্যাস্ত পর্যন্ত পাথর মারতে পারেন। তাও সম্ভব না হলে অন্য কেউ বদলি পাথর মারাও জায়েজ আছে। পাথর মারার পর তামাত্তু ও কিরান হাজীদের জন্য কোরবানি দেয়া ওয়াজিব। মীনার মাঠেই কোরবানির সুবন্দোবস্ত রয়েছে। অবশ্য বাংলাদেশের হাজীরা সরকারী ও ব্যক্তিগতভাবে কোরবানি দিতে পারেন। কোরবানির পরই হাজীরা মাথা মু-ন করে হালাল হয়ে যান। এর পর আবার তাঁরা যাবেন মক্কা শরীফে। পবিত্র কাবাঘর তাওয়াফ করা ফরজ। তার পরের কাজটি সাফা মারওয়া সাতবার সায়ী করা ওয়াজিব। রাতে আবার হাজীরা ফিরে এসে মীনার মাঠে পর পর আরও ৩ দিন অবস্থান করে শয়তানকে পাথর মারার মধ্য দিয়ে শেষ করবেন ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ হজ। মীনার মাঠ থেকে হজ টিমের একজন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে জানান, বাংলাদেশের সব হজযাত্রীই ভাল আছেন। এ পর্যন্ত ৩৫ জন হজযাত্রীর স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছে। এ ছাড়া কোন সঙ্কট বা সমস্যা নেই। এবার প্রায় ১৫ লাখ হজ করার জন্য আরাফাতে জমায়েত হচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে ২ লাখ সৌদি আরবের বাসিন্দা। বাকিরা বহির্বিশ্বের। এবারও মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক হজযাত্রী এসেছেন ইন্দোনেশিয়া থেকে। তারপরের সংখ্যাটি বাংলাদেশের ১ লাখ ১ হাজার ৮৬৭ জন। রিয়াদ গ্রবাসী সাংবাদিক আবুল বশির জনকণ্ঠকে জানান, নজিরবিহীন নিরাপত্তার মাঝে এবার হজ ব্যবস্থাপনা সাজানো হয়েছে। সুষ্ঠুভাবে হজ পালনের সুুবিধার্থে সৌদি সরকার এক লাখ নিরাপত্তা কর্মী নিয়োগ দিয়েছে। এ ছাড়া আরও ৪০ হাজার স্পেশাল ফোর্স নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এরা হাজীদের নামাজ আদায় ও পথঘাট দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করবেন। এবার হজ মনিটরিংয়ে অত্যন্ত উচ্চ প্রযুক্তির ক্যামেরা ব্যবহার করা হচ্ছে। হাজীদের নিরাপত্তায় বসানো হয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার ক্যামেরা। এবার হজের খুতবা কে পড়াবেন তা এখনও জানা যায়নি। এদিকে মীনার মাঠ থেকে বাংলাদেশী অপর এক সাংবাদিক জনকণ্ঠকে বলেন, লাখো হাজীর মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে মীনার মাঠ। পবিত্র মসজিদুল হারাম থেকে আট কিলোমিটার দূরের মিনা এখন যেন তাঁবুর শহর। যেদিকে চোখ যায়, তাঁবু আর তাঁবু। তাঁবুতে প্রত্যেকের জন্য আলাদা ফোম, বালিশ, কম্বল বরাদ্দ। ফোমের নিচে বালু। মিনায় অবস্থান করা হজের অংশ। হজযাত্রীরা নিজ নিজ তাঁবুতে নামাজ আদায়সহ অন্যান্য ইবাদত করছেন। শনিবার দিনভর হজযাত্রীরা মিনায় অবস্থান করেন। এখানেই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন তারা । এবার মিনায় মোট সাতটি জোন রয়েছে। ২, ৫, ৬ নম্বর জোনে বাংলাদেশীদের তাঁবু। হাজীরা যাতে নির্বিঘেœ শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করতে পারেন, সে জন্য ওই জায়গা সম্প্রসারণ করা হয়। জামারায় প্রতি তলার দৈর্ঘ্য ৯৫০ মিটার আর প্রস্থ ৮০ মিটার। প্রতি ঘণ্টায় তিন লাখ হাজী পাথর নিক্ষেপ করতে পারবেন। এবার হাজীদের পাথর মারার নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে। মোয়াল্লেম নম্বর অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে পাথর মারতে হবে। নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করে ওই সাংবাদিক জানান, এবারও মীনার মাঠে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থাকেই বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। সেজন্য মিনার তাঁবুগুলোতে আগুন ধরার ঝুঁকি নেই। সবগুলো শীতাতপনিয়ন্ত্রিত তাঁবু। তাঁবুগুলো দেখতে একই রকম হওয়ায় অনেক হাজীর পক্ষে পথঘাট ঠিক রেখে নিজের তাঁবুতে যাতায়াত করা কঠিন হয়। এর জন্য এখানে আছে স্কাউট, হজগাইড। বাংলাদেশ হজ কার্যালয়ের পক্ষ থেকেও হজযাত্রীদের সহায়ক মিনার তাঁবু নম্বরসংবলিত মানচিত্র বিতরণ করা হচ্ছে। মিনায় ১৬/৫৬ নম্বর তাঁবু, অর্থাৎ বাংলাদেশ হজ কার্যালয়ের সামনে অনেক হজযাত্রী ভিড় জমান। তাঁবু দেখতে একই রকম হওয়ায় হজযাত্রীরা কিছুক্ষণের জন্য নিজের তাঁবু হারিয়ে ফেলেন। তাদের নিজ নিজ তাঁবুতে পৌঁছে দেয়া হয়। হজযাত্রীরা মিনার বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখেন। এই মিনার পাশেই সৌদি বাদশাহর বাড়ি, রাজকীয় অতিথি ভবন। এ বার মীনার বড় মসজিদ খায়েফের সামনে বাংলায় লেখা নির্দেশনা রয়েছে। শনিবার অনেককেই গত বছর ঘটে যাওয়া মিনার দুর্ঘটনাস্থল ২০৪ নম্বর রাস্তাও দেখতে গেছেন।
×