ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পপুলিজম ॥ গণতন্ত্রের জন্য হুমকি

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৬

পপুলিজম ॥ গণতন্ত্রের জন্য হুমকি

রাজনীতিতে পপুলিজম বলে একটা শব্দ চালু আছে। এটিকে বলা যেতে পারে এমন এক রাজনৈতিক মতাদর্শ যার বক্তব্য হচ্ছে ন্যায়পর নাগরিকরা এক ক্ষুদ্র এলিটগোষ্ঠীর হাতে নিগৃহীত। এরা জনগণের কণ্ঠ, অধিকার ও মূল্যবোধকে পদদলিত করছে। সাধারণ মানুষ এই বিপদটা উপলব্ধি করে যদি একত্রে কাজ করে তাহলে ওই ক্ষুদ্র এলিট মহলটিকে উৎখাত করা যেতে পারে। যারা এই মতবাদের প্রবক্তা বা সমর্থক তাদের বলে পপুলিস্ট। প্রচলিত অর্থে পপুলিস্টদের এস্টাবলিশমেন্ট বা কায়েমী স্বার্থবিরোধী হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু বাস্তবে এরা কতটা গণতন্ত্রপন্থী এবং কতটাইবা গণতন্ত্রবিরোধী তা নিয়ে বিতর্ক আছে। যেমন সম্প্রতি প্রকাশিত ‘হোয়াট ইজ পপুলিজম’ গ্রন্থে যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির অধ্যাপক জান ওয়ানার মুলার বলেছেন, পপুলিস্টরা রাজনীতিকে জনগণের আরও কাছাকাছি নিতে চায় বা প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র কায়েম করতে চায় বলে প্রচলিত যে ধারণাটি আছে তার চেয়ে ভ্রান্ত আর কিছু হতে পারে না। পপুলিস্টরা দাবি করে যে, একমাত্র তারাই ‘জনগণের ইচ্ছা’র কথা ভাবেন। কিন্তু বাস্তবে জনগণ নীতিনির্ধারণী বিষয় নিয়ে আলোচনা বা বিতর্ক করবে এমন একটা খোলামেলা উন্মুক্ত প্রক্রিয়ায় তারা মোটেই আগ্রহী নয়। মুলার বলেন, পপুলিস্টরা আসলে এলিটদেরই একটা ভিন্ন গ্রুপ যারা রাজনৈতিক বিশুদ্ধতার একটা ফ্যান্টাসি তৈরি করে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে। বর্তমান সময়ে পপুলিস্ট রাজনীতিক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান এবং ব্রিটেনের ইউকে ইন্ডিপেন্ডেন্স পার্টির (ইউকিপ) নেতা নাইজেল ফারাজ। মুলার তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন যে, ব্রেক্সিটের পর এবং আগামী নবেম্বর ট্রাম্পের বিজয়ের সামান্য কিছু সম্ভাবনা থাকায় পপুলিজম নিয়ে উদারপন্থীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। এটা ঠিক যে, ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রে স্বল্প শিক্ষিত পুরুষরাই হলো পপুলিজমের প্রধান ক্ষেত্র। আর এটাও সত্য, জরিপে দেখা গেছে অনেক ভোটার এমন অভিমত ব্যক্ত করেছে যে, দেশ অবনতির দিকে চলেছে। নিজেদের ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে যে তারা এরূপ মূল্যায়ন করেছে এমন কোন কথা নেই। এরা হচ্ছে সেই শ্রেণীর মানুষ যাদের কাছে পপুলিস্ট নেতার বক্তব্য আবেদন সৃষ্টি করতে পারে। তবে ভোটারদের মোটিভ যাই থাক না কেন সেদিকে নজর না দিয়ে এখন দৃষ্টিনিবদ্ধ করা যেতে পারে পপুলিজম বিষয়টি আসলে ঠিক কি তার ওপর। সেটার জন্য পপুলিস্ট নেতারা নিজেরা কি বলছেন তা লক্ষ্য করা যাক। এখানে একটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এই যে, পপুলিস্ট শ্রেণীভুক্ত হওয়ার জন্য এলিট শ্রেণীর সমালোচনা করাটাই যথেষ্ট নয়। নইলে তো অনেকেই এই সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে যায়। স্ট্যাটাস কো বা স্থিতাবস্থায় কেউ খুঁত বের করলেই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইতালিতে তাকে সংজ্ঞানুযায়ী পপুলিস্ট বলতে হয়। সে হিসেবে বার্নি স্যান্ডার্স, জেরেমি করবিন, সাইরিজা বা বেপ্পে গ্রিল্লো সবাইকে পপুলিস্ট বলতে হয়, কারণ তারা সবাই স্ট্যাটাস কোকে আঘাত করেছেন। তাহলে তো কার্যত প্রত্যেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীই হবেন পপুলিস্ট যদি তারা বর্তমান এলিট শ্রেণীর সমালোচনা করে থাকেন। বিরোধী দলে থাকাকালে পপুলিস্টরা নিশ্চিতরূপেই এলিট শ্রেণীর সমালোচনা করে থাকেন। কিন্তু সেটা ছাড়াও সর্বদা অন্য কিছুও আছে, যা পপুলিজমের উল্লেখযোগ্য লক্ষণ। আর সেটা হলো তারা দাবি করেন যে, তারা এবং একমাত্র তারাই জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন। দৃষ্টান্ত হিসেবে তুর্কী প্রেসিডেন্ট এরদোগানের কথা বলা যেতে পারে। তার স্বদেশী সমালোচকদের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন : ‘আমরাই তো জনগণ। তোমরা আবার কে?’ পপুলিস্টরা তাদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ও সমালোচকদের অবশ্যম্ভাবীরূপে নীতিবিবর্জিত দুর্নীতিবাজ এলিট শ্রেণীর অংশ হিসেবে ধিক্কৃৃত করে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময়ও তারা একই কথা বলে। আবার ক্ষমতায় গেলে তারা বৈধ বিরোধী দল হিসেবে এমন কিছুর অস্তিত্ব স্বীকার করবে না। তাদের যুক্তি হলো পপুলিস্ট দলগুলোকে যারা সমর্থন করে না তারা কিছুতেই প্রকৃত জনগণের অংশ নয়। ষাটের দশকের আমেরিকার কট্টর পপুলিস্ট জর্জ ওয়ালেসকে অনেক সময় ট্রাম্পের পূর্বসূরি হিসেবে দেখা হয়। সেই ওয়ালেস মার্কিন নাগরিকদের সম্পর্কে বলতেন এরাই হলো খাঁটি আমেরিকান (শ্বেতাঙ্গ, ধর্মভীরু, কঠোর পরিশ্রমী ইত্যাদি)। পপুলিস্টরা দাবি করে না যে, তারাই হলো জনগণের ৯৯ শতাংশ। তাদের নিজস্ব যুক্তি অনুযায়ী তাদের প্রকৃতপক্ষে বলতে হবে তারাই এক শ’ শতাংশ। নাইজেল ফারাজের কথাই ধরা যাক। ব্রেক্সিট ভোটের ফল নিয়ে তার বক্তব্য হলো এটা হলো প্রকৃত জনগণের বিজয়। তার মানে যে ৪৮ শতাংশ ব্রিটিশ ভোটার ব্রেক্সিটের বিরোধিতা করেছে তারা কোন না কোনভাবে প্রকৃত জনগণ নন, বরং তার চেয়ে কম কিছু। কিংবা তার ওই বক্তব্যের দ্বারা না সূচক ভোটদাতাদের রাজনৈতিক সম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে মর্যাদা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। কিংবা ট্রাম্পের দারুণ তাৎপর্যপূর্ণ একটি মন্তব্যের কথাই ধরা যাক, যা কার্যত সকলের অগোচরেই থেকে গেছে। সেটা হচ্ছে গত মে মাসে এক প্রচার সমাবেশে তিনি বলেছিলেন : ‘একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জনগণের একত্রীকরণÑ কারণ জনগণের অন্য অংশ বলতে কিছুই বোঝায় না।’ মুলার তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, পপুলিস্টরা ‘জনগণের ইচ্ছা’র কথা গুরুত্ব দিয়ে বলে থাকে। তারা যে জনগণের ইচ্ছার কথা বলে সেটি নেয়া হয়ে থাকে প্রকৃত জনগণ বলতে তারা যা মনে করে তা থেকে। আরও মন্দের ব্যাপার হলো এই, পপুলিস্টরা জনগণের যে ইচ্ছা বিশ্বস্ততার সঙ্গে বাস্তবায়িত করবে বলে দাবি করে সেটা একটা কাল্পনিক বা অবাস্তব বিষয়। মুলার লিখেছেন, আধুনিক জটিল, বহুত্ববাদী সংক্ষেপে বলতে গেলে দারুণ রকমের গোলমেলে ধরনের গণতন্ত্রে একক রাজনৈতিক ইচ্ছা বলে কিছু নেইÑ একক রাজনৈতিক অভিমতের তো প্রশ্নই ওঠে না। পপুলিস্টরা তাদের নিজেরই সৃষ্ট এক ধরনের কাল্পনিক ও ন্যায়পর জনগণের মুখে শব্দাবলী জুড়িয়ে দেয়। তারপর তারা ট্রাম্পের মতো বলে : ‘আমিই তোমাদের কণ্ঠস্বর।’ অথবা এরদোগানের কথাই আবার ভেবে দেখা যেতে পারে। গত জুলাই মাসে তিনি বলেছিলেন : ‘আমার জনগণ কি চায়? মৃত্যুদ-।’ ভুলে গেলে চলবে নাÑ এই এরদোগানই প্রথম মৃত্যুদ- পুনরায় চালু করার পক্ষে বলেছিলেন। প্রকৃত নাগরিক এবং সত্যিকারের জনগণের মধ্যে এই বিভাজন থেকে বোঝা যাবে কেন পপুলিস্টরা নির্বাচনে জয়লাভ করতে না পারলে প্রায়ই নির্বাচনের ফল নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এতেই বাহ্যত তারাই একমাত্র জনগণের বৈধ প্রতিনিধি এই দাবিটা মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে যায়। ওদের বক্তব্য পপুলিস্টরা হারবে শুধু যদি নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠকে যা ‘প্রকৃত জনগণ’ কথাটার সংক্ষিপ্ত প্রকাশÑ কথা বলার কিংবা মত প্রকাশের সুযোগ দেয়া না হয়। তাই পপুলিস্টরা প্রায়শই ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব হাজির করে। তারা বলতে চায় যে, নেপথ্যে ঘটে যাওয়া কিছু একটাই হয়ত কারণ যার জন্য দুর্নীতিবাজ এলিট শ্রেণী এখনও জনগণকে পদানত করে রেখেছে। রিপাবলিকান মনোনয়ন লাভের ব্যাপারে আশ্বস্ত হওয়ার আগে ট্রাম্প পরোক্ষভাবে নির্বাচনী জালিয়াতির কথা উল্লেখ করে চলেছিলেন। নবেম্বরের নির্বাচনে পরাজয়ের আশঙ্কা উঁকি দেয়ায় তিনি ইতোমধ্যেই হিলারি ক্লিনটনের বিজয়কে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা করেছেন। মুলার এ প্রসঙ্গে আরেকটি দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। সেটা অস্ট্রিয়ার দক্ষিণপন্থী পপুলিস্ট দল ফ্রিডম পার্টির। সে দলের প্রার্থী নরবার্ট হোফার লড়ছেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী অধ্যাপক আলেকজান্ডার ড্যান ডার বেলেনের বিরুদ্ধে। হোফার বলেছেন : আপনার পেছনে আছে হাই সোসাইটি; আর আমার সঙ্গে আছে জনগণ।’ এ থেকে পরিষ্কার এই দাঁড়ায় : জনগণের রাজনীতিক যদি জয়ী না হয় তবে বুঝতে হবে এই ব্যবস্থার মধ্যে কোথাও গোলমাল আছে। মুলার বলেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পপুলিস্ট রাজনীতিকরা অন্যান্য রাজনীতিকের মতো নয়। তবে পার্থক্যটা এই নয় যে, তারা কোন না কোনভাবে জনগণের অধিকতর ঘনিষ্ঠ। এটাও নয় যে, তারা প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের বিপরীতে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র চায়। যতদিন তারা তাদের বিবেচনায় প্রকৃত জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হতে না পারে ততদিন প্রতিনিধিত্বশীল ব্যবস্থা নিয়ে তাদের কোন আপত্তি নেই। গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যটা হলো পপুলিস্টরা সমকালীন সমাজে বহুত্ববাদকে অস্বীকার করে। তারা যখন সমতার কথা বলে তখন মধ্য আমেরিকা অথবা লিটল ইংল্যান্ডের কোন আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ সদৃশতার কথা বোঝায়। বাস্তবে কি এ সবকিছুতে কিছু আসে যায়? মুলার বলেন, নিঃসন্দেহে এটা উদ্বেগজনক যে, পপুলিস্টরা নির্বাচনের ফলের ওপর সংশয়ের ছায়া ফেলে এবং অন্য সব রাজনীতিকের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার চেষ্টা করে। দরকার হলে তাদের কারাগারে আটকে রাখতে বলে। আর ট্রাম্পের সাম্প্রতিক উক্তি যদি সত্য হয় তাদের গুলি করে মারার কথাও তিনি বলেন। তবে এক্ষেত্রে এমন উপসংহারেও পৌঁছান যায় যে, পপুলিস্টরা এক ধরনের রাজনৈতিক ফ্যান্টাসির জগতে বাস করে এবং বাস্তবে তারা ব্যর্থ হতে বাধ্য। অনেক উদারপন্থী পর্যবেক্ষকের মতে পপুলিস্টরা সমস্যার যে সমাধান বাতলে দেয় তা অতি সহজ সরল এবং অচিরেই তা অকার্যকর প্রমাণিত হয়ে যায়। প্রচলিত ধারণায় বলে পপুলিস্ট দলগুলো মূলত প্রতিবাদ জানানোর দল এবং সেই প্রতিবাদ দিয়ে দেশ চালানো যায় না। কারণ, যৌক্তিক বিচারে কেউ নিজের বিরুদ্ধে নিজে প্রতিবাদ জানাতে পারে না। রাজনীতিবিরোধীরা সত্যিকারের নীতি তৈরি করতে পারে না। মূলার উল্লেখ করেছেন, ক্ষমতায় থাকা পপুলিস্টরা কোন না কোনভাবে ব্যর্থ হতে বাধ্য এমন ধারণা স্বস্তিদায়ক মনে হতে পারে; কিন্তু সেটাও এক ধরনের ইলিউশন। পপুলিস্ট দলগুলো এলিট শ্রেণীর বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ জানিয়ে থাকে। তবে তার অর্থ এই নয় যে, পপুলিস্ট সরকার স্ববিরোধী হয়ে দাঁড়াবে। সরকারের অভ্যন্তরে পপুলিস্টদের সকল ব্যর্থতার জন্য স্বদেশে হোক আর বিদেশে হোক নেপথ্যে কর্মরত এলিটদের দায়ী করা যেতে পারে। মুলার বলেছেন, পপুলিস্টরা বিজয়ী হওয়ার পরও ভিকটিমের মতো আচরণ করে চলে। সংখ্যাগরিষ্ঠরা দুর্ব্যবহারপ্রাপ্ত সংখ্যালঘুর মতো আচরণ করে। আরও উদ্বেগজনক ব্যাপার হলো পপুলিস্টদের যখন পার্লামেন্টে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে তখন তারা এমন সরকার গঠনের চেষ্টা করে যেটাকে দেখতে গণতান্ত্রিক বলেই মনে হয় অথচ যার লক্ষ্য হলো পপুলিস্টদের ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করা। সোজা কথায় বলতে গেলে পপুলিস্টরা রাষ্ট্রকে কলোনিতে পরিণত করে কিংবা তা ‘দখল’ করে নেয়। সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরীর কথা উল্লেখ করেছেন। অবশ্য ক্ষমতা সুসংহত এমনকি পাকাপোক্ত করার এই কৌশল এককভাবে যে পপুলিস্টদেরই রয়েছে তা নয়। তাদের বেলায় বিশেষ ব্যাপারটা হলো এই যে, রাষ্ট্রকে এভাবে কলোনিতে পরিণত করার কাজটা তারা প্রকাশ্যেই করতে পারে। তারা ঔদ্ধত্যভাবেই বলতে পারে ‘জনগণ কেন তাদের একমাত্র ন্যায়সঙ্গত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে নিজেদের রাষ্ট্রকে দখলে নিয়ে নেয় না।’ পপুলিস্টরা গণসমর্থন লাভের জন্য বৈষয়িক ও অবৈষয়িক সুযোগ-সুবিধাও প্রদান করে থাকে। তবে এমন আচরণ শুধু পপুলিস্টদের একার নয়। তবে এদিক দিয়ে পপুলিস্টদের বিশেষত্ব এখানে, তারা এ কাজটা প্রকাশ্যে করে এবং নৈতিক যুক্তি দেখিয়ে করে। আর যাই হোক তাদের ক্ষেত্রে শুধু কিছু লোকই হলো সত্যিকার অর্থে জনগণ এবং সেই কারণে তারা সেটি হলো কিনা ন্যায়সঙ্গতভাবে তাদেরই রাষ্ট্র সেই রাষ্ট্রের সাহায্য-সমর্থন পাওয়ার দাবি রাখে। এই ভাবনাটি না থাকলে এটা বুঝতে পারা কঠিন, নিজ সরকারের দুর্নীতির এত কিছু প্রকাশ হওয়ার পরও এরদোগান কিভাবে রাজনৈতিক দিক দিয়ে টিকে থাকতে পেরেছেন। কিছু কিছু পপুলিস্টের ভাগ্য সুপ্রসন্ন যে, তাদের সরকারের প্রতি সকল শ্রেণীর সমর্থন গড়ে তোলার মতো সম্পদ তাদের রয়েছে। শ্যাভেজ তেলের দর বৃদ্ধি থেকে লাভবান হয়েছিলেন এবং সেই সুফল জনগণকে দিয়েছিলেন। সরকারগুলোকে জনগণের সমর্থন কেনার কিংবা অন্ততপক্ষে তাদের চুপ রাখার জন্য সুকৌশলে ভর্তুকি কাজে লাগিয়ে থাকে। এরদোগান একে পার্টির শাসনাধীনে অর্জিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন থেকে গড়ে ওঠা আনাতোলীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অকুণ্ঠ সমর্থ ভোগ করে চলেছেন। পপুলিস্টদের রাষ্ট্র পরিচালনা কৌশলের আরেকটি বিষয়কে বুঝতে পারা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন মুলার। তিনি বলেন, ক্ষমতাসীন পপুলিস্টদের একটা প্রবণতাই হলো তাদের সমালোচনাকারী এনজিওগুলোর প্রতি তাদের কঠোর ভূমিকা। অবশ্য সুশীল সমাজকে হয়রানি করা পপুলিস্টদের একক রেওয়াজ নয়। সুশীল সমাজের ভেতর থেকে তাদের প্রতি বিরোধিতা এক বিশেষ প্রতীকী সমস্যা তৈরি করে। এতে তারাই এককভাবে জনগণের প্রতিনিধি এই দাবির যৌক্তিকতা ক্ষুণœ হয়। কাজেই পপুলিস্টদের দিক থেকে এই যুক্তি দেয়া বা প্রমাণ করাটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়Ñ সুশীল সমাজ আদৌ সুশীল সমাজ নয় এবং যাদের জনপ্রিয় বিরোধী শিবির বলে মনে হয় প্রকৃত জনগণের সঙ্গে তাদের কোন সম্পর্ক নেই। মুলার উল্লেখ করেছেন, এ থেকেই বুঝতে পারা যায় পুতিন, ওবরান এবং পোল্যান্ডের জাস্টিস পার্টি (পিস) কেন এনজিওগুলোকে বহির্শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বলে ধিক্কৃত করার এবং আইনতও তাদের বিদেশী এজেন্ট বলে ঘোষণা করার চেষ্টা করেন। তবে তাদের যাবতীয় চেষ্টার একটা বিয়োগান্তক পরিণতিও আছে। ক্ষমতায় থাকাকালে পপুলিস্টরা সেই একই রাজনৈতিক পাপাচার করে বসে যেগুলোর জন্য তারা এলিট শ্রেণীকে অভিযুক্ত করে থাকে। সেটা হলো নাগরিকদের বাদ দিয়ে রাষ্ট্রকে কুক্ষিগত করা। এস্টাবলিশমেন্ট বরাবরই যেটা করে এসেছে পপুলিস্টরাও সেই কাজ শেষ পর্যন্ত করে বসে। তফাতটা শুধু এই, ওরা এটা করে অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার যুক্তিসহকারে এবং সম্ভবত অধিকতর স্বচ্ছ বিবেকবোধ দিয়ে। মুলার মনে করেন পপুলিস্টরা এলিটদেরই এক ভিন্নরূপ, যারা রাজনৈতিক বিশুদ্ধতার সমষ্টিগত ফ্যান্টাসির সহায়তায় ক্ষমতা গ্রাস করার চেষ্টা করে। পাশ্চাত্যে এখন পপুলিজমের যে জোয়ার বইছে তাতে কি প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত? এই প্রশ্নের জবাবে মুলার বলেন, পপুলিজম শব্দটার এত যথেচ্ছ ও মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। স্যান্ডার্স, করবিন, সাইরিজা ও পোডিমসকে ট্রাম্প, ফারাজ ও এরদোগানের একই শ্রেণীতে ফেলার কোন কারণ নেই। কারণ শেষোক্ত নেতারা নিজেদের এক নির্ভরযোগ্য জনগোষ্ঠীর একক প্রতিনিধিত্বকারী বলে দাবি করে থাকে। দ্বিতীয়ত : পপুলিস্টদের গণতন্ত্রের প্রতি বিপদ হিসেবে দেখা উচিত। তার মানে অবশ্য এই নয় যে, তাদের রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট করা পরিহার করতে হবে। কারণ পপুলিস্ট শাসন নেই এমন অনেক দেশে বহু নাগরিককে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা হয়েছে। তাতে সমাজে অসাম্য বেড়েছে বৈ কমেনি। সূত্র : দি গার্ডিয়ান
×