ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সব গুরুত্ব গরুতে

কাবিলা সাদেক লাইলী- রঙিন জামা, সুগন্ধি মেখে হাটে

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৬

কাবিলা সাদেক লাইলী- রঙিন জামা, সুগন্ধি মেখে হাটে

মোরসালিন মিজান ॥ গরু একটি উপকারী প্রাণী। এর চারটি পা, দুটি চোখ, দুটি কান, দুটি শিং ও একটি লম্বা লেজ আছে। গরু ঘাস খায়...। হ্যাঁ, খুব খুব পরিচিত এই রচনা। কে লেখেননি? শিক্ষাজীবনের শুরুতে গরুবিষয়ক পাঠ আবশ্যক ছিল। আর এখন এতকাল পর কাজে আসছে। কোরবানির ঈদ যেহেতু, কাজে আসছে বৈকি! সকল আলোচনার কেন্দ্রে অবস্থান করছে গরু। রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্তে হাট বসেছে। কেনাকাটা শুরু হয়ে গেছে পুরোদমে। গরু কেনার আগে গল্প। পরে আরও বেশি। ছেলে-বুড়ো সকলেই এ আলোচনায় যোগ দিয়েছেন। কত শত রকমের ব্যস্ততা! সবই গরু নিয়ে। আগামী মঙ্গলবার কোরবানির ঈদ। হাতে সময় কম। তাই প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে পুরোদমে। আর সব বাদ দিয়ে গরু-ছাগল-মহিষ-উটের খোঁজ করা হচ্ছে। অভিন্ন দৃশ্য রাজধানী ঢাকায়। কেউ কেউ আগেভাগেই পশু কেনার কাজ সেরে ফেলেছিলেন। আর যারা বাকি তাদের বড় অংশটি ‘মাঠে নামে’ শুক্রবার। তাদের আকৃষ্ট করতে বিক্রেতাদের উদ্যোগের কোন কমতি ছিল না। দুপুরের দিকে হাটে গিয়ে দেখা যায়, গরু আর গরুর চেহারায় নেই। রীতিমতো জামা-কাপড় গায়ে দিয়ে হাটে এসেছে। বিশেষ প্রক্রিয়ায় টুকরো টুকরো কাপড়ে তৈরি জামা। বিভিন্ন রঙের। শিং দুটোও বাদ যায়নি। রঙিন কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে নেয়া হয়েছে। গলায় আবার মালা। আমিরুল মিয়া নামের এক ব্যাপারী যুক্তি দিয়ে বললেন, ‘দামী জিনিস। একটু যতœ লাগে। এরে বহুদিন ধইরা পালছি। রাজার মতো রাখছি। যে কিনবো সে অন্যজনরেও দেখাইতে পারবো। এই জন্যই এত কাম কাজ করছি।’ সাজানোর পাশাপাশি গরুর বিভিন্ন নাম দেয়া হয়েছে। সাদেক, কাবিলা ইত্যাদি নামে ডাকা হচ্ছে। একটি ষাঁড়ের নাম ‘লাইলী।’ মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর থেকে গরুটি নিয়ে হাটে এসেছিলেন নজরুল। বললেন, ‘সাত বছর ধইরা পালতেছি। প্রেমিকার মতো। তখন নাম দিছিলাম ‘লাইলী’। আমার লাইলীরে প্রতিদিন ৭০০ টাকার খাবার দিছি। এখন আনছি বিক্রি করতে।’ সঙ্কর প্রজাতির গরুর দাম দশ লাখ টাকা বলে জানান তিনি। হাটে গরুর যতœআত্মিও কম হচ্ছে না। গরুর গায়ে বাতাস করা, মশা-মাছি তাড়ানোর জন্য লোক রাখা আছে। গরুর পিঠে একটু পর পরই চিরুনি চালানো হচ্ছে। গরুর গায়ের দুর্গন্ধ দূর করতে এটা ওটা স্প্রে করা হচ্ছে। শুধু কি তাই? টেলকম পাউডার মাখিয়ে দেয়া হচ্ছিল সাদা গরুর গায়ে। আলমগীর নামের এক ব্যাপারী গরুর গায়ে মিল্লাত ঘামাচি পাউডার ছিটিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘গরম তো। আমাগো গা ঘামে না? গরুরও ঘামে। এই জন্য পাউডার দেই। দিলে ভাল। আর গন্ধও করে না।’ কিছু সময় হাটে ঘুরলে আরও বহু বিচিত্র দৃশ্য দেখা যায়। ঢাকার রাস্তাগুলোও এখন গরুর দখলে। শহরের প্রায় প্রতিটি রাস্তায় গরু আর গরু। শর্ট প্যান্ট আর টিশার্ট পরা শহুরে রাখাল বালকরা মনের আনন্দে গরু চরাচ্ছেন। গরুর সঙ্গে তারা হাঁটছেন। খেলছেন। এমনকি কথা বলছেন গরুর সঙ্গে! একই দিন বিকেলে ঢাকা কলেজের সামনের রাস্তা ধরে ধীরগতিতে এগোচ্ছিল একটি গরু। তাই দেখে রশি ধরে থাকা এক তরুণ একটু পর পর বলছিলেনÑ ‘খাবি? ঘাস খাবি? পাড়ায় ঢোক আগে। যা, হাট হাট...। সামান্য রাস্তা। এত দূর আসছিস। যা না।’ এমন অনুরোধ শুনে মনে হতেই পারে, সদ্য হাট থেকে কেনা গরু কথা বোঝে। তাই কি? জানতে চাইলে কিছুটা যেন লজ্জায় পড়ে যান কলেজপড়ুয়া ইমন। বলেন সেই গাবতলী থেকে হেঁটে আসছে। এতটা পথ ভালই এলো। এখন মনে হচ্ছে টায়ার্ড। হাঁটতে চাইছে না। তাই চেষ্টা করছি। এমন কথায় কখনও কাজ হয়। কখনও কখনও আবার বেশি কাজ হয়! তখন শুরু হয়ে যায় ছোটাছুটি। মানিক মিয়া এ্যাভিনিউতে দেখা গেল, অকারণে খোঁচাখুঁচিতে অস্থির এক গরু হঠাৎ প্রতিবাদ করে উঠেছে! আর কে রশি ধরে রাখার সাহস দেখায়? সবার চোখের সামনে দিয়ে দৌড়ে পালাতে থাকে গরুটি। আশপাশের কেউ আটকানোর চেষ্টা করেন না বরং সবার মুখে হাসি। খুব মজা করে দৃশ্যটি দেখছিলেন। বাসার সামনে বেঁধে রাখা গরু নিয়ে ছোট ছোট বাচ্চার আগ্রহটাও চোখে পড়ার মতো। একটু পর পর ঘাস এনে দিচ্ছে। ভয়ে ভয়ে কাছে যাচ্ছে কেউ। কেউ দেখছে মায়ের কোলে চড়েই। এই আবেগ এই ভালবাসা একটি বোবা প্রাণীর জন্য। এইটুকুন ভাবতে সত্যি ভাল লাগে।
×