ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রমত্তা নদীবক্ষে সঙ্গীতের তাল-লয়ে দাঁড়িদের ছন্দময় দাঁড় নিক্ষেপ

দৃষ্টিনন্দন ক্রীড়ার অভিনব রঙ্গমঞ্চ

প্রকাশিত: ০৪:১৪, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৬

দৃষ্টিনন্দন ক্রীড়ার অভিনব রঙ্গমঞ্চ

হেইয়ারে হেইয়া, হেইয়ারে হেইয়া, হেইয়াহো হেইয়াহো, হেইয়ারে হেইয়া, আল্লাহ আল্লাহ বলো সবে হেইয়ারে হেইয়া- এমন কোরাস আর পাশার তালে তালে গাইছেন রঙিন পোশাক পরা মাঝি-মাল্লার দল। সেই সঙ্গে বৈঠা ঠেলে তিস্তা নদীর বুক চিরে এগিয়ে চলেছে ৫৯ হাত লম্বা ছুরির মতো তীক্ষè ‘ছিপ নৌকা’। স্থানীয় ভাষায় অনেকেই একে বলে ছুরি নৌকা। নদীর দু’কূলে তখন হাজার হাজার দর্শকের হাততালি, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। নদীমাতৃক বাংলাদেশে আবহমানকাল থেকে বাংলার ঐতিহ্যের অন্যতম একটি অনুষঙ্গ নৌকাবাইচ। সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় রংপুরের পাশ ঘেঁষে কাউনিয়া উপজেলার হৃদপিঞ্জর ভেদ করে বয়ে চলা প্রমত্তা তিস্তা নদীতে প্রতি বছরই অনুষ্ঠিত হয় এমনই এক নৌকাবাইচ। আশপাশের কয়েকটি জেলা থেকে আবাল, বৃদ্ধবণিতা সবাই বিপুল আগ্রহ নিয়ে ছুটে চলেন নৌকাবাইচ দেখতে। প্রমত্তা নদীবক্ষে সঙ্গীতের-তাল-লয়ে দাঁড়িদের ছন্দময় দাঁড় নিক্ষেপে নদীজল আন্দোলিত করে যে মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের অবতারণা হয় তা অতুলনীয়। আবেগ-উত্তেজনার নৌকাবাইচ হয়ে ওঠে আপামর মানুষের নির্মল আনন্দের সপ্রাণ প্রতিভূ। নদীমাতৃক বাংলাদেশ নদীর তরঙ্গভঙ্গের সঙ্গে এ মাটির মানুষের আশৈশব মিতালী। নদী তাই হয়ে উঠেছে এখানে মানুষের প্রাণোচ্ছল ক্রীড়াসঙ্গী। এই প্রেক্ষাপটে নদীবক্ষে নৌকা শুধু যোগাযোগের মাধ্যমই নয়, হয়ে উঠেছে জলক্রীড়ার অভিনব রঙ্গমঞ্চ। নৌকাবাইচের এ আয়োজন তারই একটি দৃষ্টিনন্দন রোমাঞ্চকর দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় সাধারণত নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা হয় বাংলা ভাদ্র ও আশ্বিন মাসে। নদী তখন থাকে পূর্ণ যৌবনা। কিন্তু রংপুর এর ব্যতিক্রম। বর্ষা বা শুকনা যে কোন মৌসুমেই ঈদ হোক না কেন। রংপুরের তিস্তা পাড়ে প্রতিবছর নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা হয় ঈদ-উল- ফিতরের পরের দিন। নৌকাবাইচকে ঘিরে নদীতীরে বসে জমজমাট মেলা। সেখানে থাকে জাদু, সার্কাস, নাগরদোলা, ছেলে ভোলানো খেলনা আর বিচিত্র সব মিষ্টান্নের দোকান। প্রতিযোগিতা শুরু হয় সাধারণত বিকেল ৪টার দিকে। কিন্তু সকাল থেকেই পাঞ্জরভাঙ্গা আর বালাটারী ইউনিয়নের সঙ্গমস্থল গোদাইঘাট থেকে পুরনো তিস্তা ব্রিজ পর্যন্ত দীর্ঘ এক কিলোমিটারজুড়ে নদীর দু’পাড়ে জড়ো হন হাজার হাজার দর্শনার্থী। পার্শ্ববর্তী লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, রংপুর এবং গাইবান্ধাসহ দূর-দূরান্ত থেকে উৎসুক জনতা জলপথে এবং স্থলপথে হাজির হন উৎসবস্থলে। রং-বেরঙের পোশাক পরে নেচে-গেয়ে কিশোর-তরুণরা উপভোগ করেন এই নৌকাবাইচ। প্রতিযোগিতা শুরুর আগে নৌকায় ওঠার আবার অনেক আনুষ্ঠানিকতা আছে। মাঝি-মাল্লারা পাক-পবিত্র হয়ে এক রকম গেঞ্জি গায়ে মাথায় একই রঙের রুমাল বেঁধে নেন। সবার মধ্যখানে থাকেন নৌকার গায়েন বা পরিচালক। দাঁড়িয়ে থেকে নৌকা চালান পেছনের মাঝিরা। নৌকার মধ্যে ঢোল তবলা নিয়ে গায়েনরা থাকেন। তাদের গানগুলো মাঝিদের উৎসাহ আর শক্তি যোগায়। মাঝিরা একত্রে জয়ধ্বনি সহকারে নৌকা ছেড়ে দিয়েই একই লয়ে গান গাইতে আরম্ভ করে। এ গানগুলোকে বলে সারি গান। সেই গানের তালের ঝোঁকে ঝোঁকে বৈঠা টানে। ফলে কারও বৈঠা ঠোকাঠুকি না লেগে এক সঙ্গে পানিতে অভিঘাত সৃষ্টি করতে থাকে। ঢোল ও করতালের সঙ্গে সঙ্গে সেখানে এক অন্য রকম উদ্যমের সষ্টি হয়। সে উদ্যম ছড়িয়ে পড়ে মাঝি-মাল্লাদের মাঝে। গায়েন বা পরিচালক কাঁসির (এক ধরনের ধাতব বাদ্যযন্ত্র) শব্দে বৈঠা এবং গানের গতি বজায় রাখতে সাহায্য করে। অন্য সব নৌকাকে পেছনে ফেলে নিজেদের নৌকাকে সবার আগে যাওয়ার চেষ্টায় গায়েন প্রয়োজনবোধে কাঁসির শব্দে বৈঠার গতি বাড়ানোর নির্দেশ দেন। সেই সঙ্গে গানের গতিও বেড়ে চলে। এ ছাড়া এই সময় দেহ ও মনের উত্তেজনার বশেই গানের মধ্যে ‘ হৈ হৈয়া’ এই ধরনের শব্দ শোনা যায় মাঝিদের মুখে। নৌকাবাইচে সকল মাঝি-মাল্লা তালে তালে এক সুরে গান গেয়ে চলেন। ক্ষিপ্র গতির এই নৌকাগুলোর বিভিন্ন বাহারি নাম রয়েছে। যেমন, গাজী কালু, জলপরী, অগ্রদূত, ঝরের পাখি, পঙ্খীরাজ, ময়ূরপঙ্খী, কালের খেয়া, সাইমুন, তুফান মেইল, সোনার তরী, দীপরাজ ইত্যাদি। প্রতিবছর তিস্তাপাড়ের বন্যা ও নদী ভাঙ্গনে জর্জড়িত দুঃখী মানুষগুলোকে একদিনের জন্য আনন্দ দিতে এ আনন্দ মহাযজ্ঞের আয়োজন করে আসছে এখানকার কিছু উদ্যমী যুবকের সংগঠন ‘তিস্তা ব্রিজ ঈদমেলা উদ্যাপন কমিটি’। এ সংগঠনের অধিকাংশ সদস্য জীবিকার তাগিদে দেশ-বিদেশে অবস্থান করে। কিন্তু যে যেখানেই থাকুক ঈদের ছুটিতে ঠিক ছুটে আসে জন্মভূমির অভাবী মানুষগুলোর আনন্দের সারথী হতে। নিজেদের চাঁদার টাকায় প্রায় ১৫ বছর ধরে নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে আসছে এ কমিটি। Ñআবদুর রউফ সরকার রংপুর থেকে
×