ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বরিশালের ইতিহাসে সর্বকালের স্বতঃস্ফূর্ততা!

প্রকাশিত: ০৪:১৩, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৬

বরিশালের ইতিহাসে সর্বকালের স্বতঃস্ফূর্ততা!

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে সবাইকে সচেতন করে প্রায় ১০ হাজার মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে অসম্ভবকে সম্ভব করার মাধ্যমে বরিশালের ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে জেলখাল দখলমুক্ত ও পরিচ্ছন্নতা অভিযান। গত ৩ সেপ্টেম্বর সকাল দশটা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত চলা এ অভিযানে সকল বয়সের নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতী, কিশোর, স্কুল-কলেজ পড়–য়া শিক্ষার্থীসহ বাংলাদেশ গার্ল গাইডস্ এ্যাসোসিয়েশনের বরিশাল অঞ্চলের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গাইড, রেঞ্জার ও গাইডার কর্মী, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং শ্রেণী ও পেশার মানুষের অংশগ্রহণে এই সম্ভাবনার পথ দেখিয়েছেন বরিশালের ডিজিটাল জেলা প্রশাসক ড. গাজী মোঃ সাইফুজ্জামান। তার উদ্যোগে নগরবাসী একত্রিত হয়েছিলেন তাদের বেদখল হয়ে যাওয়া জেলখাল উদ্ধার ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য। জেলা প্রশাসকের মহতি উদ্যোগে সাড়া দিয়ে এ কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করতে হাজির হয়েছিলেন প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক, সংসদ সদস্য জেবুন্নেছা আফরোজ, সিটি মেয়র মোঃ আহসান হাবিব কামাল, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব আব্দুল মালেক, মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট আফজালুল করিমসহ অসংখ্য বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। ওইদিন শুরু থেকেই ছিল এক ধরনের উৎসবের আমেজ। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে এসেছিলেন পরিচ্ছন্নতা অভিযানে অংশগ্রহণ করতে। অবশেষে সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষের অংশগ্রহণে প্রাণ ফিরে পেয়েছে নগরীর ঐতিহ্যবাহী জেলখাল। শিশু থেকে বৃদ্ধ কেউ ওইদিন বাদ যায়নি। যে যেভাবে পেরেছেন সহযোগিতা করেছেন পরিচ্ছন্নতা অভিযানে। এক সময়ে যে খালের স্রোত থেমে গিয়েছিল সেই খালেই এখন স্রোতের তীব্রতা দেখা দিয়েছে। এ যেন স্বপ্নের বাস্তবতা। কোন দল নেই, আলাদা পথ নেই সবাই ছিল এক কাতারে শামিল। সর্বকালের স্বতঃস্ফূর্ততার উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে বরিশালে। পরিচ্ছন্নতা অভিযানে অংশগ্রহণ করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব আব্দুল মালেক বলেন, বরিশাল বাংলাদেশের প্রাচীনতম একটি অঞ্চল। জেলখাল পরিচ্ছন্নতার অভিযান প্রতিটি জেলা, বিভাগ এমনকি রাজধানী অনুসরণ করবে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নের জন্য সর্বদা কাজ করে যাচ্ছেন। এখানকার কোন প্রকল্প দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি তা অনুমোদন করে দেন। এ সময় জেলা প্রশাসক ড. গাজী মোঃ সাইফুজ্জামান জেলখালের উন্নয়নে ২৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প দেয়ার জন্য অনুরোধ জানালে সচিব আব্দুল মালেক বলেন, জেলখাল উন্নয়নে ২৫ কোটি টাকার প্রকল্প খুব শীঘ্রই প্রধানমন্ত্রী পাস করে দেবেন। সূত্রমতে, নথুল্লাবাদ থেকে কীর্তনখোলা নদী পর্যন্ত জেলখালের বিস্তৃতি ৩ দশমিক ২ কিলোমিটার (৩২শ’ মিটার)। এই ৩২শ’ মিটার এলাকাকে ৩০টি খ-ে ভাগ করা হয়েছিল। প্রত্যেক খ-ের জন্য তৈরি করা হয়েছিল একটি করে গ্রুপ। প্রত্যেক গ্রুপে দু’জন মুক্তিযোদ্ধা, দুটি এনজিও, দুটি সরকারী দফতর, একজন কাউন্সিলর, ৫ জন রোভার স্কাউটস সদস্য, একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। তিনটি গ্রুপের জন্য একজন মহিলা কাউন্সিলর, ৫টি গ্রুপের জন্য একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং ১০টি গ্রুপের জন্য একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক কিংবা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কাজ করেছেন। এছাড়া জেলখাল পরিচ্ছন্নতা অভিযানে ছিল ৩০টি নৌকা, স্প্রীডবোর্ট এবং তিনটি মোবাইল কোর্ট। ৩০টি খ-ের প্রত্যেক খ-ে সিটি কর্পোরেশনের ৫ জন পরিচ্ছন্নতা কর্মী সহযোগিতা করেছেন। গত এক মাস ধরে জেলা প্রশাসক জেলখাল পরিষ্কারের প্রস্তুতি পর্ব শেষ করেছেন। এজন্য তিনি (জেলা প্রশাসক ড. গাজী মোঃ সাইফুজ্জামান) প্রস্তুতি সভা করেছেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান, সরকারী দফতর, এনজিও, সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠন, গণমাধ্যম, স্কাউট, গার্লস গাইড ও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমেও তিনি নিয়েছেন সকলের মতামত। ‘ধান-নদী খাল এই তিনে বরিশাল’ সেøাগান গ্রোথিত হয়েছিল প্রাচ্যের ভেনিসকে ঘিরে। এই শহরের রূপ সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বরিশাল শহরকে আখ্যা দিয়েছিলেন ‘প্রাচ্যের ভেনিস’। সেই রূপ সৌন্দর্যে ভাটা পড়েছে বহু আগেই। সকল ঐতিহ্য হারিয়ে এই নগরী যেন আজ ময়লার ভাগাড়। সামান্য বৃষ্টি হলেই সড়কগুলোতে হাঁটু সমান জল জমে যায়। শত কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত রাস্তার কংক্রিট, ঢালাই সবই উঠে যাচ্ছে। ভাঙ্গাচুড়া রাস্তায় মানুষের চলাচল করতে গিয়ে পোহাতে হয় সীমাহীন দুর্ভোগ। নগরবিদরা মনে করেছেন, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণেই এ জনদুর্ভোগের সৃষ্টি হয়েছে। কাগজে-কলমে এখনও নগরীতে খালের সংখ্যা ৪৬টি। বাস্তবে এর অধিকাংশরই অস্তিত্ব নেই। যে সব রাজনীতিবিদরা জনগণের ভোটে নানান সময়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন তাদেরই এসব খাল রক্ষা করার কথাছিল। কিন্তু বাস্তবে তারাই সরকারী টাকায় খাল ভরাট করে বহুতল মার্কেট পর্যন্ত নির্মাণ করেছেন বলেও নজির রয়েছে। সরকারী খাল ভরাট করে জমি দখলের যে অশুভ প্রতিযোগিতা চলেছে তাতেও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদ ছিল রাজনীতিবিদদের। বিভিন্ন সময়ের ক্ষমতাসীনদের পিছনে ঘুরে বেড়ানো ছিঁচকে পাতি নেতা কিংবা তাদের আত্মীয়-স্বজনরা ছাড়া কার সাধ্য আছে এমন সরকারী নদী, খাল দখলের মহাউৎসবে মেতে উঠার! অথচ জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব ছিল জনসাধারণের খালগুলো রক্ষা করার। তারা তা করেননি বরং তারা একের পর এক খালকে হত্যা করেছেন। নগরীর বটতলা, চাঁদমারী, সাগরদী, আমানতগঞ্জ ও ভাটিখানার খালগুলো যখন ইতিহাসের পাতায় নাম লেখাতে যাচ্ছে, তখনও নিভু নিভু করে বেঁচে ছিল ঐতিহ্যবাহী জেলখাল। ঠিক তখনই হারাধনের একটি ছেলের মতোই এই একমাত্র খালটি রক্ষায় দেবদূতের ন্যায় হাজির হয়েছেন জেলা প্রশাসক ড. গাজী মোঃ সাইফুজ্জামান। তিনি ঘুমিয়ে থাকা নগরবাসীকে জাগিয়ে তুলেছেন। নগরীর প্রায় সকল মানুষ যখন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন তখন সেই অন্ধকার গভীর রাতে গত এক বছর ধরে জেগে জেগে ফেসবুক পেজে নানান সমস্যার বেড়াজালে জর্জরিত বরিশালবাসীকে সম্ভাবনার দিকনির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তার উদ্যোগেই নগরীর প্রায় ১০ হাজার মানুষ একত্রিত হয়েছিলেন তাদের বেদখল হয়ে যাওয়া জেলখাল উদ্ধার ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য। বরিশালবাসীর জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকা এ দিনটিতে অপর একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য ঢাকা থেকে বরিশালে এসেছিলেন ‘মানুষের জন্য’ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম। তিনি জেলা প্রশাসকের এমন কর্মকা-ে অভিভূত হয়ে বলেন, সারাদেশে ঘুরে ফিরে শুনি, এ ধরনের সামাজিক কর্মকা-ে রাজনৈতিক বাধা, পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ নেই আরও কত অজুহাত। মূলত কাজ করতে চাইলে যে ইচ্ছাটাই যথেষ্ট তা বরিশালের জেলা প্রশাসক প্রমাণ করে দিয়েছেন। এমন বিরল ঘটনা সারাদেশের জন্য রোল মডেল হতে পারে।
×