ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পুনর্মূল্যায়ন করা হচ্ছে

ইসলামাবাদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পর্যবেক্ষণ চলছে

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬

ইসলামাবাদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পর্যবেক্ষণ চলছে

তৌহিদুর রহমান ॥ ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্ক বারবার তিক্ত করে চলেছে পাকিস্তান। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করতে একাধিকবার সতর্ক করে দেয়ার পরও তা মানছে না দেশটি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার প্রেক্ষিতে ইসলামাবাদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে এখন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে ঢাকা। দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের বিষয়ে এখন নতুন করে পুনর্মূল্যায়ন করা হচ্ছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র এসব তথ্য জানায়। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে যুদ্ধাপরাধী আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদ-ের প্রতিবাদে দেশটির জাতীয় পরিষদে নিন্দা প্রস্তাব তোলে। তখন থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যু নিয়ে ঢাকা-ইসলামাবাদের মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হয়। এখন যুদ্ধাপরাধী ও জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদ- ঘিরে দুই দেশের মধ্যে আবারও তীব্র টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। দেশের অন্যতম শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদ-ের প্রেক্ষিতে ইসলামবাদকে সতর্ক করা হলেও বুধবার দেশটির জাতীয় পরিষদে নিন্দা প্রস্তাব তুলেছে। এ ঘটনায় পাকিস্তান নির্লজ্জতারও পরিচয় দিয়েছে। এখন দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে পুনর্মূল্যায়ন করা হচ্ছে। সূত্র জানায়, বিভিন্ন মহল থেকে একাধিকবার পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নের দাবি জানানো হয়েছে। মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদ- নিয়ে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়ার প্রেক্ষিতে আবারও বিভিন্ন সংগঠন পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নের দাবি তোলে। তবে পাকিস্তানের সঙ্গে এখনই কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নের কোন পরিকল্পনা নেই সরকারের। দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে এখন গভীর পর্যবেক্ষণ চলছে। দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন না করলেও কূটনৈতিক সম্পর্ক নতুন করে পুনর্মূল্যায়ন করতে চায় ঢাকা। সেই পুনর্মূল্যায়নের পরই দুই দেশের ভবিষ্যত সম্পর্ক নির্ভর করবে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে পাকিস্তান শুরু থেকেই নেতিবাচক অবস্থান নিয়ে এসেছে। বিভিন্ন সময়ে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রেও তারা প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আসছে। সর্বশেষ জামায়াতে ইসলামীর নেতা মীর কাশেমের মৃত্যুদ- কার্যকরের প্রেক্ষিতে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অযাচিতভাবে বিবৃতি দেয়। এ বিবৃতির জের ধরে ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার সামিনা মেহতাবকে তলব করা হয়। পাকিস্তানকে জানিয়ে দেয়া হয়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তারা কোনভাবেই যেন নাক না গলায়। তবে দেশটিকে কড়া প্রতিবাদ জানালেও বুধবার পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে নিন্দা প্রস্তাব পাশ করে। মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদ- ঘিরে পাকিস্তানকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যে কূটনৈতিক পত্র তুলে দেয়া হয় সেখানে উল্লেখ উল্লেখ করা হয়, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করতে বাংলাদেশ সরকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের প্রায় ৪৫ বছর পরও যে গণহত্যার বিচার হয়নি, সে বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে চায় বাংলাদেশ। একই সঙ্গে দীর্ঘদিনের বিচারহীনতার সংস্কৃতিও রুখে দিতে চায় বাংলাদেশ। সে অনুযায়ী এ বিচার প্রক্রিয়া চলছে। তবে বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের মানবতাধিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার বিচার নিয়ে পাকিস্তান ক্রমাগতভাবে যেভাবে বিদ্বেষমূলক প্রচার চালাচ্ছে, তা দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের প্রতি একটি বড় ধরনের আঘাত। সূত্র জানায়, মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদ-ের প্রেক্ষিতে পাকিস্তানকে যে কূটনৈতিক পত্র দেয়া হয়েছে, একই ধরনের পত্র অতীতেও একাধিকবার দেয়া হয়েছে। এর আগেও একাধিকবার পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও জাতীয় পরিষদে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখালে তাদের কূটনৈতিক পত্র দেয়া হয়েছিল। সেখানেও বাংলাদেশের একই ধরনের বক্তব্য ছিল। তবে পাকিস্তান সে বক্তব্য আমলে না নিয়ে বারবারই প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক তিক্ত করে চলেছে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধী বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মৃত্যুদ-ে নাখোশ হয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল পাকিস্তান। পাকিস্তানের ওই প্রতিক্রিয়ার প্রতিবাদে দেশটির ঢাকায় নিযুক্ত হাইকমিশনার সুজা আলমকে তলব করে বাংলাদেশ। সে সময় পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে জানিয়ে দেয়া হয়, পাকিস্তান সরকার সরাসরি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। তবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পাকিস্তান সরকার কোনভাবেই যেন আর হস্তক্ষেপ না করে, সে বিষয়ে তাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়। এখন মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদ- ঘিরে দেশটি আবারও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখালো। চলতি বছরের শুরুতেই পাকিস্তান কূটনৈতিক শিষ্টাচার না মেনে একের পর এক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখায়। সে সময় ঢাকা থেকে পাকিস্তানের কোন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করলে পাকিস্তানও ইসলামাবাদে বাংলাদেশ হাইকমিশনের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ তোলে। আবার ঢাকার পাকিস্তানের কোন কর্মকর্তাকে বাংলাদেশ বহিষ্কার করলে পাকিস্তানও ইসলামাবাদের বাংলাদেশ হাইকমিশনের সমপদের কর্মকর্তাকে বহিষ্কার করেছে। এছাড়া ঢাকার পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে তলব করলে পাল্টা ব্যবস্থাস্বরূপ ইসলামাবাদে বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে তলব করা হয়। এছাড়া ঢাকার পাকিস্তান হাইকমিশনের প্রেস বিভাগের এক কর্মকর্তাকে আটকের পর ইসলামাবাদের বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রেস বিভাগের এক কর্মকর্তা সাত ঘণ্টা নিখোঁজ থাকেন। গত বছরের ডিসেম্বরে ঢাকায় পাকিস্তানের কূটনীতিক ফারিনা আরশাদের বহিষ্কারের জের ধরে বাংলাদেশী কূটনীতিক মৌসুমী রহমানকে পাল্টা বহিষ্কার করে পাকিস্তান। মৌসুমী রহমানকে পাকিস্তান থেকে বহিষ্কারের পর ইসলামাবাদ ও করাচীর বাংলাদেশ মিশনের কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে দেশটি ষড়যন্ত্র শুরু করে। বাংলাদেশী কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে অপরাধ খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে যায় পাকিস্তান। সে কারণে বাংলাদেশের ওই দুই মিশনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়। বাংলাদেশের কূটনীতিকরা যেখানেই যান সেখানেই তাদের পিছে পিছে গোয়েন্দাদের গাড়ি গিয়েছিল। আবার বাংলাদেশী কূটনীতিকদের বাড়ির আশপাশেও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়ে দেয় পাকিস্তান। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে পাকিস্তানের কাছে কড়া প্রতিবাদও জানানো হয়। সে সময় পাকিস্তান ভিয়েনা কনভেনশন লঙ্ঘন করেছিল বলেও অভিযোগ করে বাংলাদেশ। কোনভাবেই যেন বাংলাদেশের কূটনীতিকদের হয়রানি না করা হয়, সে বিষয়ে পাকিস্তানকে সতর্ক করে দেয়া হয়। এদিকে, ১৯৭১ সালের অন্যতম শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদ- বহালের ঘটনায় ঢাকা-ইসলামাবাদ পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক ভেস্তে দেয় পাকিস্তান। দুই দেশের মধ্যে গত ১ সেপ্টেম্বর ঢাকায় এ বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। তবে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে হঠাৎ করেই জানিয়ে দেয়া হয়, তারা এ বৈঠকে যোগ দিতে পারছে না। বেশ কয়েক মাস ধরে দুই দেশের মধ্যে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকের প্রস্তুতি চলছিল। ১ সেপ্টেম্বর ঢাকায় এ বৈঠকটি চূড়ান্ত ছিল। এ বৈঠকে যোগ দেয়ার জন্য পাকিস্তানের পক্ষ থেকে নিশ্চিতও করা হয়। সে অনুযায়ী ৩১ আগস্ট ঢাকায় পৌঁছানোর কথা ছিল পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আইজাজ আহমেদ চৌধুরীর। তবে তার আগের দিন ৩০ আগস্ট পাকিস্তানের পক্ষ থেকে হঠাৎ করেই জানিয়ে দেয়া হয়, তারা এ বৈঠকে অংশ নিতে পারছে না। তবে কী কারণে এ বৈঠকে তারা অংশ নিতে পারছে না, তারও কোন ব্যাখ্যা দেয়নি। একাধিক কূটনেতিক সূত্র নিশ্চিত করে, মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদ- বহালের কারণেই পাকিস্তান ওই বৈঠকে যোগদান থেকে বিরত থাকে। সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়ে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া সাজা বহাল থাকায় ১৯৭১ সালের আলবদর নেতা মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়। জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের পর মীর কাশেম ছিলেন আলবদর বাহিনীর তৃতীয় প্রধান ব্যক্তি। তার যোগানো অর্থেই স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী শক্ত ভিত্তি পায়। ১৯৭১ সালে চট্টগ্রামের বিভিন্ন গণহত্যার সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন বলে আদালতে প্রমাণিত হয়েছে।
×