ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

মোরসালিন মিজান ॥ আরও একটি ঈদ। আসন্ন প্রায়। সারা দেশের মতো ঢাকায়ও শুরু হয়ে গেছে প্রস্তুতি। কোরবানির ঈদ যেহেতু, চলছে গরু-ছাগলের খোঁজ। সবচেয়ে বড় ও স্থায়ী হাটটি গাবতলীতে। ক্রেতার উল্লেখযোগ্য অংশ সেদিকে ছুটছে। এখন মিরপুর রোডে গরু-ছাগল নিয়ে বাড়ি ফেরা মানুষের সংখ্যা চোখে পড়ার মতো। বৃহস্পতিবার কল্যাণপুরের বিআরটিসি বাস ডিপোর সামনে কিছু সময় দাঁড়িয়ে মনে হলো, গরু- ছাগল কেনা চলছে পুরোদমেই। হাট থেকে কেউ গরু নিয়ে ফিরছেন। কেউ ফিরছেন ছাগল নিয়ে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেল, ক্রেতাদের একজন রশি হাতে গরুর সামনে। পেছন থেকে অনুসরণ করছেন দুই- তিনজন। সবাই রাখালের ভূমিকায় এবং দারুণ খুশি! রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষ কৌতূহল নিয়ে গরু দেখছেন। জানতে চাইছেন, কত হলো? কতো হলো মানে, দাম কত? গরুর সঙ্গে থাকা মানুষজনও চিৎকার করে দাম বলছেন। যানজটের মাঝেও গরু। খোলা ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। সাব্বির নামের এক তরুণ মাঝারি আকারের একটি গরু নিয়ে ট্রাকে উঠেছিলেন। বললেন, একটু আগেই কিনলাম। আগে কেনার সুবিধা আছে। দাম পড়ছে ৭০ হাজার টাকা। এই গরু কাল-পরশু দেখবেন দাম বাইরা কত হয়া যায়। অবশ্য কয়েকদিনের মধ্যে গোটা শহরেই বসবে পশুরহাট। এরই মাঝে দুই সিটি কর্পোরেশনে স্থায়ী ও অস্থায়ী ভিত্তিতে ২২টি কোরবানি পশুরহাট বসানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে নতুন ৪টিসহ ১৪টি হাট বসার কথা রয়েছে। উত্তর সিটি কর্পোরেশনে বসবে ৮টি পশুরহাট। তার মানে, গোটা শহরেই হাট বসবে। মূল কেনাকাটাও তখন শুরু হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এবার ইলিশের কথা হোক। কোরবানির ঈদ সামনে বটে। ইলিশ হয়ে উঠেছে প্রাসঙ্গিক আলোচনা। কারণ দুটি। প্রথম কারণ, আগামী বুধবার থেকে ইলিশ ধরা যাবে না। দ্বিতীয় কারণ, ঈদে প্রচুর গরু-ছাগল কোরবানি দেয়া হবে। কিন্তু একটানা মাংস খেতে কার ভাল লাগে? তাই বুদ্ধি করে ইলিশ কিনে রাখা। দামটাও একটু সহনীয়। তাই ফ্রিজ ভরে রাখছেন গৃহিণীরা। মাছের বাজারে তো বটেই, গলির মুখেও ইলিশ নিয়ে হাজির হচ্ছেন বিক্রেতারা। গত মঙ্গলবার কর্নফুলী গার্ডেন সিটির পাশ দিয়ে সার্কিট হাউস রোডে প্রবেশ করতেই কানে এলো, ‘দুই কেজি আছে পদ্মা। পদ্মা নেন দুই কেজি।’ কথা শুনে ঘাড় ফেরাতেই চোখ ছানাবড়া! পদ্মা মানে, পদ্মার ইলিশ। বিক্রেতা জানালেন, ১০ কেজির মতো এনেছিলেন। সব বিক্রি হয়ে গেছে। আছে দুই কেজি। বিক্রি করে চলে যাবেন, তাই ডাকছেন। কথা শেষ হলো না। তার আগেই বিক্রেতার সামনে একটি রিকশা এসে থামল। অল্প কথায় দাম দর করে ‘দুই কেজি পদ্মা’ কিনে নিলেন ক্রেতা। দিলু রোডে নবনির্মিত ফ্লাইওভারের নিচেও ইলিশ নিয়ে বসেন বিক্রেতারা। এখান থেকে বুধবার চার কেজি ইলিশ কেনেন স্থানীয় বাসিন্দা ফিরোজ আল মামুন। কোরবানির ঈদের আগে এত ইলিশ দিয়ে কী হবে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইলিশ আমার বাসার সকলেরই খুব পছন্দের মাছ। কিন্তু বুধবার থেকে এই মাছ ধরা যাবে না। দামও বেড়ে যাবে। তাছাড়া সামনে কোরবানির ঈদ। মাংস আর কত খাওয়া যাবে? তাই ইলিশ কিনে রাখছি। দামদর অবশ্য একেক রকমের। কেউ বলেছেন, এক হালি কিনেছি ৭৮০ টাকায়। কেউ বলেছেন, এক হালি কিনেছি ৯০০ টাকায়। ইলিশ শিকার বন্ধ হতেই দাম বেড়ে কয়েকগুণ হয়ে যাবে। তাই কেনায় ব্যস্ত সবাই। গরু কেনার আগে ইলিশ কেনার এই দৃশ্য একটু অন্যরকম বৈকি! ঈদের ছুটি শুরু হয়ে গেছে। বৃহস্পতিবার ছিল শেষ কর্মদিবস। আর শেষ কর্মদিবস মানেই আগেভাগে বাড়ি ফেরার তাড়া। যত আগে যাওয়া যায়, সেই চেষ্টা। সরকারী চাকুরের অনেকেই রাতে বাস টার্মিনালের দিকে ছুটেছেন। সদরঘাটমুখী হয়েছেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে ট্রেন ভ্রমণ অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। আনন্দের। এ কারণে কমলাপুরে ছিল উপচেপড়া ভিড়। রাতে সিলেটগামী উপবন এক্সপ্রেসের যাত্রী আবিদুর রহিম জানালেন, ভূমি মন্ত্রণালয়ে চাকরি করেন তিনি। টিকেট আগেই কাটা ছিল। অফিস শেষ করে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কমলাপুরে এসেছেন। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের ম্যানেজার সিতাংশু চক্রবর্তী জানান, যাত্রীর চাপ বাড়লেও ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক আছে। রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, এবার ঈদযাত্রায় রেলওয়ে প্রতিদিন ২ লাখ ৬০ হাজারের বেশি যাত্রী বহন করবে। কেবল কমলাপুর থেকেই ৩২টি আন্তঃনগরসহ ৬৯টি ট্রেনে দিনে প্রায় ৫০ হাজার যাত্রীকে বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে রেলওয়ে। শেষ করা যাক ভূপেন হাজারিকা জয়ন্তীর প্রসঙ্গ টেনে। বাংলা সঙ্গীতকে বিপুলভাবে সমৃদ্ধ করেছিলেন ভূপেন হাজারিকা। কিংবদন্তি শিল্পীর গান শুধু গান নয়। মানবিক মানুষের কণ্ঠস্বর। এই কণ্ঠে বহুকাল ধরে মুগ্ধ হয়ে আছে বাঙালী। গত কয়েকদিন আগে ছিল কিংবদন্তি শিল্পীর ৯০তম জন্মবার্ষিকী। উপলক্ষটি সামনে রেখে বুধ ও বৃহস্পতিবার ঢাকায় আয়োজন করা হয় দুই দিনব্যাপী ‘ভূপেন হাজারিকা জয়ন্তী’র। ভেন্যু ছিল শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার প্রধান মিলনায়তন। প্রথম দিন সঙ্গীত পরিবেশন করেন ঢাকার শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিল, বুলবুল ইসলাম ও দিল বাহার খান। অসম থেকে এসেছিলেন রূপম ভূঁইয়া। তিনিও ভূপেন হাজারিকার গান গেয়ে শোনান। নাচ পরিবেশন করে সুরঙ্গম নৃত্যদল। এর আগে সকালে ভূপেন হাজারিকার গায়কী ও দর্শন নিয়ে সঙ্গীতবিষয়ক কর্মশালার আয়োজন করে শিল্পকলা একাডেমি। এতে প্রশিক্ষক হিসেবে ছিলেন ভূপেন হাজারিকার ভাতৃবধূ মনীষা হাজারিকা। সমাপনী দিনে বৃহস্পতিবার সঙ্গীত পরিবেশন করে ভারতের লোকগানের দল দোহার। বাংলাদেশের বাউল সাধকদের গান করে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে দলটি। আয়োজনের দ্বিতীয় দিনে তারা ভূপেন হাজারিকার কিছু কালজয়ী গান গেয়ে শোনান। দর্শক সারিতে বসেছিলেন যারা, গানগুলো তাদের জানা। কথাগুলো মুখস্থ। তাই প্রায় প্রতিটি গানের সঙ্গে কণ্ঠ মেলান তারা। এভাবে পুরনো গানগুলো নতুন করে সামনে আসে। কথা-সুরের জাদুতে ভরে ওঠে গোটা মিলনায়তন। আলোচনার কথাও বলতে হয়। দুই দিনের আয়োজনের প্রতিদিনই ছিল দীর্ঘ আলোচনা। প্রথম দিন প্রধান অতিথির বক্তৃতায় সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ভূপেন হাজারিকা মানবতার গান গেয়েছেন। জাগরণের গান গেয়েছেন। সামাজিক অসাম্য-অন্যায়ের বিরুদ্ধে গানে গানে প্রতিবাদ করেছেন। মানুষে মানুষে ভেদাভেদের বিরুদ্ধে বার বার গর্জে উঠেছে তার কণ্ঠ। দেশ-কালের সীমারেখা অতিক্রম করে তার গান আজও মানুষকে আন্দোলিত করে। জাগায়। ভূপেন হাজারিকা কালচারাল ট্রাস্টের উপদেষ্টা অনুরাধা শর্মা পূজারি ট্রাস্টের কাজ সম্পর্কে ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেন। বলেন, ট্রাস্টের উদ্যোগে ভূপেন হাজারিকার ১০০টি গানের স্বরলিপি প্রণয়ন করা হয়েছে। তার লেখা বিভিন্ন গ্রন্থ, সম্মাননা-পুরস্কারগুলো নিয়ে একটি সংগ্রহশালা করা হচ্ছে।
×