ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মিতু হত্যাকাণ্ড

পুলিশের আচরণ রহস্যময়, বাবুলের বিস্ময়কর

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬

পুলিশের আচরণ রহস্যময়, বাবুলের বিস্ময়কর

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রামে সংঘটিত চাঞ্চল্যকর মাহমুদা খানম মিতু হত্যাকা-ে পুলিশের আচরণ যেমন রহস্যময় তেমনি মিতুর স্বামী এসপি পদ থেকে সদ্য অব্যাহতিপ্রাপ্ত বাবুল আক্তারের আচরণও বিস্ময়কর। পেশাগত জীবনে বিভিন্ন অভিযানের সাফল্য নিয়ে বারবার যিনি মিডিয়ার সামনে হাজির হয়ে কথা বলেছেন, স্ত্রী খুন হওয়ার পর তিনি সেই মিডিয়াকর্মীদের থেকে বহু দূরে সরে রয়েছেন। এছাড়া স্ত্রী মিতু হত্যাকা-ের পর বাবুল আক্তার নিজে বাদী হয়ে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানায় যে মামলা করেছেন ওই মামলার তদন্ত দেয়া হয়েছে নগর গোয়েন্দা পুলিশকে। বাবুল আক্তার ওই মামলার অগ্রগতির ব্যাপারে মুহূর্তের জন্যও কোন খোঁজ নেননি বলে সিএমপির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। কেন তার এ ধরনের আচরণ তা রহস্যঘেরা হয়ে আছে। এছাড়া পুলিশের শীর্ষপর্যায় থেকে মিতু হত্যা নিয়ে স্বামী বাবুল আক্তারকে রক্ষা করতে তৎপর, না তাকে ফাঁসিয়ে দেয়ার পথে এগিয়ে দেয়া হচ্ছে তাও রহস্যঘেরা। পুলিশের আইজি একেএম শহীদুল হক একাধিকবার বলেছেন, বাবুল আক্তার স্বেচ্ছায় পদত্যাগপত্র দিয়েছেন। তার জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত পুলিশ সদর দফতর থেকে তার পদত্যাগপত্র স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এর পরবর্তী ঘটনা সরকারী নিয়ম অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির দফতর ঘুরে তার পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়ে গত ৬ সেপ্টেম্বর এ সংক্রান্তে প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে। এতে আবারও আলোচনার শীর্ষে চলে এসেছেন বাবুল আক্তার। সঙ্গে তার স্ত্রী হত্যাকা-ের তদন্ত কার্যক্রমও। বৃহস্পতিবার সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) দেবদাস ভট্টাচার্য সাংবাদিকদের বলেছেন, মিতু হত্যাকা-ের তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট। কিন্তু মামলার বাদী বাবুল আক্তারের ওপর অসন্তুষ্ট। কেননা, বাবুল আক্তার এ হত্যাকা-ের তদন্ত নিয়ে কখনও কোন খোঁজ নেননি, এমনকি সিএমপিতে চাকরি করে যাওয়া এ কর্মকর্তা কারও সঙ্গে যোগাযোগও রাখেননি। সঙ্গত কারণে তার আচরণ বিস্ময়কর মনে করেন সিএমপির কর্মকর্তারা। উল্লেখ্য, গত ৫ জুন সকালে বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু সাত সদস্যের কিলিং মিশন পরিচালিত অভিযানে নৃশংসভাবে খুন হন। এ হত্যাকা- এমন সময়ে সংঘটিত হয় তখন দেশে জঙ্গীপনা নিয়ে সরকার ছিল উৎকণ্ঠায় আর পুলিশ ছিল ধরপাকড় অভিযানে। ঘটনার পরপরই এটি জঙ্গীদের কাজ হিসেবে পুলিশ যেমন বলেছে, তেমনি সাধারণ মানুষও বিশ্বাস করেছে যে, সন্ত্রাস ও জঙ্গীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর জের হিসেবে জঙ্গীরা তার স্ত্রীকে খুন করেছে। কিন্তু পরবর্তীতে এ ঘটনা যে জঙ্গীদের দ্বারা সংঘটিত হয়নি তা প্রমাণিত হয়েছে। কেননা, যারা গ্রেফতার হয়েছে ও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে তাদের অধিকাংশ বাবুল আক্তারের সোর্স হিসেবে কাজ করেছে। এ হত্যাকা- সংঘটিত করার জন্য যে নেতৃত্ব দিয়েছে তার নাম মুসা সিকদার। সে বাবুল আক্তারের প্রধান ও বিশ্বস্ত সোর্স। সে-ই কিলিং মিশনের অন্য সদস্যদের ভাড়ায় এনেছে। এছাড়া ভোলাইয়া নামের অস্ত্র সরবরাহকারীও বাবুল আক্তারের সোর্স। এখন এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত গ্রেফতারকৃত ছয়জনের মধ্যে দু’জন বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে। আর বাকি চারজন জেলে রয়েছে। পলাতক রয়েছে আরও দু’জন। হত্যাকা-ে নেতৃত্বদানকারী বাবুল আক্তারের সোর্স মুসা সিকদারকে গ্রেফতার করেছে বলে দাবি রয়েছে তার স্ত্রী পান্নার। কিন্তু পুলিশ বলেছে সে পলাতক। তাকে খোঁজা হচ্ছে। পাওয়া গেলে আসল রহস্য বেরিয়ে আসবে। মূলত বিভিন্ন তথ্যমতে, মুসা গুম হয়েছে। সেজন্য মুসাতে গিয়ে মিতু হত্যাকা- থমকে আছে। অপরদিকে, বাবুল আক্তার স্ত্রী হারানোর বেদনায় ব্যথিত থাকলেও ঢাকায় বসে হত্যাকা-ের পর থেকে এসপি পদের চাকরিটি ফিরে পাওয়ার তৎপরতাই চালিয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছেন। এখন তিনি আর পুলিশে নেই। তার অবস্থা এখন এমন যে, একূল-ওকূল দু’দিকই তিনি হারিয়েছেন। পুলিশের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারাই নিশ্চিত করে থাকেন, বাবুল আক্তারই তার স্ত্রী হত্যায় নেপথ্যের নায়ক। তাকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে আনলেই প্রকৃত তথ্য উন্মোচিত হবে। মুসা কোন ফ্যাক্টর নয়। মুসা ছিল টাকার বিনিময়ে হুকুম পালনের গোলাম। সে তা-ই করেছে। গ্রেফতারকৃত ভোলাইয়া, ওয়াসিমসহ চারজনই পুরো বিষয়টি জানে। তবে এদের মধ্যে যে দু’জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে তারা মুসা পর্যন্ত গিয়ে থেমে গেছে। এসবই পরিকল্পিতভাবে হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া অস্ত্র যোগানদাতা ভোলাইয়ার কোন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী মেলেনি। অথচ তার সরবরাহকৃত অস্ত্র দিয়েই মিতুকে হত্যা করা হয়েছে। এখন সাধারণ মানুষের চেয়ে পুলিশের বিভিন্ন সূত্রে এ বিষয়ে বিভিন্ন বক্তব্য দেয়া হচ্ছে নাম প্রকাশ না করে। বাবুল আক্তার মামলার বাদী হয়ে স্ত্রী হত্যাকারীকে অজ্ঞাতনামা বলে এফআইআরে উল্লেখ করেছেন। অথচ তিনজনকেই তিনি ভালভাবেই চেনেন। এদের মধ্যে নেতৃত্বদানকারী মুসাও রয়েছে। এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, আইজি তার ওপর ক্ষুব্ধ এ কারণে যে, তিনি এ তিন হত্যাকারীকে চেনার কথা জানান দিলে দেশব্যাপী যে জঙ্গীবিরোধী অভিযান তাৎক্ষণিকভাবে পরিচালনা করা হয় তাতে বহু কাঠখড় পুড়েছে। এছাড়া ঘটনার পর ২৪ জুন বাবুল আক্তারকে ঢাকায় গোয়েন্দা দফতরে নেয়ার পর তিনি দীর্ঘক্ষণ সত্য প্রকাশ করেননি। জিজ্ঞাসাবাদে বারবার বলেছেন, কারা করেছে তা তিনি জানেন না, চেনেন না। অথচ তিনি জানেন এবং চেনেনও, যা পরবর্তীতে সিসিটিভি ফুটেজ দেখানোর পর তিনি সত্য স্বীকার করেছেন। এসব নাটক করার ফলে তার ওপর ক্ষেপে যান আইজিপিসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা। কিন্তু পুলিশের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে এবং অদৃশ্য শক্তির ইশারায় বাবুল আক্তারকে গ্রেফতার করার সিদ্ধান্ত নিয়েও ছাড় দেয়া হয়। পদত্যাগ করে চলে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়। এ পদত্যাগপত্র ২৪ জুন রাতেই নেয়া হয়। বাবুল আক্তার তাতে স্বেচ্ছায় স্বাক্ষর করেছেন। কিন্তু এখন বলছেন, তিনি এতে স্বেচ্ছায় স্বাক্ষর করেননি। বাধ্য হয়েছিলেন, যে কারণে পরবর্তীতে তিনি তার ওই পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করে চাকরিতে যোগ দেয়ার আবেদন জানিয়েছিলেন। ওই আবেদন প্রধানমন্ত্রী নাকচ করে দিয়েছেন। পুলিশের আরেক সূত্র জানায়, মিতু হত্যাকা-ের পর বাবুল আক্তারকে নিয়ে মিডিয়াসহ বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী দুটি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে তদন্ত করিয়েছেন। দুটি রিপোর্টই বাবুল আক্তারের পক্ষে যায়নি। ওই সব রিপোর্টে বাবুল আক্তারের শিক্ষাজীবন শেষ করে পুলিশ বিভাগে যোগদানের পূর্ববর্তী সময়ে তার রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা, বিভিন্ন কর্মকা- সবই উঠে এসেছে। এছাড়া মিতু হত্যাকা-ে গ্রেফতারকৃতদের পক্ষে পুলিশের কাছে দেয়া বক্তব্যও ভিডিওচিত্রে বিস্তারিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অবহিত করা হয়, যার সারমর্ম প্রধানমন্ত্রী পেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের সারমর্ম ও গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট মিলিয়ে যে তথ্য পান তা বাবুল আক্তারের বিপক্ষে চলে যায়। আর এতেই শেষ পর্যন্ত তার কোন আবেদনে সরকার সাড়া দেয়নি। পদত্যাগপত্রই গ্রহণ করে প্রজ্ঞাপন জারির পক্ষে সিদ্ধান্ত হয়। এখন বিভিন্নভাবে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে, মিতু হত্যার বাদী বাবুল আক্তার কখন যে আসামি হয়ে যায় তা নিয়ে। কারণ, ইতোমধ্যেই আইজিপি ও সিএমপির কর্মকর্তাদের অনেকে গণমাধ্যমকর্মীদের বলেছেন, তদন্তে বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে অবশ্যই তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। ইতোমধ্যে মিতু হত্যকা- নিয়ে মিতুর মা যেই দোষী হোক তার বিচারের দাবি জানিয়েছেন। তবে বাবুল আক্তারের পিতা বলেছেন, তার ছেলেকে ফাঁসানোর চেষ্টা চলছে। অথচ পুলিশ সূত্রগুলো বলছে, বাবুল আক্তার এখনও যে মুক্ত রয়েছেন সেটাই বিস্ময়কর। কেননা, মিতু হত্যার পর গ্রেফতারকৃত আসামিরা যে তথ্য দিয়েছে তা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী হিসেবে রেকর্ড হলে বাবুল আক্তারের রক্ষা পাওয়ার কোন সুযোগ মিলবে না।
×