ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নিরক্ষরমুক্ত দেশ গড়তে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬

নিরক্ষরমুক্ত দেশ গড়তে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শতভাগ নিরক্ষরমুক্ত দেশ গড়তে সকল শ্রেণী-পেশার নাগরিককে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, সবার অংশগ্রহণেই দ্রুততম সময়ের মধ্যে আমরা দেশকে নিরক্ষরমুক্ত ঘোষণা করতে পারব। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সকলের উদ্যোগেই আমরা এদেশকে নিরক্ষরমুক্ত ঘোষণা করতে পারব, যদি সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে স্ব স্ব এলাকার নিরক্ষর লোকদের শিক্ষিত করে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রী বৃহস্পতিŸার সকালে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ‘আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস ২০১৬’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন। খবর বাসসর। প্রধানমন্ত্রী দেশকে নিরক্ষরমুক্ত করতে ছাত্রসমাজ, শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক দল ও তাদের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে আমরা দেশে সাক্ষরতার হার ৭১ শতাংশে উন্নীত করতে সমর্থ হয়েছি। সমগ্র দেশে আমাদের জনপ্রতিনিধিরা আছেন, রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা আছেন, পাশাপাশি সরকারী-বেসরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বিভিন্ন শ্রেণীপেশার নাগরিক রয়েছেন; প্রত্যেকেই যদি উদ্যোগ নেন, তা হলেই আমরা আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব। এবং জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সক্ষম হব। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশটা আমাদের, আমাদেরই এ দেশকে গড়ে তুলতে হবে- যাতে আমরা মর্যাদার সঙ্গে চলতে পারি। দেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলতে এবং দারিদ্র্যমুক্ত করতে শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রাধমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজারের সভাপতিত্বে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব মোহাম্মদ আসিফউজ্জামান এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক রুহুল আমিন সরকার অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভার একটি শুভেচ্ছা বাণীও পড়ে শোনানো হয়। তিনি বলেন, আমি শিক্ষকদের উদ্দেশে বলব, আপনারা একটা মহৎ পেশায় আছেন। জাতির পিতা প্রায়ই বলতেন ‘সোনার বাংলা গড়ার জন্য সোনার মানুষ চাই।’ আপনারা হচ্ছেন সেই মানুষ গড়ার কারিগর। তিনি বলেন, আপনারা পারেন-নীতি ও মূল্যবোধের চর্চা শিখিয়ে দেশের প্রতিটি শিশুকে আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে। ভাল-মন্দ কিংবা ন্যায়-অন্যায় বিবেচনার জ্ঞান এবং দেশাত্মবোধের শিক্ষা দেয়া আপনাদের দায়িত্ব। সরকারে শিক্ষা সম্প্রসারণের উদ্যোগ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দীর্ঘ ২১ বছর পর ’৯৬ সালে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিলাম। আমাদের পদক্ষেপের ফলে মাত্র দু’বছরে সাক্ষরতার হার ৪৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬৫ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়ায়। এ অর্জনের স্বীকৃতি হিসাবে বাংলাদেশ ‘ইউনেস্কো সাক্ষরতা পুরস্কার ১৯৯৮’ লাভ করে। কিন্তু পরবর্তীতে বিএনপি-জামায়াত জোটের ২০০১-২০০৬ শাসন আমলে সাক্ষরতার হার বাড়েনি। উল্টো কমে ৪৪ শতাংশে নেমে যায়। বর্তমানে দেশে সাক্ষরতার হার ৭১ শতাংশ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অক্ষর জ্ঞানহীন মানুষ দৃষ্টিশক্তি থাকতেও এক ধরনের দৃষ্টিহীনতায় ভোগেন। তাই সবার মনের-জ্ঞানের চোখ খুলে দিতে, আপন ভাল-মন্দ বুঝে নিতে আমরা ব্যাপকভিত্তিক সাক্ষরতা কার্যক্রম গ্রহণ করেছি।’ তিনি প্রতিবছর ১ জানুয়ারি দেশব্যাপী বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, আমরা গত ৭ বছরে বিনামূল্যে ১৯৩ কোটি বই বিতরণ করেছি। গত ১ জানুয়ারি ২০১৬ দেশব্যাপী ‘বই উৎসব’ পালিত হয়েছে। প্রাথমিক ও গণমুখী শিক্ষার প্রসারে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন,তার সরকার ২০১০ সালে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছে। যেখানে প্রাথমিক শিক্ষা-শিক্ষার্থীর মানসিক বিকাশ, আচরণ ও ভাষা শিখানোর মৌলিক স্তর হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। মাধ্যমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত বৃত্তি-উপবৃত্তি চালুর কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে দেড় হাজার দরিদ্র-মেধাবী ছাত্রছাত্রীকে বৃত্তি দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ১০০০ কোটি টাকার সীড মানি দিয়ে ‘প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট’ গঠন করেছি। এখান থেকে প্রাথমিক হতে ডিগ্রী পর্যন্ত ১ কোটি ২৮ লাখ ছাত্রছাত্রীকে বৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। সারাদেশের ৪ হাজার ৯০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম চালু করতে ল্যাপটপ ও মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরসহ সরঞ্জাম দেয়া হয়েছে। এখন দেশে উপবৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্খীর সংখ্যা ১ কোটি ৩০ লাখ। ২০১০ সালে উপবৃত্তিপ্রাপ্তের সংখ্যা ৪৮ লাখ থেকে প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়ে ৭৮ লাখ করেছি। শেখ হাসিনা বলেন, ৪৫২ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘মৌলিক সাক্ষরতা প্রকল্প ৬৪ জেলা’ নামে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদ ২০১৪ সালে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উন্নীত করার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সহকারী শিক্ষকের বেতন একধাপ বাড়ানো হয়েছে। তিনি বলেন, ছাত্রছাত্রী ঝরেপড়ার হার আমরা ২৪ শতাংশে নামিয়ে এনেছি। বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে ২০০৭ সালে ঝরেপড়ার হার ছিল ৫০ দশমিক ৫ শতাংশ। ঝরেপড়া রোধে মিড ডে মিল চালুর জন্য সমাজের বিত্তবানদের তিনি এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘মিড ডে মিল কর্মসূচী ৯৬টি দারিদ্র্যপীড়িত উপজেলার ৩৩ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে চালু করেছি। স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে পর্যায়ক্রমে সকল স্কুলে মিড ডে মিল চালু করা হবে।’ শিশু কল্যাণ ট্রাস্ট এবং আনন্দ স্কুল প্রতিষ্ঠায় সরকারের উদ্যোগ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শিশু কল্যাণ ট্রাস্টের আওতায় ৯১টি ‘শিশু কল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করেছি। এসব বিদ্যালয়ে ছাত্র সংখ্যা ২০ হাজার। এদের প্রাথমিক স্তরে ৬০০ ও মাধ্যমিক স্তরে ৮০০ টাকা করে প্রতিমাসে বৃত্তি দেয়া হয়। তিনি বলেন, দেশের ৫২টি জেলার ১৪৮টি উপজেলায় ১ হাজার ১৪০ কোটি ২৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ১২ হাজার ৫৬৭টি ‘আনন্দ স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেছি। শেখ হাসিনা বলেন, আনন্দ স্কুলে বিনামূল্যে বই দেয়ার পাশাপাশি বিনামূল্যে পোশাক ও উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। বর্তমানে আনন্দ স্কুলে ছাত্রছাত্রী সংখ্যা ৩ লাখ ৪২ হাজার ১৩৬। তিনি বলেন, প্রাথমিক স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিষয়ে ধারণা দিতে ‘সুস্বাস্থ্যে-সুশিক্ষা’ কর্মসূচী গ্রহণ করেছি। ৩৯ হাজার ৩০৩টি গভীর নলকূপ স্থাপন পরিকল্পনার আওতায় ২৫ হাজার ৬২১টি স্থাপন করা হয়েছে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত হ্রাস পেয়েছে। শারীরিক ও মানসিক বিকাশ এবং ক্রীড়ানৈপুণ্য বাড়াতে প্রাথমিকে ছাত্রদের জন্য বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ এবং ছাত্রীদের জন্য বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১০ সাল থেকে প্রতিটি বিদ্যালয়ে ‘স্টুডেন্টস কাউন্সিল’ গঠিত হচ্ছে। তাদের প্রশিক্ষণের জন্য কক্সবাজারে ‘লিডারশিপ ট্রেনিং সেন্টার’ নির্মিত হচ্ছে। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য হুইল চেয়ার, হিয়ারিং এইড ও ক্র্যাচসহ অন্যান্য সরঞ্জাম প্রদান করা হচ্ছে। শেখ হাসিনা বলেন, আমি জাতির পিতার কর্মকা- ও চিন্তাভাবনা অনুসরণ করে একটা কথা বলি Ñশিক্ষা সুযোগ নয়, শিক্ষা অধিকার। শিক্ষাই পারে দারিদ্র্য মুক্ত, আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ গড়তে। দেশে এখন প্রাথমিক শিক্ষাসহ সব ধরনের শিক্ষার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণের ৪০ বছর পর আমিই ২০১৩ সালে দেশের ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেছি।’ তিনি বলেন, সেদিন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১ লাখ ৩ হাজার ৮৪৫ শিক্ষকের চাকরি সরকারীকরণের ঘোষণা দিয়েছিলাম। আমরা ঘোষিত পদের চেয়ে ৫ হাজার বাড়িয়ে ১ লাখ ৮ হাজার ২০০ শিক্ষকের চাকরি সরকারী করেছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শিক্ষার মাধ্যমে আমরা জাতিকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে এনেছি। সারা বিশ্বে শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ কম বলে ছেলেমেয়ে সমতা আনার কথা বলা হয়। আর আমাদের দেশে উল্টো। এখানে মেয়েদের সংখ্যা বেশি বলে এখন ছেলেদের এগিয়ে আনতে হবে।’ তিনি ছাত্রছাত্রীদের মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার আহ্বান জানিয়ে বলেন, বইপত্র সাজিয়ে রাখার বস্তু না, তোমাদের পড়তে হবে। জ্ঞান অর্জন করতে হবে। আগামীতে তোমাদের মধ্য থেকেই দেশের নেতা, প্রধানমন্ত্রী হবে। কাজেই সেভাবেই নিজেদের তৈরি করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানের বক্তৃতা পর্ব শেষে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও উপভোগ করেন।
×