ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

কালের সাক্ষী ময়মনসিংহ সার্কিট হাউস

দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশৈলী ক্যানভাসে তৈলচিত্র রোমান্টিকতা

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬

দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশৈলী ক্যানভাসে তৈলচিত্র রোমান্টিকতা

বাবুল হোসেন ॥ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের জেলা ময়মনসিংহে প্রায় দু’শ’ বছরের প্রাচীন ও দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে সার্কিট হাউস ভবন। ব্রহ্মপুত্র পাড়ের প্রাচীন এই ঐতিহাসিক নিদর্শনটির ভেতর-বাইরের অপার সৌন্দর্য পর্যটকদের প্রতিনিয়ত হাতছানি দিয়ে ডাকছে। সারি সারি পামট্রিসহ অসংখ্য গাছগাছালি বেষ্টিত ছায়াশীতল পরিবেশের অসাধারণ স্থাপত্যশৈলীর এই সার্কিট হাউস ভবনের ভেতরের হলরুমে ব্রিটিশ শিল্পীদের ক্যানভাসে আঁকা দুর্লভ সব তৈলচিত্রের প্রকৃতি ও রোমান্টিক ছবি দেখে যে কেউ বিমোহিত হবেন। এককালের রাজা মহারাজাদের শহর ময়মনসিংহে ঐতিহাসিক এসব নিদর্শন দেখতে নতুন প্রজন্মসহ দেশ-বিদেশের অনেকে ভিড় জমাচ্ছেন। ফলে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হাজারো স্মৃতি বিজড়িত কিংবদন্তীতূল্য এই ঐতিহাসিক লাল রংয়ের ভবনটি। প্রয়াত আহমদ তৌফিক চৌধুরীর শহর ময়মনসিংহের ইতিকথা থেকে জানা যায়, প্রাচীন জেলা ময়মনসিংহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৭৮৭ সালের ১ মে তারিখে। প্রথমে বেগুনবাড়িতে এর সদরদফতর স্থাপিত হলেও ব্রহ্মপুত্রের ভয়াবহ আগ্রাসন আর ভাঙ্গনের কারণে সেটি স্থানান্তর করে আনা হয়েছিল শহরের সেহরা মৌজায়। আরও পরে জেলা কালেক্টরের এই ভবন নিয়ে আসা হয় সার্কিট হাউস মাঠ সংলগ্ন বর্তমান স্থানে। এর বেশ কয়েক বছর পরে স্থাপন করা হয় ময়মনসিংহ সার্কিট হাউস ভবন। তবে কবে কখন এটি নির্মাণ করা হয় ও কে এর উদ্যোক্তা ছিলেন তা জানা না গেলেও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক যতীন সরকার জানান, বর্তমান স্থানে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় স্থাপনের বেশ কয়েক বছর পর ব্রিটিশ জমানায় নির্মাণ করা হয় ময়মনসিংহ সার্কিট হাউস ভবন। শহরের বিশাল সার্কিট হাউস মাঠের পাশে ব্রহ্মপুত্র পাড়ের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা ও জয়নুল উদ্যান সংলগ্ন স্থানে সার্কিট হাউসের অসাধারণ স্থাপত্যশৈলী একে দৃষ্টিনন্দন ও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। একতলা ভবনের সামনে বিশাল মাঠের একপাশে রয়েছে সারি সারি পামট্রিসহ অসংখ্য বৃক্ষরাজি। মূল ভবনের চমৎকার ভেন্টিলেশন আর এর চারপাশের ছায়াশীতল পরিবেশ প্রতিনিয়ত সার্কিট হাউসকে হীম শীতল করে রাখছে। একতলা সার্কিট হাউসের সামনের ফটকের পিলার ও দু’পাশের কক্ষগুলোর নির্মাণশৈলীতেও অপার সৌন্দর্য ও আধুনিকতার ছাপ স্পষ্ট। মূল ভবনের দু’পাশে প্রথমে সিকিউরিটি ও গার্ডরুম পেরিয়ে হলরুল ও ডাইনিং স্পেস। এর পেছনে দু’পাশে রয়েছে চাঁদনি, চামেলি নামের ভিআইপিসহ পাঁচটি রুম। তারও পেছনের সম্প্রসারিত অংশে রয়েছে শাপলা, শালুক, শিমুল, শিউলি, পলাশ, বকুল ও চম্পা নামে ভিভিআইপিসহ সাতটি রুম। সার্কিট হাউসের ফটকে ব্যবহার করা হয়েছে দামী মার্বেল পাথর ও ভেতরে আধুনিক টাইলস। সম্প্রতি সার্কিট হাউসের পুরো মেঝেয় টাইলস বসানো হয়েছে। সার্কিট হাউসের বাইরের সুন্দর স্থাপত্যশৈলীর সঙ্গে অসাধারণ সমন্বয় দেখা গেছে এর ভেতরের হলরুমে রাখা তিনটি দুর্লভ তৈলচিত্রে। দেখতে কাঠ কিংবা পাথরের ফ্রেম মনে হলেও আসলে প্যারিস অব প্লাস্টারের ফ্রেম ব্যবহার করে ক্যানভাসের ওপর আঁকা হয়েছে অসাধারণ সব ছবি। এসব ছবিতে নির্জন প্রকৃতি, ন্যাচারাল লেক, দিগন্তে ডুবে যাওয়া সূর্যাস্ত থেকে শুরু করে ফুল পাখি পাহাড় ও প্রেমিক যুগলের রোমান্টিক ছবির নিখুঁত প্রতিফলন মেলে ধরা হয়েছে। এর কোনটিতে রয়েছে আদিম যুগের প্রেমিক যুগল, কোনটিতে ইউরোপিয়ান স্টাইলের আধুনিক প্রেমিক যুগলের রোমান্টিক দৃশ্য। ক্যানভাসের ওপর তেল রংয়ে আঁকা দুর্লভ সব ছবিতে আদি থেকে আধুনিক ধারার সঙ্গে প্রকৃতির আলো আঁধারিকে উপস্থাপন করা হয়েছে নিখুঁত ও অসাধারণভাবে। এর বাইরে নগ্ন বসনার নারী মূর্তিকে নাচের ভঙ্গিতে উপস্থাপন করা হয়েছে চমৎকারভাবে। পুরনো জীর্ণ কোন রাজবাড়ির লেকের ভেতর পাকা ঘাটের ফটকে খোদিত রয়েছে মানুষ ও প্রকৃতির ছবি। একই ছবিতে পাহাড় ও আকাশের মিতালিকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে অসাধারণভাবে। আছে সূর্যাস্তের সঙ্গে লেকের ভেতরের শানবাঁধানো ঘাটে রাজকুমারী ও মেষপালকের রোমান্টিক চিত্র। প্রতিটি ছবিতে তেলের সঙ্গে রংয়ের ব্যবহার ও সমন্বয় চোখে পড়ার মতো। আনুমানিক দেড়শ’ বছরের প্রাচীন এসব তৈলচিত্র এখনও রঙিন ও প্রাণবন্ত। দুর্লভসব ছবির শিল্পীদের নাম জানা না গেলেও স্থানীয় গবেষকদের মতে এসব ছবি ব্রিটিশ কোন শিল্পীর আঁকা। ব্রিটিশ আমলে ময়মনসিংহের কিংবদন্তীর রাজ পরিবার এসব ছবি সংগ্রহ করেছিলেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ময়মনসিংহে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহ শালার উপ কিপার ড. বিজয় কৃষ্ণ বণিক জানান, আলো ও আর্দ্রতার হেরফের হলে ক্যানভাসের ওপর আঁকা তৈলচিত্রের এসব ছবি বিনষ্ট হতে পারে। এজন্য এসব ছবি সংরক্ষণ করা জরুরী বলে মত দেন এই শিল্পবোদ্ধা। স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, আশি থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত সার্কিট হাউসের ভেতরে হলরুম ও ডাইনিংয়ে আরও ৩টি দুর্লভ তৈলচিত্র ছিল। কিন্তু পরে সেটি খোয়া গেছে। সর্বশেষ সার্কিট হাউস ফটকের সামনে পিতলের তৈরি বিশালাকার একটি টবে ছিল পামট্রি। কিন্তু পিতলের তৈরি সেই টবটিও এখন আর নেই! কড়া নিরাপত্তা বেস্টনির ভেতরে থাকা সার্কিট হাউস থেকে মূল্যবান এসব সামগ্রী কীভাবে খোয়া যাচ্ছে এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয় সচেতন মহল।
×