ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬

লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক

অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম রফিক ॥ পবিত্র হিজায ভূমিতে মজনু হজযাত্রীগণ আর ক’দিন পরই তাদের হজের এক একটি রুকন সম্পন্ন করবেন। এ হজ অনুষ্ঠানমালার একটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। সর্বপ্রথম হজ করেন হযরত আদম (আ)। হজের পূর্ণনা আনেন নবী ইব্রাহীম ও তার সন্তান ইসমাঈল (আ)। আল্লাহর নির্দেশে জিব্রাঈল (আ) কর্তৃক প্রদর্শিত পন্থায় দু’সম্মানিত নবী ইব্রাহীম ও ইসমাঈল হজ পালন করেন। তারপর থেকে মুসলিম উম্মাহ সে নিয়ম-রীতির অনুকরণে হজ পালন করে আসছে। তখন ইব্রাহীমের (আ) প্রতি আল্লাহর নির্দেশ হলোÑ এবং মানুষের প্রতি আপনি হজ পালনের প্রকাশ্য আহ্বান জানান, তারা হেঁটে কিংবা দূরবর্তী স্থান হতে কৃশ উটের পিঠে চড়ে আসুক। এখানে এসে তারা যেন দেখতে পায় তাদের জন্য দ্বীন-দুনিয়ার কল্যাণে কত সুন্দর ব্যবস্থা রয়েছে...।” (হজ-২৬) জাতির পিতা ইব্রাহীম (আ) এর ডাকে সাড়া দিয়ে মানবকূলের এক বিরাট অংশ তৌহিদের নির্মল আলোয় উদ্ভাসিত হলো। তার পরবর্তী সকল নবীও স্ব স্ব উম্মতরা হযরত ইব্রাহীমের (আ) প্রদর্শিত দ্বীনে হানিফকে আঁকড়ে ধরে ছিলেন, ইসলামী ভাবগম্ভীর পরিবেশে আদায় করতেন পবিত্র হজ। কিন্তু পরবর্তী কয়েক শতাব্দীর মধ্যেই তারা সে পূর্ববর্তী মহাপুরুষদের শিক্ষা ও প্রদর্শিত পথ ভুলে গিয়েছিল এবং অন্যান্য জাহেল জাতির ন্যায় সর্বপ্রকার গুমরাহী ও পাপ প্রথার প্রচলন করেছিল। যে কাবাঘরকে কেন্দ্র করে এককালে এক আল্লাহর ইবাদতের দাওয়াত ও প্রচার শুরু হয়েছিল সে কাবা ঘরে জাহেলরা অবতারণা করল নানা আজব ও বিকৃত কর্মকা-ের। তারা সেখানে অহরহ খোদার নাফরমানিতে মত্ত থাকত। এক শ্রেণীয় পুরোহিত, পাদ্রি সর্বপ্রকার কলাকুশল অবলম্বন করে আরবের বিভিন্ন স্থান হতে আসা লোকজন হতে নজর নিয়ায ও ভেট-বেগাড় আদায় করত। শত শত নবীদের স্মৃতি বিজড়িত, ইব্রাহীম-ইসমাঈলের (আ) পবিত্র স্পর্শে ধন্য, পুণ্যভূমি মক্কায় শুরু হলো হজের নামে সীমাহীন বেহায়াপনা নগ্নতা ও নোংরামি। সেখানে বসত বার্ষিক মেলা। আরবের বড় বড় বংশ ও গোত্রের লোকেরা তথায় দল বেঁধে আস্তানা তৈরি করত। প্রত্যেক গোত্রের কবি ‘কথক’ নিজ নিজ গোত্রের খ্যাতি, বীরত্ব, শক্তি, সম্মান ও বদান্যতার প্রশংসায় আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তুলত। প্রত্যেক গোত্রপ্রধান নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার জন্য ডেগ চড়াত এবং অন্যকে হেয় করার উদ্দেশে উটের পর উট জবেহ করত। এসব সম্মেলনে নাচ-গান, মদ্যপান, ব্যভিচার এবং সকল প্রকার নির্লজ্জ কাজকর্মের অনুষ্ঠান বিশেষ জাঁকজমকের সঙ্গে সম্পন্ন হতো। কাবা ঘরের চতুর্দিকে তাওয়াফ করত। কিন্তু তার পদ্ধতি এতো বিকৃত হয়ে গিয়েছিল যে, নারী-পুরুষ সকলেই উলঙ্গ হয়ে একত্রে ঘুরতো আর বলত- আমরা আল্লাহর সামনে এমনাবস্থায় যাব, যেমন অবস্থায় আমাদের মা আমাদের প্রসব করেছে।’ হযরত ইব্রাহীম (আ)-এর প্রতিষ্ঠিত মসজিদে ‘ইবাদত’ (?) করা হতো এ কথা ঠিক; কিন্তু কিভাবে? খুব জোরছে হাততালি দেয়া হতো, বাঁশি বাজানো হতো, দেয়া হতো শিংগায় ফুঁৎকার। আল্লাহর নামও যে সেখানে নেয়া হতো না, এমন নয়। কিন্তু কি রূপে? তারা বলত-‘আমি এসেছি, আমি এসেছি হে আল্লাহ। আমি এসেছি, তোমার কেউ শরিক নেই- কিন্তু যে তোমার আপন, সে তোমার অংশীদার। (নাউজুবিল্লাহ) তুমি তারও মালিক এবং তার মালিকানারও মালিক।’ আল্লাহর নামে সেখানে কোরবানিও দেয়া হতো। কিন্তু তার পন্থা ছিল কত নিকৃষ্ট ঔদ্ধত্যপূর্ণ! কোরবানির রক্ত কাবা ঘরের দুয়ারে ফেলে রাখত। কারণ, তাদের ধারণা মতে, আল্লাহ এসব রক্ত ও গোস্ত তাদের কাছ থেকে কবুল করেছেন। এরূপ ঘোর অন্ধকারাচ্ছন্ন অবস্থায় কমবেশি দু’হাজার বছর পর্যন্ত ছিল। এ দীর্ঘ সময়ে আরব দেশে কোন নবীর আবির্ভাব হয়নি। আর কোন নবীর প্রকৃত শিক্ষাও সে দেশে পৌঁছেনি। অবশেষে সাইয়্যিদেনা হযরত ইব্রাহীম (আ)-এর দোয়া পূর্ণ হবার সময় ঘনিয়ে এলো। তিনি কাবা ঘর প্রতিষ্ঠার সময় আল্লাহর নিকট দোয়া করেছিলেন - আল্লাহ হে! এদেশে একজন নবী এ জাতির মধ্য হতেই প্রেরণ কর, যে এসে তাদের তোমার বাণী শোনাবে; জ্ঞান ও প্রজ্ঞা শিক্ষা দেবে এবং সংশোধন করবে তাদের নৈতিক চরিত্র।’-এ দোয়া আল্লাহর নিকট মঞ্জুর হয়েছিল, তাই তারই অধঃস্তন পুরুষে একজন ‘কামেল ইনসান’ আবির্ভূত হলেন, যার পাক নাম মুহাম্মদ (সঃ) ইবনে আবদুল্লাহ। তিনি এসে হযরত ইব্রাহীম খলিলুল্লাহর মতো সমস্ত কুসংস্কারে করলেন কুঠারাঘাত। নির্ঞ্ঝাট ও নিষ্কলুষ ইব্রাহীমের নীতিতে হজ অনুষ্ঠানকে পুনরায় দাঁড় করালেন দুনিয়াবাসীর সামনে। তিনি সমগ্র বিশ্ববাসীকে বুঝিয়ে দিলেন- (আল্লাহর স্মরণ এবং ইবাদত করার) যে পন্থা আল্লাহ তোমাদের জানিয়ে দিয়েছেন, ঠিক সে অনুযায়ী আল্লাহর স্মরণ ও ইবাদত কর। যদিও ইহার পূর্বে তোমরা পথভ্রষ্ট ছিলে। বাকারা- ১৯৮।’ সকল অন্যায় ও বাজে কর্মতৎপরতা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হলো। হজ উপলক্ষে কোনরূপ ব্যভিচার অশ্লীলতা, আল্লাহদ্রোহিতা, ফাসেকি কাজ এবং ঝগড়া-বিবাদ বা যুদ্ধ-বিগ্রহ করা যাবে না।’-বাকারা ১৯৭। ৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের পর মুসলমানগণ প্রথম হজব্রত পালন করেন। ৯ম হিজরীতে হযরত রাসূলুল্লাহ (স) বিশেষ কারণে হজে গমন করতে পারেননি। নবী করিম (স) আবু বকর সিদ্দিককে (রা) ‘আমীরুল হজ’ নিয়োগ করেন। পরবর্তী বছর ১০ম হিজরী সনে আল্লাহর একত্ববাদের সর্বশেষ নিশানবরদার হুজুর আকরাম (স) লক্ষাধিক আল্লাহ প্রেমিক ভক্ত-অনুরক্ত পরবেষ্টিত ‘বিদায় হজ’ সম্পাদন করেন। শিরক-কুফরের কালিমামুক্ত হযরত ইব্রাহীম (আ)-ইসমাঈল (আ)-মুহাম্মদ (স)-এর প্রবর্তিত পাক পবিত্র হজ পালনের মানসে সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পার হয়ে আজও প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রাণ মুসলমান মক্কা নগরীতে লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েকের সুমধুর গুঞ্জন ধ্বনি ও মর্মস্পর্শী সুরে মরু আরবে বেহেশতি সৌরভ বিকিরণ করে থাকে। কতই না সুন্দর সে আকুল করা-ব্যাকুল করা দৃশ্য!
×