রশিদ মামুন, কলাপাড়া, পায়রা থেকে ফিরে ॥ দক্ষিণে আন্দারমানিক পূর্বে রামনাবাদ আর দক্ষিণ-পশ্চিমে টিয়াখালি। এই তিন নদীর ঠিক মাঝখানে মধুপাড়া, নিশানবাড়িয়া, দশরহাউলা, মরিচ বুনিয়া গ্রাম। একেবারে অজপাড়াগাঁও। না আছে পাকা রাস্তা না কোন আধুনিকতার ছোঁয়া। এর মধ্যে দিগন্ত বিস্তৃত জমিতে বালু ফেলা হয়েছে। একসঙ্গে কয়েক শ’ মানুষ কাজ করছেন, দম ফেলার যেন সময় নেই। শুধু দেশী নয় ২শ’ জনের মতো চীনাও রয়েছেন। শুধু দিনে নয়, কাজ চলে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা। এ কর্মযজ্ঞ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় দেশের তৃতীয় সমুদ্রবন্দর পায়রার কাছেই নির্মাণ করা হচ্ছে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের কয়লাচালিত বিদ্যুত কেন্দ্র। বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড বিদ্যুত কেন্দ্রটি নির্মাণ করছে। দেশের বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন ঘিরে নতুন স্বপ্নের জাল বোনা হচ্ছে। আর এখানে দেশের প্রথম বড় কয়লাচালিত বিদ্যুত কেন্দ্র ঘিরে উন্নয়নের স্বপ্ন সঞ্চারিত হয়েছে স্থানীয়দের মধ্যে। তারা
বলছেন তাদের জীবন বদলে যাওয়ার হাওয়া বইছে, যা এখনই মাত্র এক বছরে অনেকটাই স্পষ্ট।
দেশী কোম্পানি নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির (এনডব্লিউপিজিসিএল) চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট এ্যান্ড এক্সপোর্ট কর্পোরেশন (সিএমসি) বিদ্যুত কেন্দ্রটির উদ্যোক্তা। বিদ্যুত কেন্দ্রটি নির্মাণে বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড (বিসিপিসিএল) নামে পৃথক কোম্পানি করেছে উদ্যোক্তারা। চীনের এক্সিম ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় বিদ্যুত কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হচ্ছে। কেন্দ্র নির্মাণে আড়াই বিলিয়ন ডলার ঋণ দিচ্ছে চীনা ব্যাংকটি। অক্টোবরেই চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিংপিংয়ের সম্ভাব্য বাংলাদেশ সফরে ঋণচুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে চূড়ান্ত ঋণ পাওয়ার আগেই দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী নির্মাণ কাজ শুরু করতে হয়েছে চীনা এনইপিসি এবং সিইসিসি কনসোর্টিয়ামকে। এটিই বিদ্যুত খাতে চীনের প্রথম বিনিয়োগ প্রকল্প। এর আগে তারা ঠিকাদার হিসেবে কাজ করেছে। এ প্রকল্পের অর্ধেক মালিকানা চীনের।
সম্প্রতি বিদ্যুত কেন্দ্রটির কার্যক্রম দেখতে পটুয়াখালীর কলাপাড়ার এ এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে কয়েক শ’ মানুষ এখানে একসঙ্গে কাজ করছেন। এদের বেশিরভাগই চীনের, যাদের মধ্যে প্রকৌশলী-সাধারণ শ্রমিক, জরিপকারক সবই রয়েছে। চীন থেকেই আনা হয়েছে বেশিরভাগ নির্মাণ যন্ত্র। প্রকল্প এলাকায় পৌঁছে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যে রেইনকোর্ট পরে কাজ করতে দেখা যায় চীনাদের। আধুনিকতার ছোঁয়ায় নির্মাণ করা হয়েছে একটি পরিদর্শন বাংলো। নির্মাণ চলছে বসবাসের জন্য অন্য অবকাঠামোর। বিদ্যুতের তার ঝোলানো হলেও এখনও বিদ্যুত আসেনি। পাড়াগাঁয়ের মধ্যে জেনারেটরে চলছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র। এর মধ্যেই কম্পিউটার, ইন্টারনেটসহ আধুনিক সবকিছু সংযোজন করা হয়েছে।
মাত্র চার মাসে বিদ্যুত কেন্দ্রটির ভূমি উন্নয়নের কাজ শেষ হয়েছে আর তিন মাসে এ জমিকে উপযুক্ত করা হয়েছে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের জন্য। এখন টেস্ট পাইলিংয়ের কাজ চলছে। সাধারণত এরকম বড় বিদ্যুত কেন্দ্র উৎপাদনে আসতে ৪২ মাস সময় প্রয়োজন হয়। কিন্তু শুধু চীনে ৩৬ মাসে বিদ্যুত কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট উৎপাদনে আসার রেকর্ড রয়েছে। বাংলাদেশেও একই প্রচেষ্টা চলছে। এ জন্যই দিন-রাতের এই কর্মযজ্ঞ।
এনডব্লিউপিজিসিএল এবং বিসিপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ এম খোরশেদুল আলম এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা চেষ্টা করছি নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই বিদ্যুত কেন্দ্রটির কাজ শেষ করতে। সেজন্যই মূলত দ্রত কাজ করা হচ্ছে। যেসব মানুষ বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য তাদের ভিটে ছেড়েছে তাদের জন্য কী করা হচ্ছেÑ এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা তাদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করছি। সেখানে সব আধুনিক সুবিধা থাকবে। পাকা ঘর, স্কুল, বাজার, বিদ্যুত, হাসপাতাল, রাস্তা সবকিছুই করা হবে। এখানকার স্কুলটি কারিগরি কারিকুলামের হবে। এ স্কুলে পড়ার সুবাদে হাতেকলমে বিদ্যুত কেন্দ্রে কাজ শিখবে, পরে এখানেই তাদের কাজের ব্যবস্থা করা হবে। অর্থাৎ তাদের সকল দায়িত্ব আমরা নিচ্ছি।
ব্যবস্থাপনা পরিচালকের আশ্বাসের মতোই মধুপাড়া, নিশানবাড়িয়া, দশরহাউলা, মরিচ বুনিয়ার মানুষ স্বপ্ন বুনছে এই কেন্দ্র ঘিরে। প্রকল্পের মধ্যেই জমি রয়েছে এমন একজন মোঃ হানিফ বললেন, আমাদের তো আর কিছু নেই। তা সত্ত্বেও এখনও এখানে থেকে গেছেন কেন? জানতে চাইলে বলেন, অনেকেই বলছেন এখানে থাক, যেও না। অনেক ভাল হবে। এখন এ প্রকল্পে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন মোঃ হানিফ। তিনি বলেন, এখানে এই বন-বাদাড়ের মধ্যে এতবড় উন্নয়নমূলক কাজ হবে তা কোন দিন ভাবতেও পারিনি। কাজ শুরুর পর এলাকার মানুষের আস্থা বেড়েছে।
বিদ্যুত কেন্দ্রটির নির্মাণে ১২ হাজার ২৮৪ কোটি ৫৫ লাখ ৬৫ হাজার ৯৪৩ টাকার চুক্তি হয় গত ২৯ মার্চ। চুক্তির পর থেকেই নির্মাণ কাজও শুরু হয়েছে টেস্ট পাইলিংয়ের কাজ। গত ২২ আগস্ট থেকে টেস্ট পাইলিং শুরু হয়েছে। আর বিদ্যুত কেন্দ্রের মূল পাইলিং শুরু হবে আগামী নবেম্বরে। বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজই পাইলিং। এরপর শুধু আমদানি করা যন্ত্রাংশ বসানো হবে। নক্সা অনুযায়ী প্রায় চার হাজার পাইলিং করবে দেশী আরেক কোম্পানি ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড (এনডিই) এবং চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
এনডিইর প্রকল্প পরিচালক অশোক দেবনাথ জানালেন, বছরখানেক আগে এখানে যখন এসেছিলাম সে অবস্থা থেকে অনেকটাই বদলে গেছে এখানের মানুষ। বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ ঘিরে এখানে বিশাল অর্থনৈতিক কর্ম-চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। তার চোখে দেখা পরিবর্তনের কথা বলতে গিয়ে জানালেন, এখানে আমরা যে পরিদর্শন বাংলো নির্মাণ করছি তার জন্য শুরুতে ঢাকা থেকে রাজমিস্ত্রি আনা হয়েছিল। তাদের সঙ্গে আমরা স্থানীয়দের কাজের প্রশিক্ষণ দিয়েছি। এখন এরাই অনেক ভাল কাজ শিখে গেছে। তিনি জানান, প্রথম যখন এসেছিলাম তখন সাধারণ মানুষ বুঝতেই পারেনি এখানে এতবড় কাজ হতে যাচ্ছে। এখন মানুষ নতুন স্বপ্ন দেখছে।
আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির বিদ্যুত কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট উৎপাদনে আসবে আগামী ২০১৯ সালের জুন মাসে আর দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদনে আসবে একই বছর ডিসেম্বরে। বিদ্যুত কেন্দ্রের ইউনিটপ্রতি উৎপাদন ব্যয় হবে ছয় টাকা ৬৫ পয়সা। চীন, অস্ট্রেলিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া থেকে বিদ্যুত কেন্দ্রটির জন্য কয়লা আমদানি করা হবে। বলা হচ্ছে, বিদ্যুত কেন্দ্র পর্যন্ত পৌঁছতে টনপ্রতি কয়লার ব্যয় দাঁড়াবে ১০০ ডলার। কয়লাচালিত বিদ্যুত কেন্দ্র নিয়ে এক ধরনের নেতিবাচক প্রচারণাও রয়েছে। তবে ব্যতিক্রম এ কলাপাড়ার চার গ্রামের মানুষ। তারা ওই সব প্রচারণায় একেবারেই পাত্তা দেয় না।
অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ জানালেন, শুরুতে একটি গোষ্ঠী এখানে লিফলেট বিলি করে। আমাদের বোঝাতে চেষ্টা করে এখানে কয়লাচালিত বিদ্যুত কেন্দ্র হলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে। কোন গাছে ফল ধরবে না। কোন জমিতে আর ফসল হবে না। তোমাদের এমনিতেই সব কিছু রেখে চলে যেতে হবে। তোমরা উদ্বাস্তু হবে। কিন্তু আমরা ওই প্রচারণায় কান দেইনি। সরকারের পক্ষ থেকে পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষ তা বিশ্বাস করেছেন। তিনি দ্রুত আবাসন প্রকল্প নির্মাণের দাবি জানান। স্থানীয় উত্তর লালুয়া ইউসি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আজাদের ৭৫ একর জমি রয়েছে প্রকল্পের মধ্যে।
বিদ্যুত কেন্দ্র করতে গিয়ে মধুপাড়া, নিশানবাড়িয়া, দশরহাউলা, মরিচবুনিয়া গ্রামের ৯৮২ একর জমির মালিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এখানকার পরিবারগুলোর বসতভিটার জন্য একরপ্রতি সাড়ে সাত লাখ টাকা এবং নাল জমির জন্য পাঁচ লাখ ৭৫ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের ঘরবাড়ির জন্যও অর্থ দেয়া হয়েছে। পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের হিসাবে মোট ৬৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। যদিও এখানকার কিছু সরকারী খাসজমি ছিল।
পুনর্বাসন পরিকল্পনায় দেখা যায়, যারা ২০ শতাংশের কম জমি হারিয়েছেন তারা ছয় শতাংশ করে জমি পাবেন; সঙ্গে এক হাজার বর্গফুটের সেমিপাকা বিল্ডিং পাবেন। আর যাদের ২০ শতাংশের উপরে জমি ছিল তারা আট শতাংশ জমি পাবেন; সঙ্গে এক হাজার ২০০ বর্গফুটের সেমিপাকা ঘর পাবেন। একই সঙ্গে আধুনিক পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে দেয়া হবে। যেসব পরিবার দোকান হারিয়েছে তাদের জন্য দোকান ঘরও তৈরি করে দেয়া হচ্ছে।
আধুনিক জীবন ব্যবস্থার সকল উপকরণ থাকবে এ আবাসন ব্যবস্থায়। বলা হচ্ছে, চরের মানুষ সাধারণত বিদ্যুত এবং পিচঢালা সড়ক, স্কুল ক্লিনিককে স্বপ্নই মনে করত। কিন্তু এখন পায়রা বিদ্যুত কেন্দ্রের কল্যাণে সবকিছুই করা হচ্ছে নতুন গ্রামটিতে।
চরের মানুষের জীবন বদলে দিতে বিসিপিসিএল সেখানে বিদ্যুত নিচ্ছে, রাস্তা নির্মাণ করছে, অভ্যন্তরীণ সকল রাস্তায় বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। গড়ে তোলা হচ্ছে কমিউনিটি ক্লিনিক, মসজিদ, ঈদগাঁহ, অফিস কাম-কমিউনিটি সেন্টার, শিশুদের জন্য থাকবে খেলার মাঠ, প্রকল্পের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের শিশুদের জন্য পাশেই স্কুল থাকবে, সাঁতার শেখার জন্য পুকুর, গ্রামের মধ্যেই গো-চারণ ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়া হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় বিদ্যুত বিভাগ কয়লাচালিত বিদ্যুত কেন্দ্রে স্থানীয়দের উন্নয়নে একটি নতুন আইন করেছে। আইন অনুযায়ী প্রতি ইউনিট বিদ্যুত থেকে তিন পয়সা করে কেটে রেখে একটি তহবিল গঠন করা হবে। তহবিলের পুরো টাকা খরচ করা হবে স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্তদের কল্যাণে। কয়লাচালিত বিদ্যুত কেন্দ্রের আশপাশের মানুষ এ সুবিধা পাবেন।
সরকারের এ উদ্যোগ সম্পর্কে স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর জানান, আমরা এখনও এ খবরটা জানি না। তবে এমনটা হলে মানুষ আরও উৎসাহ পাবে। তবে তা না হলেও এখানে যে অবস্থা তৈরি হয়েছে তাতে আমাদের উন্নয়ন আর কেউ রুখতে পারবে না বলেই আমরা মনে করছি।
নির্মাণ কাজের তদারকিতে থাকা এনডব্লিউপিজিসিএলের প্রকৌশলী মাহবুবুল ইসলাম জানালেন, চীনাদের মধ্যে কোন ভয়ভীতি নেই। তারা নির্বিঘেœ রাত-দিন কাজ করছেন। এখন আমাদের টেস্ট পাইলিংয়ের কাজ চলছে। তারা ২৪ ঘণ্টাই কাজ করছেন। নিয়মতান্ত্রিকভাবে শিফটে ভাগ করে এ কাজ করা হচ্ছে। আমরাও তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি।