ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ফিলিপিন্সে মাদকের বিরুদ্ধে নির্মম যুদ্ধ

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬

ফিলিপিন্সে মাদকের বিরুদ্ধে নির্মম যুদ্ধ

ফিলিপিন্সের নতুন প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তের শাসনাধীন জীবন এখন কেমন? এ প্রশ্নের জবাব পেতে হলে একটু পেছনের দিকে ফিরে যেতে হবে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- দীর্ঘদিন ধরে ফিলিপিন্সের জীবনের এক রূঢ় বাস্তবতা হয়ে আছে। সেই হত্যা-ের শিকার হয়ে এসেছে পরিবেশবাদীরা, সাংবাদিকরা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতাধর গোষ্ঠীর প্রতি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ানো যে কোন মানুষ। সেই বিচারবহির্ভূত হত্যা আজও চলছে। তবে তা ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। প্রেসিডেন্ট দুতার্তে গত মে মাসে নির্বাচিত হয়ে আসেন। নির্বাচনী প্রচারাভিযানে তিনি অঙ্গীকার করেছিলেন যে ক্ষমতায় এলে দুই মাসের মধ্যে দেশ থেকে অপরাধ মুছে ফেলবেন। তার জন্য যদি অপরাধী সন্দেহে এক লাখ লোককে হত্যা করতে হয় তাতেও পিছপা হবেন না। প্রেসিডেন্টের পদ গ্রহণের দিনটিতে তিনি পুলিশ অফিসারদের বলেছিলেন যে দায়িত্ব পালনকালে তাদের এক হাজার লোককে হত্যা করতে হয় তিনি তাদের স্বার্থে দেখবেন। অনেকে ভেবেছিল এটা নেহায়েত নির্বাচনী প্রচারণার সেই চমকের পুনরাবৃত্তি। কিন্তু তারা ভুল ভেবেছিল। দুতার্তের আমলে মাদকে ব্যবসায় জড়িত বলে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের ওপর এখন সাঁড়াশি অভিযান চলছে। ১০ মে দুতার্তে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে গত ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময়ের মধ্যে মাদক কারাবারে জড়িত সন্দেহে ৯৪৩ ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে। অধিকাংশ হত্যাই পুলিশের হাত দিয়ে হয়েছে। আবার কিছু কিছু হত্যা অজ্ঞাতনামা আততায়ীরাও করেছে। নিহত ব্যক্তিদের অনেকেই মাদক কারবারী হিসেবে সন্দেভাজন ছিল সত্য। তবে মাদকসেবীদেরও টার্গেট করা হয়েছে। যেমন এক মহিলার লাশ পাওয়া গিয়েছিল যার গলায় ঝুলিয়ে রাখা মোটা কাগজে লেখা ছিল ‘সে একজন মাদকসেবী, পকেটমার এবং সমাজের জন্য অভিশাপ।’ সন্দেহভাজন যেসব অপরাধীকে হত্যা করা হয়েছে তাদের কখনও বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি। তাই সত্যই তাদের বিরুদ্ধে কি তথ্য প্রমাণ ছিল তা বহুলাংশেই অজ্ঞাত। এমনি বিচারবহির্ভূত হত্যা দুতার্তের আমলে বেড়েছে বৈ কমেনি। এর আগে তিনি ২২ বছর দক্ষিণের দাভাও নগরীর মেয়র থাকাকালে মানবাধিকার সংগঠনগুলো অভিযোগ তুলত যে দুতার্তে সেই সব ঘাতক স্কোয়াডের সঙ্গে যুক্ত যারা সেখানকার সন্দেহভাজন অপরাধীদের হত্যা করত। বলাবাহুল্য দুতার্তে এসব অভিযোগ গায়েও মাখতেন না বরং তাদের জন্য গর্ববোধ করতেন। এখন প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি চড়াও হয়েছেন অপরাধীদের বিশেষ করে মাদক অপরাধীদের বিরুদ্ধে। দুতার্তের হিসাবে ৩০ থেকে ৪০ লাখ ফিলিপিনো মাদকাসক্ত। তিনি এদের বিরুদ্ধেও অভিযানে নেমেছেন। তাদের মাদকের নেশা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্থন করতে বলা হয়েছে। আগেই বলা হয়েছে যে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকারদের মধ্যে কিছু মাদকাসক্ত ব্যক্তিও আছে। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও ক্যাথলিক চার্চ এই বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করলেও ফিলিপিন্সের সাধারণ মানুষের কাছে দুতার্তের অবস্থান কিন্তু অনেক উঁচুতে। এক মানবাধিকার কর্মীর ভাষণ : কোরি একইনোর পর তিনিই আমাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট। ম্যানিলার সবচেয়ে বড় মহল্লা কমনওয়েলথ এবং এক তদন্তকারী কর্মকর্তা থেরেসা পাদালুগা জানান যে, দুতার্তে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে ওই মহল্লার প্রায় ২০ জন সন্দেভাজন মাদক অপরাধী নিহত হয়েছে। তিনি গর্বভরে উল্লেখ করেন যে তার কারাগারে এখন কোন মাদকাসক্ত নেই- আছে শুধু পানাসক্ত এবং ঘরোয়া সহিংসতায় অভিযুক্ত ব্যক্তিরা। আরেক মহিলা বলেন যে দুতার্তের কৌশল কাজে দিচ্ছে কারণ তিনি সমাজের জন্য ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক ব্যক্তিদের টার্গেট করেছেন। এই ব্যক্তিরা আরেকবার সুযোগ পেলে ফের মাদক সেবন শুরু করবে। কমনওয়েলথের এক সুনসান রাস্তায় ছোট দোকানের মালিক এমেলিয়া বলেন : ‘আমরা দুতার্তেকে পছন্দ করি। কারণ তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর এই জায়গাটা চুপচাপ হয়ে গেছে। লোকে তাকে ভয় পায়।’ সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট দুতার্তে তার ক্রুসেডকে রাজপথ থেকে প্রসারিত করেছেন ক্ষমতার দুর্গে। তবে তা করতে গিয়ে খানিকটা পিছুও হটতে হয়েছে তাকে। গত ৭ আগস্ট তিনি প্রকাশ্যে নাম উল্লেখ করে দেড় শ’রও বেশি বিচারক, রাজনীতিক, সিনিয়র সামরিক ও পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন যে তারা মাদকের সঙ্গে জড়িত। তিনি তাদের আত্মসমর্পণের জন্য ২৪ ঘণ্টা সময়ও বেঁধে দিয়েছেন। তিনি বলেন, আইন তার নিজস্ব প্রক্রিয়ায় চলবে। এখানে আমার কিছু করার নেই। তার এই বক্তব্যের সঙ্গে অমত করার এমন লোকের সংখ্যা কম। তবে তার তালিকায় এমন কিছু কর্মকর্তার নাম ছিল যারা হয় ইতোমধ্যে মারা গেছেন, অবসরে গেছেন অথবা বরখাস্ত হয়েছেন। তার এই আচরণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি ও রাজনীতিবিদরা। জবাবে দুতার্তে মার্শাল ল জারি করার হুমকি দিয়েছেন। দুতার্তের এমন ভূমিকায় সাধারণ মানুষের কাছে তার অবস্থান আরও উঁচুতে উঠেছে। তবে একটা ব্যাপার অতি বাস্তব। বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- যত বেশি দিন ধরে চলবে আইনের শাসনের তত বেশি ক্ষতি হবে। গত মাসে আলফ্রেড সিয়াসিও নামে এক মাদকসেবীকে তার বাড়িতে ঢুকে গুলি করে হত্যা করে ঘাতক দলের এক সদস্য। ঘটনার তিন দিন আগে পুলিশ তাকে আটক করে মোটা অঙ্কের অর্থ দাবি করেছিল যা দেয়ার ক্ষমতা তার পরিবারের ছিল না। টাকা না পেয়ে পুলিশ তাকে কাঠের চেলা দিয়ে পিটিয়ে ছেড়ে দিয়েছিল। তার পরেই এই হত্যাকা-। আইনের শাসন এভাবে যদি মার খেয়ে চলে তাহলে দুতার্তে বিপদে পড়বেন। সমাজের অপরাধীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি নিজেই হেরে যাবেন, পর্যুদস্ত হবেন। চলমান ডেস্ক সূত্র : টাইম
×