ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শুধুই প্রশংসা, অর্থ পুরস্কার কেন নয়?

প্রকাশিত: ০৬:১৪, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬

শুধুই প্রশংসা, অর্থ পুরস্কার কেন নয়?

রুমেল খান ॥ বাংলাদেশ মহিলা ফুটবলের ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাদের প্রথম অংশগ্রহণ ২০১০ সালে নিজ দেশে অনুষ্ঠিত সাউথ এশিয়ান গেমসে। নেপালের কাছে ০-১ গোলে হেরে যাত্রা শুরু। বাংলাদেশের পুরুষ ও মহিলা ফুটবলের সময়সীমার ইতিহাস নিয়ে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে সেই ইংরেজ আমল, পাকিস্তান আমল বর্তমানে বাংলাদেশ আমল ... চর্চার দিক দিয়ে এগিয়ে আছে পুরুষ ফুটবলই। সে তুলনায় মহিলা ফুটবলের চর্চার ইতিহাস এক যুগও হয়নি। অথচ যদি বলা হয় সাম্প্রতিক সময়ে কোন ফুটবলের উন্নতির ধাপ সবচেয়ে উঁচুতে, তাহলে সচেতন ফুটবলপ্রেমীরা একবাক্যে বলে দেবেনÑ মহিলা ফুটবল? হ্যাঁ, ঠিক তাই। মাত্র কয়েক বছর আগেও এদেশের মহিলা ফুটবল নিয়ে হাসাহাসি হতো বিস্তর, অথচ আজ তাদের নিয়ে সুনীল স্বপ্ন দেখে এদেশের ফুটবলমোদীরা। অনুর্ধ ১৬ মহিলা দলের মেয়েদের এই অনন্য অর্জনে স্বভাবতই অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ক্রীড়ানুরাগী হিসেবে তিনি নিশ্চয়ই তা করতে পারেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে মহিলা ফুটবল এই যে এত সাফল্য বয়ে আনছে দেশের জন্য, গৌরব বৃদ্ধি করছে লাল-সবুজ বাংলাদেশের। বিনিময়ে শুধু অভিনন্দন আর শুভেচ্ছা ছাড়া কি পাচ্ছে তারা? উদাহরণ দিয়ে বলা যায় বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের কোন ম্যাচে জিততে দেরি, ম্যাচ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, ব্যবসায়ী মহল, নেতা-নেত্রী এবং জাতীয় ক্রীড়াপরিষদ বিবৃতি দিয়ে অভিনন্দনের বন্যা বইয়ে দেন। এটা করেই ক্ষান্ত হন না তারা। সঙ্গে সঙ্গে ঘোষণা করে দেন ক্রিকেট দলকে ৫, ১০ বা ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থ পুরস্কার উপহার দেয়া হবে। পরে ঘটা করে সংবর্ধনা আয়োজন করে তাদের হাতে সেই টাকাও তুলে দেয়া হয়। শুধু টাকাই নয়, গাড়ি, বাড়ি, জমিসহ আরও আকর্ষণীয় কিছুও দেয়া হয়। অথচ বিস্ময়কর হলেও সত্যি, বাংলাদেশ মহিলা ফুটবল দল এতগুলো সাফল্য কুড়িয়ে আনলেও তাদের কপালে এসবের কিছুই জোটেনি। অনুর্ধ ১৬ দল চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় কেবল ওয়ালটন তাদের পাঁচ লাখ টাকা দেবে বলেছে, যা আসলে সিন্ধুতে বিন্দু। সাফল্যের জন্য যেমন প্রয়োজন সদিচ্ছা, পরিকল্পনা, পরিশ্রম এবং ভাগ্য; তেমনি প্রয়োজন প্রচুর অর্থের। অর্থ ছাড়া কিছুই হয় না। ক্রিকেট দলের সাফল্যে যারা এত অর্থ পুরস্কার হিসেবে দেন, তাদের কি মহিলা ফুটবলের সাফল্যগুলো চোখে পড়ে না? নাকি তারা মহিলা ফুটবলকে গুরুত্বই দেন না? সচেতন ক্রীড়াপ্রেমীদের প্রশ্নÑ ক্রিকেটে অবশ্যই বাংলাদেশ আজ ভাল অবস্থানে। এ খেলার মাধ্যমে দেশের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হচ্ছে। যারা ক্রিকেট দলের সাফল্যে খুশি হয়ে এত অর্থ পুরস্কার দেন তারা হয় তো মনে করেন ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারলে বা তাদের অর্থ দিলে নিশ্চয়ই তাদের সামাজিক মান-মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। সেক্ষেত্রে মহিলা ফুটবলকে তারা গুরুত্বহীন মনে করেন এবং এর সঙ্গে যুক্ত হলে তাদের স্ট্যাটাস কমে যাবে! যদি তাই হয়, তাহলে এটা নিশ্চয়ই আর বলার অপেক্ষা রাখে নাÑ এটা তাদের হীন মানসিকতা এবং সংকীর্ণ মনের পরিচায়ক। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ফুটবল দল সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে ২০১০ ও ২০১৪ সালে সেমিফাইনাল খেলে, এছাড়া সাউথ এশিয়ান গেমসে ২০১০ সালে করায়ত্ত করে তাম্রপদক। ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে তাদের অবস্থান ১২১ নম্বরে (১৭৭ দেশের মধ্যে), এশিয়ার মধ্যে ২৬ নম্বরে ও সাফ অঞ্চলে ৩ নম্বরে। তবে জাতীয় দলের চেয়ে ঈর্ষণীয় সাফল্য পেয়েছে বয়সভিত্তিক জাতীয় দলগুলো। গত নয় মাসের মধ্যে তিন আসরে তারা শিরোপা জিতে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বিশ্বব্যাপী। গত বছরের ডিসেম্বরে নেপাল থেকে বাংলাদেশ দল ফিরেছিল ‘এফসি অনুর্ধ ১৪ বালিকা চ্যাম্পিয়নশিপ’ শিরোপা জিতে। মে তে তাজিকিস্তান থেকে বাংলাদেশের একই দল ফেরে একই আসরের শিরোপা জিতে। গত ৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ‘এএফসি অনুর্ধ ১৬ ওমেন্স চ্যাম্পিয়নশিপ কোয়ালিফায়ার্স’- ‘সি’ গ্রুপে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে মূলপর্বে উন্নীত হয় বাংলাদেশ। এই আসরের মূলপর্ব আগামী ২০১৭ সালে অনুষ্ঠিত হবে থাইল্যান্ডে। ওই আসরে অংশ নেবে মোট আট দল। উত্তর কোরিয়া, চীন, জাপান ও থাইল্যান্ড খেলবে সরাসরি। আর বাছাইপর্বে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে খেলবে আরও চার দল। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশসহ কোয়ালিফাই করেছে দক্ষিণ কোরিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া (আরেকটি দল কোয়ালিফাই করার অপেক্ষায়)। কাজী মোঃ সালাউদ্দিন বাফুফে সভাপতি হয়ে সারা বছর মাঠে ফুটবল রাখার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা বাস্তবায়ন করেছেন ঠিকই। কিন্তু মাঠ সমস্যার সমাধান করতে পারেননি। এক বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের ওপর দিয়েই বয়ে যায় যত ঝড়। এখানে সব ধরনের লীগ ও টুর্নামেন্ট হয়ে থাকে। তাছাড়া খেলা ছাড়াও এখানে হয়ে থাকে কনসার্টও। ফলে মাঠের বারোটা বেজে যায়। এদিকে কমলাপুর স্টেডিয়ামে হয়ে থাকে সিনিয়র ডিভিশন, চ্যাম্পিয়নশিপ লীগ, পাইওনিয়ার লীগের খেলা। কিন্তু এদের ভিড়ে যেন সুযোগই হয় না মহিলা ফুটবলারদের। যদিও তাদের খেলাই হয় খুব সীমিত পরিসরে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টগুলোতে খেলতে গিয়ে তাদের সবচেয়ে বেশি পড়তে হয় মাঠ সঙ্কটে। প্রতিটি মাঠের যে বেহাল দশা, এর জন্য অনায়াসেই দায়ী করা যায় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে (এনএসসি)। কারণ প্রতিটি মাঠই তাদের। নিয়ম অনুযায়ী তাদেরই মাঠ সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ করা উচিত। কিন্তু সেটি তারা করছে না। তারপরও মহিলা ফুটবল দলের এমন অভাবনীয় নৈপুণ্য বিস্ময় জাগাতে বাধ্য। আগে সাতক্ষীরা, যশোর, রাঙ্গামাটি ছাড়া আর কোন জেলা থেকে মেয়েরা খেলতে আসত না। আর এখন কমপক্ষে ২৫ জেলা থেকে মেয়েরা আসে খেলতে। এ থেকেই বোঝা যায় ৪-৫ বছর ধরেই দেশে মহিলা ফুটবলের ধীরে ধীরে বিস্তার ঘটছে। আগে আন্তর্জাতিক ফুটবলে প্রতিপক্ষ দলগুলোর কাছে বাংলাদেশ হারত ৬-৭ গোলে। এদেশের মহিলা ফুটবল ছিল আঁতুর ঘরে। ফুটবলারদের খেলা দেখে সবাই হাসাহাসি করত। আর এখন? মুগ্ধ হয়ে দেখে, তালি বাজায় এবং তাদের সমর্থনে গলা ফাটায়! এটাই সত্য, এটাই বাস্তবতা। খেলোয়াড়রা বেসিক ফুটবল শিখেই আসে খেলতে। মহিলা ফুটবল উন্নতির সোপান বেয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে তরতর করে। এবং সেটা খুব দ্রুতই। আর এটাই বিস্ময়কর বিষয়। একদা দেশীয় ফুটবলের যে উজ্জ্বল অতীত ঐতিহ্য ছিল, তা ছেলেরা ফিরিয়ে আনতে না পারলেও মেয়েরা পারছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি শ্লাঘার বিষয়। দুঃখজনক হলেও সত্যি, দলের অধিকাংশ মেয়ে উঠে এসেছে অবহেলিত গ্রামগঞ্জ ও প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে। তাদের পরিবারগুলো একেবারেই হতদরিদ্র। বলতে গেলে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়Ñ এমন অবস্থা। সেখানে বিদ্যালয়সংলগ্ন পর্যাপ্ত খেলার মাঠ নেই, প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও প্রশিক্ষণের প্রকট অভাবÑ সর্বোপরি নিত্যসঙ্গী দারিদ্র্যের কশাঘাত। অনেক অঞ্চলে এখন পর্যন্ত বিদ্যুতও পর্যন্ত পৌঁছেনি। সে অবস্থায় অদম্য ও অপরাজেয় নারী ফুটবলারদের এমন কৃতিত্ব খাটো করে দেখার কোন অবকাশ নেই। এই দলটিকে যথাযথ প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন করানের ব্যবস্থা করা হলে দেশে ও বিদেশের মাটিতে এরাই একদিন আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে বিজয় গৌরব ও সুনাম ছিনিয়ে আনতে সমর্থ হবে। মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, ব্যবসায়ী মহল, নেতা-নেত্রী এবং জাতীয় ক্রীড়াপরিষদের ব্যক্তিরা নিজেদের মনটাকে আরও উদার বা বড় করে মহিলা ফুটবলের উন্নয়নের জন্য এগিয়ে আসুন, এটাই ক্রীড়াপ্রেমীদের নিগূঢ় প্রত্যাশা।
×