ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিদেশ থেকে আনা হয়েছিল কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা

মীর কাশেমের ফাঁসির মধ্য দিয়ে শেষ হলো আরাকানিস্তান তৎপরতা

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬

মীর কাশেমের ফাঁসির মধ্য দিয়ে শেষ হলো আরাকানিস্তান তৎপরতা

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ বাংলাদেশের দুই জেলা যথাক্রমে কক্সবাজার ও বান্দরবান এবং মিয়ানমারের রাখাইন (সাবেক আরাকান) প্রদেশ নিয়ে কথিত ‘স্বাধীন ইসলামী আরাকানিস্তান’ প্রতিষ্ঠার যে মিথ্যা স্বপ্ন ও প্রচার দীর্ঘদিন ধরে চালানো হয়েছে বর্তমানে কার্যত এসবের অপমৃত্যু ঘটেছে। সদ্য ফাঁসির দ-ে দ-িত যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলীর নেতৃত্বে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) নেতা জঙ্গী হাফেজ সালাউল (বর্তমানে কারাগারে), পলাতক রোহিঙ্গা নেতা ড. ইউনুস, নুরুল ইসলামসহ একটি চক্রের অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থকরণে ‘স্বাধীন ইসলামী আরাকানিস্তান’ নামের একটি অঞ্চল প্রতিষ্ঠার অপপ্রচার চালানোর নেপথ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সাহায্যকারী সংস্থা থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ প্রাপ্তি। কক্সবাজার ও বান্দরবানের সাধারণ জনগোষ্ঠী এ ধরনের অলিক চিন্তা ও ধ্যান ধারণাকে বিশ্বাস না করলেও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের সকল সদস্যের বিশ্বাস ও সমর্থন সৃষ্টি হয়েছিল এ নিয়ে। কিন্তু এখন ধীরে ধীরে এতে ভাটা পড়েছে। স্বপ্ন দেখানোর নেপথ্য নায়ক যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলী ফাঁসিতে ঝুলেছে, হাফেজ সালাউল কারাগারে। পাশাপাশি তাদের সহযোগীরা দীর্ঘদিন ধরে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তবে এ নিয়ে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায়ের তৎপরতা থেমে নেই। কক্সবাজারে গোয়েন্দাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বশীল বিভিন্ন সূত্রে বলা হয়েছে এ বিষয়টি সম্পূর্ণ অলীক। এটা সংঘবদ্ধ ওই চক্রের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার তৎপরতা মাত্র। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্যরা যেখানে নির্মম অত্যাচারের শিকার হয়ে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন দেশে পালিয়ে যাচ্ছে এবং এদের একটি অংশ কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলা জুড়ে অবৈধভাবে অবস্থান করছে তখন সুচতুর মহলটি এ অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়েছিল। ইতোমধ্যেই তথ্য মিলেছে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের স্বার্থে প্রতিষ্ঠিত রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গাইজেশনসহ আরও কয়েকটি সংস্থার জন্ম হয়েছে বহু আগে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মীর কাশেম আলী উখিয়ায় প্রতিষ্ঠা করেন রাবেতা আল আলম ইসলামী নামের এনজিও ও হাসপাতাল। যেখানে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা এবং শরণার্থী হয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হতো। এ তৎপরতা বহির্বিশ্বে এমনভাবে প্রচার করা হতো যাতে সাহায্যকারী বিভিন্ন সংস্থার নজরে পড়ে এবং তাই হয়েছে। বিদেশী এই অর্থেই মূলত মীর কাশেম আলীর উত্থান পর্বের সূচনা। কক্সবাজার অঞ্চলে আরএসওসহ ২২টি সংগঠন রয়েছে, যেগুলো নিয়মিত বিদেশ থেকে অর্থ যোগান পেয়ে থাকে। গোয়েন্দা সূত্রে এ তথ্য স্বীকার করা হয়েছে। বলা হয়েছে, তাদের পক্ষে পরিচালিত অনুসন্ধানে এর সত্যতা মিলেছে। কক্সবাজারে নাশকতা সৃষ্টি করতে জামায়াত শিবির ও রোহিঙ্গা জঙ্গীদের নিয়ে রোহিঙ্গা জঙ্গী নেতা হাফেজ সালাউল নাশকতার বিভিন্ন পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত। বিষয়টির সত্যতা পাওয়ার পর তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে রাখা হয়েছে। এর পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীর অর্থায়নে জামায়াত শিবিরের সন্ত্রাসীরা কক্সবাজার অঞ্চলে সহিংসতা ঘটাতে তৎপর হয়েছিল। এরই অংশ হিসাবে বেশকিছু ঘটনা তারা ঘটিয়েছে। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রামু ও উখিয়া, টেকনাফসহ কয়েকটি স্থানে বৌদ্ধ বিহার, মন্দির, সংখ্যালঘু বসতিতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনার সঙ্গে মীর কাশেম আলী গং চক্রের ইন্ধন ছিল বলে ওই সময়ে বলা হয়েছিল। কিন্তু প্রমাণের অভাবে তাকে আটকানো যায়নি। কক্সবাজারের উখিয়ার খনিয়াপালং এলাকায় মীর কাশেম আলী রাবেতা আল আলম ইসলামী নামের যে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন তা ছিল মূলত জঙ্গী তৎপরতা বৃদ্ধি ও স্বাধীন ইসলামী আরাকানিস্তান অঞ্চল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অপতৎপরতা চালানোর কেন্দ্র। সূত্র জানায়, বান্দরবান-কক্সবাজার সীমান্তে আশির দশক থেকে সক্রিয় আরএসও। তার সহযোগী হিসাবে সার্বক্ষণিক কাজ করেছে রোহিঙ্গা নেতা ড. ইউনুস, আবদুর রশিদ, হাফেজ সালাউল ও মৌলভী আবদুর রহমান। এদের আরও অনেক চ্যালাচামু-া ছিল। এ সবের পাশাপাশি জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলী জামায়াতের জন্য অর্থ যেমন যোগান দিতেন, তেমনি সরকারবিরোধী তৎপরতা ও প্রচারণাও চালাত। এ চক্রটির সঙ্গে পাকিস্তান, ফিলিপিন্স, আফগানিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের কয়েকটি দেশের জঙ্গী বিভিন্ন সংগঠনের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। এটি একটি বিশাল নেটওয়ার্ক। এ নেটওয়ার্কের এদেশীয় মূল হোতা ছিলেন মীর কাশেম আলী। সূত্র মতে, বর্তমানে আরএসও’র বর্তমান সমন্বয়ের পদে রয়েছে জঙ্গী সালাউল ইসলাম। গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য রয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন স্থানে যে জঙ্গী তৎপরতা অব্যাহতভাবে চলছে সে সব স্থানে আরএসও ক্যাডারদের সক্রিয় অবস্থান রয়েছে। সূত্র জানায়, ২০১২ সালের জুলাই মাসে উইকিলিকসের ফাঁক করা এক তথ্যে আরএসও জঙ্গীদের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গীগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সক্রিয় যোগাযোগের কথা বলা হয়েছে। এ চক্রটি তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী স্বাধীন ইসলামী আরাকানিস্তান অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় কৌশলপত্র নির্ধারণ, মানচিত্র, পতাকা, সংবিধানও রচনা করে রেখেছে। আরএসও জঙ্গীরা এ নিয়ে স্বপ্নে বিভোর। এদের নেপথ্যে সমর্থন যোগায় বাংলাদেশে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবি, হিযবুত তাহ্্রির, হিযবুত তাওহীদ, পাকিস্তান ভিত্তিক জঙ্গী সংগঠন লস্কর ই তৈয়বা, হরকত উল জিহাদ, জয়ইশ-ই মোহাম্মদসহ বিভিন্ন জঙ্গীগোষ্ঠীর সদস্যরা। মিয়ানমারের আরএসও, আরাকান মুভমেন্ট, আরাকান পিপলস ফ্রিডম পার্টি, আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (এআরএমও), আরাকান পিপলস ফ্রিডম পার্টি, আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন, এআরএনও, আরাকান রোহিঙ্গা ইউনিয়ন এ ব্যাপারে সক্রিয়। সূত্র জানায়, ক’বছর আগে কক্সবাজার পুলিশের হাতে আটক চার জঙ্গী নেতার মধ্যে আবদুল্লাহ হেল কাফির দেয়া স্বীকারোক্তিতেও এ তথ্য বেরিয়ে আসে। কাফির স্বীকারোক্তি মোতাবেক আরএসও’র সঙ্গে রয়েছে আফগান যুদ্ধ ফেরত প্রশিক্ষিত গেরিলা থেকে শুরু করে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালানোর বহু সদস্য। বান্দরবান-কক্সবাজার সীমান্তে ডজনেরও বেশি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মধ্যে আরএসও সবচেয়ে শক্তিশালী। আরএসও নেতা নুরুল ইসলাম (বর্তমানে লন্ডন প্রবাসী)। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে অর্থ যোগানে সম্পৃক্ত। আরএসও বর্তমানে চারভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ার পর মীর কাশেম আলীর মধ্যস্থতায় হাফেজ সালাউলের নেতৃত্বে চার গ্রুপকে এক করা হয় ২০১২ সালে। এরফলে বিদেশী অর্থ চলে আসে স্রোতের মতো। এছাড়া এ গোষ্ঠীর অনেকে জঙ্গীপনার পাশাপাশি অস্ত্র ও মাদক ব্যবসায় জড়িত। আরএসও বরাবরই সীমান্তে সক্রিয় ন্যাশনাল ইউনাইটেড পার্টি অব আরাকানসহ (নুপা) অন্যান্য কিছু সহিংস গ্রুপের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে কর্মকা- চালাচ্ছে। সূত্র জানায়, যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীর পরামর্শে ২০০৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আরএসও সর্বশেষ সভায় নতুন কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। ওই বছরের ৩০ জুলাই কমিটি গঠিত হয়। কক্সবাজার শহরে আরএসও’র শীর্ষস্থানীয় নেতা নুরুল ইসলাম ও মোঃ ইউনুস নতুন কমিটি গঠনকালে উপস্থিত ছিলেন। আরএসও নতুন কমিটি হয় ১৫ সদস্যের। ড. মোঃ ইউনুস এর প্রেসিডেন্ট এবং হাজী মোঃ জাবেদ ও রাশেদ আহমদ ভাইস প্রেসিডেন্ট মনোনীত হন।
×