ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শিশির ভেজা শিউলি ফুলের গন্ধে কেন কান্না পায়...

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬

শিশির ভেজা শিউলি ফুলের গন্ধে কেন কান্না পায়...

মোরসালিন মিজান শিউলিসুরভি রাতে বিকশিত জ্যোৎস্নাতে/মৃদু মর্মরগানে তব মর্মের বাণী বোলো...। মর্মের বাণী বলার শিউলি সুরভি রাত এসেছে। শুভ্র সুন্দর ফুলে ভরে উঠেছে বাগান। আহ, কী মিষ্টি ঘ্রাণ! নাকে আসছে তো? অবশ্য ঘ্রাণ নয় শুধু, ফুলের সৌন্দর্যও দারুণ আকৃষ্ট করে রাখে। শরতের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ শিউলি। পৃথিবীর এই ফুল একই সঙ্গে স্বর্গের শোভা। স্বল্পায়ু শিউলির সূর্যের সঙ্গে আড়ি। রাতে ফোটে। সকাল হতেই ঝরে যায়। যেন অশ্রুবিন্দু। পৌরাণিক কাহিনী মতে, শিউলি বেদনার প্রতীক। ব্যর্থ প্রেমের আলেখ্য। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন- সময় যে তার হল গত/নিশি শেষের তারার মতো-/শেষ করে দাও শিউলি ফুলের মরণ-সাথে...। নজরুল তো শিউলি ফুলে মুগ্ধ যেমন হয়েছেন, কান্নাও ধরে রাখতে পারেননি। লিখেছেন- শিশির-ভেজা শিউলি ফুলের গন্ধে কেন কান্না পায়...। শিউলির বৈজ্ঞানিক নাম ‘নিক্টান্থেস আরবর-ট্রিসটিস’। নামটিকে ভাঙলেও বেদনার সুর বেজে ওঠে। লাতিন শব্দ ‘নিক্টান্থেস’ অর্থ সন্ধ্যায় ফোটা। ‘আরবর-ট্রিসটিস’ হচ্ছে বিষণœ গাছ। চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য নিয়ে সন্ধ্যায় ফোটা এবং সকাল হতেই ঝরে যায় বলে এমন নামকরণ। একই কারণে শিউলিকে বলা হয় ‘ট্রি অব সরো’। পুরাণেও ফুলটি বেদনার প্রতীক হয়ে এসেছে। গল্পটি এক রাজকন্যার। রাজকন্যার নাম পারিজাতিকা। তার রূপে মুগ্ধ সবাই। আর তিনি মুগ্ধ সূর্যতে! সূর্যের প্রেমে পাগলপ্রায়। এরপরও ভালবাসা অধরাই থেকে যায়। মন ভেঙ্গে খান খান হয় রাজকন্যার। বেদনার ভার সইতে না পেরে আত্মাহূতি দেন তিনি। হিন্দু শাস্ত্র মেনে তাকে দাহ করা হয়। কিন্তু আগুনে পুড়ে যে ছাই, তাতে শেষ হয় না সব! রাজকন্যার দেহভস্ম থেকে জন্ম নেয় একটি গাছ। সেই গাছে ফুল ফোটে। রাজকন্যার নামে রাখা ফুলের নাম- পারিজাতিকা। হ্যাঁ, শিউলির আরেক নাম পারিজাতিকা। একই ফুল শেফালি নামে পরিচিত। কবিগুরুর ভাষায়, ওই শেফালির শাখে কী বলিয়া ডাকে বিহগ বিহগী কী যে গায় গো...। নজরুলের কবিতা-গানে শিউলি এসেছে ঘুরেফিরেই। শিউলি ফুলে মুগ্ধ কবি লিখেছেন, শিউলি তলায় ভোর বেলায় কুসুম কুড়ায় পল্লী-বালা।/ শেফালি ফুলকে ঝ’রে পড়ে মুখে খোপাতে চিবুকে আবেশ-উতলা...। আবার নিজের বুকের হাহাকারের কথা বলতেও শিউলিকে আশ্রয় করেছেন। লিখেছেন, শিউলি ফুলের মালা দোলে শারদ-রাতের বুকে ঐ/এমন রাতে একলা জাগি সাথে জাগার সাথী কই...। অবশ্য শুধু বেদনার কথা বললে হবে না। শিউলির সৌন্দর্য ও মিষ্টি ঘ্রাণের কোন তুলনা হয় না। বিষ্ণু পুরাণে সে কথার উল্লেখ আছে। শিউলির আরেক নাম পারিজাত। দেবতাদের রাজা ইন্দ্র স্বর্গের নন্দনকাননে পারিজাত গাছটি পুঁতেছিলেন। এর ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ত সমস্ত ইন্দ্রপুরীতে। ইন্দ্রের স্ত্রী শচীদেবীর খুব প্রিয় ছিল পারিজাত ফুল। তিনি প্রতিদিন একটি করে পারিজাতমঞ্জরি চুলে পরতেন। শিউলির প্রচলিত অন্য নামগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ শেফালি, শেফালিকা, নাইট ফ্লাওয়ার জেসমিন, হারসিঙ্গার, কোরাল জেসমিন, রাগাপুষ্প, খারাপাত্রাকা ও প্রজক্তা। প্রিয় ফুলের ছয়টি শুভ্র সাদা পাপড়ি। ১ সে.মি লম্বা সোনালি লাল বোঁটার আগায় ছোট্ট ফুল ফোটে। গাছ সাদামাটা ধরনের। নরম ধূসর ছালবিশিষ্ট। উদ্ভিদবিদ দ্বিজেন শর্মা জানান, গাছ ৫ থেকে ৭ মিটারের মতো উঁচু হয়। গাছের পাতা প্রায় ১০ সে.মি লম্বা। ফুল ২ সে.মি লম্বা। ৩ সে.মি চওড়া। দক্ষিণ এশিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব থাইল্যান্ড থেকে শুরু করে ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানে শিউলি ফোটে। পশ্চিমবঙ্গ ও থাইল্যান্ডের কাঞ্চনাবুরি প্রদেশের রাষ্ট্রীয় ফুল শিউলি। বাংলাদেশে বহুকাল ধরে আছে শিউলি। গ্রামে খুব ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে ছোট ছেলেময়েরা শিউলি কুড়াতে যায়। তরুণীরা শাড়ির আঁচল ভরে শিউলি নিয়ে ঘরে ফেরে। মালা গেঁথে খোঁপায় জড়ায়। রাজধানী ঢাকায় এর উল্টো। তেমন চোখে পড়ে না। প্রচ- আত্মবিশ্বাসী প্রেমিক কবি আবিদ আজাদ লিখেছিলেনÑ যে শহরে আমি নেই আমি থাকবো না সে শহরে জনহীন কোন/পেট্রোল পাম্পের দেয়াল ঘেঁষে/একটা মরা শিউলি গাছের মতো বেঁচে থাকবে তুমি...। ইট-পাথরের জঞ্জাল ঢাকা শহরে কোন রকমে বেঁচে আছে শিউলি গাছ। খোঁজ করলে পাওয়া যায়। অনেকের বাসার সামনে, ছাদে শিউলি গাছ দেখা যায়। শিশু একাডেমির বাগানে আছে শিউলি গাছ। এবার এখনও ফুল ফোটেনি। তবে ফুটবে। সেই অপেক্ষা। শিশু একাডেমিতে আসা শিশুরা তো বটেই, মায়েরাও সেই ফুল কুড়াতে ব্যস্ত থাকেন। পথশিশুরা এখান থেকে ফুল কুড়িয়ে মালা তৈরি করে। সামান্য দাম। কিন্তু এর চেয়ে অমূল্য উপহার সত্যি হয় না!
×