ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মেজর জাহিদের স্ত্রী ও দুই দেহরক্ষী গ্রেফতারে চলছে অভিযান

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬

মেজর জাহিদের স্ত্রী ও দুই দেহরক্ষী গ্রেফতারে চলছে অভিযান

শংকর কুমার দে ॥ মিরপুরের রূপনগরে নিহত মেজর মুরাদ ওরফে জাহাঙ্গীর ওরফে ওমর যার প্রকৃত নাম মেজর জাহিদুল ইসলাম, তার দুই দেহরক্ষী অভি, সাগর ও স্ত্রী জেবুন্নাহার শীলাকে গ্রেফতার অভিযানে আছে পুলিশ। এই মেজর জাহিদুল ইসলামই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় হামলাকারী জঙ্গীদের উত্তরাঞ্চলের গাইবান্ধার চরে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল বলে উল্লেখ করেছে গ্রেফতার হওয়ার পর বন্দুকযুদ্ধে নিহত এক জঙ্গীর জবানবন্দীতে। মিরপুরের রূপনগরের যেই বাসায় মেজর জাহিদুল ইসলাম নিহত হন সেই বাসায় অন্তত দশ জঙ্গীর যাতায়াত ছিল বলে রূপনগর থানায় দায়েরকৃত মামলায় উল্লেখ করেছে পুলিশ। নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় নিহত দুই জঙ্গীসহ তামিম আহমেদ চৌধুরীর ভাড়া নেয়া বাসায় পাওয়া একটি বাসা ভাড়া তথ্য ফরমের মিরপুরের রূপনগরের জাহাঙ্গীর নামের সূত্র ধরে খোঁজ মেলে মেজর জাহিদুল ইসলামের। মেজর জাহিদুল ইসলাম সম্পর্কে আরও অনেক অজানা তথ্য পাওয়ার জন্য তার দুই শিশু সন্তান নিয়ে আত্মগোপনে থাকা স্ত্রী জেবুন্নাহার শীলাকে গ্রেফতারের জন্য অভিযান পরিচালনা করছে পুলিশ। কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ খবর জানা গেছে। মিরপুরের রূপনগরে নিহত মেজর মুরাদ ওরফে জাহাঙ্গীরের প্রকৃত পরিচয় মেজর জাহিদুল ইসলাম উদঘাটিত হওয়ার পর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, নিহত ব্যক্তি সেনাবাহিনীর একজন সাবেক সৈনিক এবং জেএমবির সামরিক শাখার গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা। গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলায় অংশগ্রহণকারীদের এই ব্যক্তি প্রশিক্ষণ দিয়েছেন বলে সন্দেহ করে পুলিশ। গাইবান্ধার চরে এই প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল বলে জানান তিনি। ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান জানান, গত ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় জঙ্গীবিরোধী অভিযানে দুই জঙ্গীসহ তামিম চৌধুরী নিহত হওয়ার পর ওই দিন বিকেলের দিকে জাহিদ স্ত্রী, দুই সন্তানসহ রূপনগরের ওই বাসা থেকে বেরিয়ে যান। এরপর গত ২ সেপ্টেম্বর মিরপুরের রূপনগের বাসায় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিতে এসে মেজর জাহিদুল ইসলাম নিহত হন। তিনি নিহত হওয়ার আগে সেই যে গত ২৭ আগস্ট দুই সন্তানসহ স্ত্রী জেবুন্নাহার শীলা কোথায় রেখে এসেছেন তার এখনও হদিস মেলেনি। তার হদিস পাওয়ার জন্য নিহতের শ্বশুর, শাশুড়িসহ অনেকেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, পুলিশের অভিযানে নিহত জঙ্গী মেজর জাহিদুল ইসলামের স্ত্রী জেবুন্নাহারও জঙ্গী দলের সদস্য বলে প্রাথমিক অনুসন্ধানে তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা। মিরপুরের রূপনগরের বাসা থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর দুই কন্যা সন্তান নিয়ে আত্মগোপনে রয়েছে জেবুন্নাহার। তাকে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারলে জাহিদুলের অনেক অজানা বিষয় সম্পর্কে জানা যাবে। তদন্তকারীদের কাছে তথ্য রয়েছে জেবুন্নাহারও তার স্বামীর সঙ্গে জঙ্গী দলে নাম লিখিয়েছে। স্বামীসহ অন্য জঙ্গিদের সে নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করত। তারা এর আগে কোথায় কোথায় অবস্থান করেছিল এবং তাদের সঙ্গে কাদের যোগাযোগ হয়েছে তা জানা যাবে। নিহত মেজর জাহিদের স্ত্রী জেবুন্নাহার শীলাকে গ্রেফতারের জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে। কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় নিহত তামিম আহমেদ চৌধুরী ছিলেন নব্য জেএমবির প্রধান ও জঙ্গী হামলার মাস্টারমাইন্ড। সে নিহত হওয়ার পর তার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার কথা ছিল যার তিনি হচ্ছেন, জঙ্গীদের কাছে সাংগঠনিক নামে পরিচিত কথিত এই মুরাদ ওরফে মেজর মুরাদ ওরফে জাহাঙ্গীর। এই মুরাদ ওরফে জাহাঙ্গীরই মিরপুরের রূপনগের নিহত মেজর জাহিদুল ইসলাম। তবে মেজর জাহিদুল ইসলামের প্রকৃত নাম তা পাওয়া যায় তার নিহত হওয়ার ঘটনার পর। তবে মেজর মুরাদ বা জাহিদুলকেই গ্রেফতারের জন্য খুঁজছিল পুলিশ। কিন্তু গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার পর তদন্তকারী সংস্থা ও পুলিশের জঙ্গী বিষয়ক ধারণা সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। উচ্চ শিক্ষিত, বিত্তবান পরিবারের সন্তানদের দক্ষতার সঙ্গে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দিয়ে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র হাতে তুলে দেয়ার ঘটনাটিতে টনক নড়ে ওঠে পুলিশ, তদন্তকারী সংস্থা, গোয়েন্দা সংস্থার। এর নেপথ্যে যে সামরিক বাহিনী বা অন্য কোন বিদেশী সংস্থার কোন না কোন ব্যক্তি জড়িত তার সন্দেহ ঘনীভূত হয়। অবশ্য জাহিদের পুরো পরিচয় না পেলেও মুরাদ ওরফে জাহাঙ্গীর (ছদ্মনাম) নামে জেএমবিতে যে একজন সদ্য অবসরপ্রাপ্ত মেজর সক্রিয় আছেন, জঙ্গীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন, এমন তথ্য তদন্ত পর্যায়ে পাচ্ছিল তদন্তকারী সংস্থা ও গোয়েন্দারা। কিন্তু কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলার পর জঙ্গী হামলার নেপথ্যে যে সামরিক বাহিনীর একজন কর্মকর্তা জড়িত তার ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়। কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতে হামলার ঘটনায় আহত অবস্থায় গ্রেফতার হওয়া জঙ্গী শফিউল (পরে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত) কথিত মেজর মুরাদ সম্পর্কে তথ্য দেয়। গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলাকারী জঙ্গীদের মেজর জাহিদ গাইবান্ধার চরে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন বলে তখন তার নামটি তদন্তের সামনে চলে আসে। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, মেজর মুরাদ বা জাহাঙ্গীর নামটি তদন্তের সামনে চলে আসলেও এই নামে যে একজন জঙ্গী প্রশিক্ষক আছে, যিনি সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা ছিলেন তার খোঁজ পাওয়াটা সম্ভব হয়ে উঠছিল না। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় নিহত জঙ্গী হামলার মাস্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরীর ভাড়া করা বাসায় অভিযান শেষে তল্লাশির সময় ঢাকার মিরপুরের রূপনগরের বাসার একটি ভাড়াটে তথ্য ফরম পাওয়া যায়। ওই ফরমে লেখা ছিল জাহাঙ্গীর আলমের নাম। বাড়ি ভাড়ার তথ্য ফরমের পাওয়া ঠিকানার সূত্র ধরে মিরপুরের রূপনগরের বাসায় তল্লাশি চালানো হলেও সেদিন বাসাটি তালাবদ্ধ থাকায় তাকে পাওয়া যায়নি। এরপর তিনি বাসায় এসে জরুরী কাগজপত্র নিতে এলে পুলিশকে খবর দেয়া হলে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন মেজর জাহিদুল ইসলাম। মিরপুরের রূপনগর থানার কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তা জানান, মেজর জাহিদ নিহত হওয়ার ঘটনায় রূপনগর থানায় দায়ের করা মামলায় বলা হয়েছে। এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, জঙ্গী জাহাঙ্গীর আলম ওরফে মেজর মুরাদ ওরফে ওমর গত ২ সেপ্টেম্বর রাত সোয়া ৮টার দিকে রূপনগর আবাসিক এলাকার ৩৩ নম্বর সড়কের ১৪ নম্বর বাসার ষষ্ঠ তলার পশ্চিম পার্শ্বে (আবুল হাশেমের ভাড়াটিয়া) ফ্ল্যাটে অবস্থান করে। এ সময় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তল্লাশির জন্য ব্লকরেইড চালানোর সময় সে পুলিশকে হত্যার উদ্দেশে অতর্কিত গুলিবর্ষণ ও চাকু নিয়ে আক্রমণ করে। পুলিশও আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি চালালে ওই জঙ্গী মারা যায়। জঙ্গী জাহাঙ্গীর আলম ওরফে মেজর মুরাদ ওরফে ওমরের ফ্ল্যাটে মাঝে মাঝে থাকত এবং তার সহযোগী মানিক, ইকবাল, আকাশ ও সাগরসহ অজ্ঞাতনামা ৫-৬ জন জঙ্গী তার ফ্ল্যাটে যাতায়াত করত। অজ্ঞাতনামা জঙ্গীদের সহায়তায় নিষিদ্ধ ঘোষিত জেএমবি ও সমর্থনপুষ্ট অন্যান্য সংগঠনের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের কাজে অস্ত্র, গোলাবারুদ, বিস্ফোরকদ্রব্য দিয়ে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শের মাধ্যমে সহায়তা ও প্ররোচনা দিয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে অপরাধ করেছে। অভি ও সাগর নামে দুই দেহরক্ষি ছিল মেজর জাহিদের যাদের এখন গ্রেফতারের জন্য অভিযান পরিচালনার করছে পুলিশ।
×