ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

হজ ফ্লাইট শেষ ॥ এবার হজে গেছেন ১ লাখ ১ হাজার ৩৫২ জন

প্রতারণার শিকার, হজে যাওয়া হলো না ৫ শতাধিক মুসল্লির

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬

প্রতারণার শিকার, হজে যাওয়া হলো না ৫ শতাধিক মুসল্লির

আজাদ সুলায়মান ॥ সত্তরোর্ধ বৃদ্ধ আবুল হোসেন খান। জীবন প্রদীপ নিভু নিভু করলেও এখনও মন কাঁদছে মক্কা-মদীনার টানে। সারাজীবনের লালিত স্বপ্ন, একবার হলেও হজব্রত পালন করা। সে জন্য দু’বছর আগে টাকাও জমা দিয়েছিলেন। তারপরও হজে যেতে পারেননি। পর পর দু’বছর ধরেই তাকে প্রতারক এজেন্সি মালিক আশ্বাস দিচ্ছে- এই বছর পারেননি- তো কি হয়েছে। আগামী বছর যাবেন। আগামী বছর তিনি বাঁচবেন কি না- এমন নিশ্চয়তা চাইলে, তখনও প্রতারকচক্রের সান্ত¡নার আশ্বাস- হজ না করে আপনি মরবেন না। তাঁর মতো এমন পাঁচ শতাধিক লোক টাকা জমা দিয়েও হজে যেতে পারেননি। হজ ফ্লাইটের শেষ দিন মঙ্গলবার আশকোনা হজ অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ প্রতারণার শিকার হবার অসংখ্য কাহিনী। মঙ্গলবার বিকেল পাঁচটায় সৌদিয়া এয়ারলাইন্সের শেষ ফ্লাইট ঢাকা ছেড়ে যায়। সর্বশেষ ওই ফ্লাইটে ৪১১ জন নিয়ে এবার মোট ১ লাখ ১ হাজার ৩৫২ জন প্রকৃত হজযাত্রী জেদ্দা যেতে সক্ষম হয়েছেন। এছাড়া আরও প্রায় ১ হাজার বিভিন্ন সরকারী প্রতিনিধি, মন্ত্রী, এমপি ও অন্যান্য রাজনীতিকও সরকারী খরচে হজ করতে গেছেন। এ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়-এবার ১ লাখ ১ হাজার ৭৫৮ জন প্রাক রেজিস্ট্রেশন করার পরও তাদের মধ্যে ৪ শতাধিক হজে যেতে পারেননি। এর মধ্যে ভিসাই হয়নি তিন শতাধিকের। আর ভিসা হওয়ার পরও শুধু টিকেটের অভাবে যেতে পারেননি ৮০ জন। বিমান ও সৌদিয়া কোন এয়ারলাইন্সই তাদের জেদ্দা নিতে পারেনি। তারা মঙ্গলবার সকালে আশকোনা হজ অফিসে জড়ো হবার চেষ্টা করলে বিপুল সংখ্যক র‌্যাব আনসার ও পুলিশ মোতায়েন করে তাদের হজ অফিসে প্রবেশে কঠোরভাবে বাধা দেয়া হয়। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে হজ পরিচালক ডক্টর আবু সালেহ মোস্তফা কামাল জনকণ্ঠকে বলেন, সর্বশেষ ফ্লাইট না যাওয়া পর্যন্ত সঠিক পরিসংখ্যান বলা যাবে না। মনে হয় এ সংখ্যা ১০-১৫ জন হতে পারে। এরা ভিসা হওয়া সত্ত্বেও যেতে পারছেন না। যদি সৌদিয়া এয়ারলাইন্স একটি বড় উড়োজাহাজ দিত তাহলে আরও প্রায় ৬০-৭০ জন যেতে পারত। আর যারা টাকা জমা দেয়ার পরও ভিসা হয়নি বলে যেতে পারেননি-তাদের অভিযোগ হজের পরে খতিয়ে দেখা হবে। তখন জানা যাবে কার দোষ ত্রুটি কতটুকু। প্রতারণার বিষয়ে অনুসন্ধানে দেখা যায়, দু’বছর ধরে প্রতারিত হওয়ার মতোও অবিশ্বাস্য কাহিনী পাওয়া গেছে। টাঙ্গাইলের তিন বয়োবৃদ্ধ লোক জীবন সায়াহ্নে এসে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তারা জীবনে আর হজ করতে পারবেন বলে বিশ্বাস ও আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। তারা এখন শুধুই চোখের পানি ফেলছেন আর প্রতারক এজেন্সির কঠোর শাস্তি চাচ্ছেন। বিক্রমপুরের আরও প্রায় ১২ জনের এক গ্রুপ হজে যেতে পারেননি শুধু ভিসা না হওয়ার কারণে। প্রতারক এজেন্সি এখন মাফ চেয়ে টাকা ফেরত দেয়ার আশ্বাস দিচ্ছে। কিন্তু প্রতারিত টাকা ফেরত নয়- তাদের বিচার চান। টাঙ্গাইল সদরের পশ্চিম ঠাকুরপাড়ার বাসিন্দা, অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা আশ্রাফ আলম, হুগরার বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আবুল হোসেন খান ও কাকুয়ার বাসিন্দা কৃষক আবুল হোসেন খান। তারা তিনজনেই সত্তরোর্ধ। তারা এক সঙ্গে হজ করার নিয়ত করেন বছর দুয়েক আগে। তারা একত্রে স্থানীয় এক দালাল মোয়াল্লেম পরিচয়ধারী লিয়াকত হোসেনের মাধ্যমে সাউথ এশিয়ান ওভারসিজ নামের এক হজ এজেন্সিতে টাকা জমা দেন। তারা প্রত্যেকেই আড়াই লাখ টাকা পরিশোধ করেন। কিন্তু গত বছর তাদের হজে পাঠায়নি এজেন্সি। জানতে চাইলে সাউথ এশিয়ান ওভারসিজের মালিক লিটন আগামী বছর (২০১৬ সালে) তাদের পাঠানোর আশ্বাস দিয়ে বলেন, এ বছর যেতে পারেননি তো কি হয়েছে। আগামী বছর সবার আগে আপনাদের তিনজনকে পাঠানো হবে। সহজ-সরল ধর্মপ্রাণ এই তিন বয়োবৃদ্ধের পক্ষে এই সান্ত¡নার আশ্বাস মেনে নেয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। মনোকষ্টেই তারা অপেক্ষা করতে থাকেন আরও একটি বছর। এ বছর ফের প্রাক রেজিস্ট্রেশনের সময় হলে তারা আবারও নিশ্চয়তা চান। এবার প্রতারক লিটন নতুন শর্ত দিলেন- হজে যাবার সম্ভাবনা আছে। তবে নিশ্চয়তা দেয়া যাবে না। নিশ্চয়তা চাইলে আরও ৮০ হাজার টাকা অতিরিক্ত দিতে হবে। অগত্যা তারা তাতেও সায় দিলেন। কষ্ট করে প্রত্যেকেই ৮০ হাজার টাকা করে জমা দেন। তারপরও হজে যাবার জন্য উদগ্রীব হয়েই হজ ফ্লাইটের অপেক্ষায় থাকেন। কিন্তু গত ৪ আগস্ট হজ ফ্লাইট শুরুর পর তারা জানতে চাইলেন কবে পাঠানো হচ্ছে। লিটন এবার জানালেন আর কদিন পর। কদিন পর জানালেন শেষের দিকে। শেষের দিকে গত ৪ সেপ্টেম্বর জানালেন- এবার আর হচ্ছে না। ভিসা দেয়নি সৌদি দূতাবাস- বিমানের টিকেট শেষ। আগামীতে আর কিছুতেই এমন হবে না। অবশ্যই পাঠানো হবে। লিটনের এমন আশ্বাসে আর সায় দেননি তারা। তারা বিশ্বাসই করতে পারছেন না হজের নামে মানুষ এমন প্রতারণা করতে পারে। তারা এ কথা শুনে ডুকরে কেঁদে উঠেন। টাকা দিয়েও দু’বছর ধরে হজে যেতে পারছেন না। সারাজীবনের সঞ্চিত টাকায় হজ করা হলো না। হজ না করেই এখন দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়ার প্রস্তুতি নেয়ার কথা উল্লেখ করে আবুল হোসেন বলেন, আরেক বছর কি বাঁচব। বাঁচলেই কি আর এই শরীর নিয়ে হজ করা সম্ভব? আশ্রাফ আলম বলেন, প্রতারক এখন মাফ চাচ্ছে। কিন্তু আমরা যে হজ করতে পারলাম না, আমরা কি মাফ পাব? কোন অপরাধে আমরা হজ থেকে বঞ্চিত হলাম। আমরা এখন এই প্রতারকের বিচার চাই। একই প্রতারণার শিকার হয়েছেন বিক্রমপুরের ব্যবসায়ী নজরুল খান ও মালিবাগের ইমাম মুফতি হাফিজ উদ্দিন। তারা ক্যাপলান নামের একটি হজ এজেন্সির কাছে নগদ সাড়ে তিন লাখ টাকা করে মোট সাত লাখ টাকা জমা দেন তিন মাস আগেই। তাদের সিরিয়াল ছিল পঞ্চাশ হাজারের আগেই। যেখানে এবার বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ১ হাজার ৭৫৮ সিরিয়াল পর্যন্ত হজে যাবার সুযোগ পেয়েছেন। শুরু থেকেই তাদের আশ্বস্ত করা হয়, সামনের সপ্তাহে ভিসা হবে। কিন্তু ভিসার সর্বশেষ তারিখ ২৮ আগস্ট পেরিয়ে যাবার পর তাদের এজেন্সি থেকে বলা হলো- সম্ভব হয়নি। আগামীতে যেতে চাইলে পারবেন। অন্যথায় টাকা ফেরত নেন। ভিসার জন্য ডিও ইস্যু করার শেষ তারিখ পেরিয়ে যাবার পরও নজরুল খান ও মুফতি হাফিজ উ্িদ্দন হজে যাবার আশায় গত সোমবার ছুটে গেছেন হজ অফিসে। সেখানে তারা খোঁজ নেন- কেন তাদের ভিসা হচ্ছে না। অতিরিক্ত টাকা বা জরিমানা দিয়ে হলেও কোনভাবে ভিসার শেষ চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হন। কেউ তাদের সাহায্য করতে পারেননি। প্যাকেজের সব টাকা সবার আগে জমা দিয়েও কেন ভিসা পাননি তারা- জানতে চাইলে হজ পরিচালক ডক্টর আবু সালেহ মোস্তফা কামাল বলেন, অনেক কারণেই ভিসা হয়নি অনেকেরই। যেমন কারোর পুলিশ রিপোর্ট নেতিবাচক হলে- এজেন্সি কর্তৃক মোয়াল্লেমসহ অন্যান্য ফি সময় মতো মক্কায় না পাঠালে কিংবা দালাল কর্তৃক টাকা এজেন্সির কাছে ঠিকমতো না পাঠালে। এ ক্ষেত্রে নজরুল খান ও মুফতি হাফিজ উদ্দিনের ভিসা না হবার ডাটাবেজ থেকে দেখা যায়, তারা সময়মতো টাকা পরিশোধও করেছেন- পুলিশ রিপোর্টও ভাল ছিল। কিন্তু হজ এজেন্সি ক্যাপলেনের মালিক রফিকুল ইসলাম বেশি টাকার লোভে তাদের দু’জনের নামের পরিবর্তে অন্য দু’জনকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। যাকে বলা হয় রিপ্লেসমেন্ট বাণিজ্য। এটা দেখভাল করার দায়িত্ব ছিল হজ অফিসের। কিন্তু সেটা করা হয়নি বলেই নজরুল ও হাফিজ উদ্দিন প্রতারণার শিকার হন। এমন শত শত লোককে হজ প্রতারণার শিকার হয়ে মঙ্গলবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত হজ অফিসের সামনে আহাজারি করতে দেখা যায়। সর্বশেষ ফ্লাইটে যখন ধর্ম সচিব আব্দুল জলিল ও হজ পরিচালক ডক্টর আবু সালেহ মোস্তফা শাহজালাল বিমানবন্দর ত্যাগ করছিলেন তখনও তারা তাদের সঙ্গে কথা বলে প্রতারণার কাহিনী জানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তুু নিরাপত্তাকর্মীর বাধার মুখে তারা সেটাও পারেননি। তারা এখনও আশকোনা হজ অফিসে গিয়ে ধর্না দিচ্ছেন। কেউ তাদের কোন সান্ত¡না দিতে পারছেন না। কেন প্রতারণার শিকার হলেন সেটারও জবাব দিচ্ছে না সরকারের কোন সংস্থা বা কর্মকর্তা। প্রতিবারই এ ধরনের শত শত নিরীহ ধর্মপ্রাণ লোক হজ করতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। অনেকেই আবার হজ না করেই চিরবিদায় নিয়েছেন। তারপরও ফিরে পাননি হজের টাকা। প্রতারকরা বরাবরই থাকছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। ধর্ম মন্ত্রণালয় ও হাব এ বিষয়ে কোন ধার ধারছে না। এ বিষয়ে প্রতারিত নজরুল খান জনকণ্ঠকে বলেন, হজ প্রতারকের জন্য হজে যাওয়া হলো না। আগামীতে প্রয়োজনে নিজে হজ লাইসেন্স করেই হজে যাব। কিন্তু তারপরও ওই প্রতারক রফিকুল ও রাজুর বিচার করতে হবে। এজেন্সি মালিক রফিক হজযাত্রীদের টাকা মেরে হজে চলে গেছেন। তাকে ধরার কোন উপায় নেই। এসব দেখার কে আছে আর যার কাছে বিচার চাইব।
×