ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

এশিয়া প্যাসিফিক ॥ জল ঘোলা করছে গভীর জলের মাছেরা

প্রকাশিত: ০৩:৫৬, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬

এশিয়া প্যাসিফিক ॥ জল ঘোলা করছে গভীর জলের মাছেরা

যেন গরিবের বাড়ি হাতির পা। আগস্টে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারত যাওয়ার পথে পায়ের ধুলো রাখলেন। দু’মাস পর অক্টোবরে আসছেন স্বয়ং চীনের প্রেসিডেন্ট। চার বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের আরেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীও চূড়ান্ত গন্তব্য ভারত যাওয়ার পথে ঢাকায় নেমে শোরগোল ফেলেছিলেন। এই যে আসা-যাওয়ার পথে দু’দ- বিশ্রাম- এর তাৎপর্য অনেক। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই যে অতিথিদের, বিশেষ করে মার্কিনী ভিভিআইপি অতিথিরা ক্ষুদ্র বাংলাদেশের আতিথ্য গ্রহণ করছেন তা এখন মোটামুটি সবার কাছে পরিষ্কার। বিশ্বের সব মানুষের ‘নিরাপত্তা রক্ষার’ দায়িত্বে নিয়োজিত যুক্তরাষ্ট্র এখন ভীষণভাবে চিন্তিত এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের নিরাপত্তা নিয়ে। দু’হাজার বারো সাল থেকে শুরু হওয়া ‘যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ নিরাপত্তা সংলাপ’-এর তৃতীয় সংলাপে দু’হাজার চোদ্দ সালের এপ্রিলে মার্কিন দলের প্রধান টমাস কেলির সংলাপ শেষের সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্টভাবে সে দুশ্চিন্তা ফুটে উঠেছিল- ‘আসলে সমুদ্র পথগুলো ক্রমবর্ধমান বিশ্ব পুঁজিবাদের শিরা-উপশিরা। বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ নৌ পথগুলোতে সামুদ্রিক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত না হলে তা কাজ করতে পারবে না। বঙ্গোপসাগর পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্থনীতির সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য ও ভারতের পাশাপাশি আফ্রিকার বিকাশমান অর্থনীতিকে সংযুক্ত করে সুতরাং এটি শুধু বাংলাদেশ বা এশিয়ার দেশগুলোর জন্য নয় যুক্তরাষ্ট্র ও গোটা বিশ্বের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ যে বঙ্গোপসাগরে সত্যিকারে সামুদ্রিক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হোক।’ বঙ্গোপসাগর সামুদ্রিক নিরাপত্তা কী এখন বিঘিœত? না। একমাত্র যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া ভূ-রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা কেউই সে কথা বলছেন না। টমাস কেলি ওই বক্তব্যে আরও বলেছেন ‘আমি জোর দিয়ে বলতে চাই যে, বিশ্বের নৌ পথগুলোর চলাচলের স্বাধীনতা যুক্তরাষ্ট্রের একটি মৌলিক স্বার্থ।’ এই হচ্ছে আসল কথা। কথার এ সুরের সঙ্গে বিশ্ববাসী পরিচিত। কোন দেশ বা অঞ্চলের ‘নিরাপত্তা’ বা ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা’ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ‘দুশ্চিন্তা’ যে কত গভীর ছাপ রেখে যায় ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়ার দিকে তাকালে তা পরিষ্কার। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজ মোটামুটি সম্পন্ন করে যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগ এখন ক্রমশ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিকে। চিন্তার কথা সেটাই। কারণ নিজের ‘মৌলিক স্বার্থ’ ক্ষুণœ হয় এমন কোন কিছু যুক্তরাষ্ট্র বরদাশ্ত করে না। আপাতত সমুদ্রে তার সে স্বার্থ প্রবলভাবে ক্ষুণœ করার হুমকি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বেয়াড়া চীন। তাই চীনকে শায়েস্তা করাই দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম লক্ষ্য। কোন রকম রাখঢাক না করেই যুক্তরাষ্ট্র বলেছে সে কথা। তাদের ‘পিভট টু এশিয়া’ নীতি বাস্তবায়নে নৌশক্তিকে গুরুত্ব দিয়ে দু’হাজার পনেরোর মার্চে প্রকাশিত সামুদ্রিক কৌশলগত দলিল ‘অ্যা ক্রিয়েটিভ স্ট্র্যাটেজি ফর টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি সি পাওয়ার : ফরোয়ার্ড, এনগেজড, রেডি সংক্ষেপে সিএস ২১ আর-এ পরিষ্কার বলা হয়েছে- * ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ভূ-রাজনীতির গুরুত্ব যে কোন সময়ের তুলনায় অনেক বেড়েছে। তাই গুরুত্ব বিবেচনায় দু’হাজার বিশের মধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌ ও বিমান শক্তির শতকরা ষাটভাগ এ অঞ্চলে মোতায়েন করা হবে। * এ পরিকল্পনা ‘চীন ঘেরাও’ কৌশলকে বাস্তবায়নের জন্য করা হবে। যার মধ্যে থাকবে চীনের বিরুদ্ধে পেন্টাগনের বিমান-নৌযুদ্ধ, ভারত মহাসাগর দিয়ে চীনের আমদানি-রফতানি যে কোন সময় আটকে দেয়ার সক্ষমতা অর্জন। * এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে কৌশলগত সহযোগিতা ও অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এই কৌশলগত সহযোগিতা ও অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে কে দাঁড়াবে যুক্তরাষ্ট্রের পাশে? ঝলসে ওঠে একটি নাম- ভারত। যুক্তরাষ্ট্রের যেমন আছে পিভট টু এশিয়া’ ভারতের আছে তেমনি ‘এ্যাক্ট ইস্ট।’ উনিশ শ’ নব্বইয়ের দশকে নরসীমারাওয়ের ‘লুক ইস্ট’ নীতি অটল বিহারী বাজপেয়ী ও মনমোহন সিং হয়ে নরেন্দ্র মোদির হাতে এসে হয়েছে এ্যাক্ট ইস্ট। তবে নাম বদলালেও উদ্দেশ্য অভিন্নই রয়েছে- তাহলো দক্ষিণ-এশিয়ায় ভারতের একক আধিপত্য নিশ্চিত করা। অন্তর্গত এ উদ্দেশ্যে অটুট আস্থা রেখেই জন কেরির উপস্থিতিতে ভারত ‘লজিস্টিটিক এক্সচেঞ্জ মেমোরেন্ডাম অব এগ্রিমেন্ট’ সংক্ষেপে এলইএমওএ সই করেছে। মজাটা এখানেই। চীন যেমন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী তেমনি ভারতেরও। চীন ঘেরাও-এ এদের যৌথ প্রচেষ্টা যেমন রয়েছে তেমনি আছে একক আধিপত্য বিস্তারের আকাক্সক্ষা। যুক্তরাষ্ট্রের আকাক্সক্ষা সর্বজনবিদিত হলেও ভারত এখনও অতটা উন্মুক্ত নয়। তবে চীনকে ঠেকাতে ভেতরে ভেতরে সে এগিয়েছে বহুদূর। এবং বেশ সুকৌশলে। কৌশলের আকর্ষণীয় অংশ হলো ধর্মীয় মৌলবাদী সরকারপ্রধানদের মহাসম্মিলন। তীব্র ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত, উগ্রহিন্দুত্ববাদী নরেন্দ্র মোদি মে দু’হাজার ষোলোতে তিন দিনের সফরে ইরানে গিয়ে এই চাঁদের হাট বসান। সেখানে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানী এবং আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি আহমদজাইয়ের সঙ্গে একটি ত্রিপক্ষীয় আন্তঃপরিবহন এবং ট্রানজিট চুক্তিতে আবদ্ধ হন তিনি। যা মধ্য এশিয়া থেকে শুরু করে গোটা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। চুক্তি অনুযায়ী ইরানের সিস্তান-বালুচিস্তান প্রদেশে চাবাহার বন্দর তৈরি করবে ভারত। চাবাহার বন্দরের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতদিন পাকিস্তান ট্রানজিট না দেয়ায় আফগানিস্তান হয়ে মধ্য এশিয়ায় খনিজসম্পদ আহরণ থেকে শুরু করে ওই অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক মঞ্চে সরাসরি যাওয়ার কোন রাস্তা ছিল না ভারতের। এখন সাগর পথে পাকিস্তানকে এড়িয়ে ভারত এই গুরুত্বপূর্ণ করিডরের অংশীদার হল। এতে পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের বিখ্যাত করিডর ‘চায়না-পাকিস্তান ইকোনামিক করিডর’ সংক্ষেপে সিপিইসি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। তেহরানে গিয়ে এক ঢিলে দুই পাখি মারার ব্যবস্থা করে এসেছেন নরেন্দ্র মোদী। চীনের জন্য এ শুধু অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ নয়, তার কৌশলগত অবস্থানের প্রতিও বড় চ্যালেঞ্জ। সিপিইসি পরিকল্পনায় রয়েছে চীন থেকে সোজা পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দর পর্যন্ত রেলপথ, সড়ক পথ এবং তেল-গ্যাস পাইপ লাইন। গোয়াদর বন্দর থেকে চাবাহার বন্দরের দুরত্ব পঞ্চাশ-ষাট কিলোমিটারের মত। সুতরাং চীন থাকবে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে। গোয়াদর ঘাট চীনের কৌশলগত ঘাঁটি ‘স্ট্রিং অব পার্ল’ বা মুক্তার মালার অন্যতাম মুক্তা। বাংলাদেশের সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দরেরও এ মালার একটি মুক্তা হওয়ার কথা ছিল। ভারতের চাপে বাংলাদেশ ওই পরিকল্পনা থেকে সরে আসে। এতো কিছুর পরও এ অঞ্চলে চীনের অবস্থান দৃঢ়। বিশ্বের প্রায় সব দেশের সঙ্গে রয়েছে তার বানিজ্যিক সম্পর্ক। এও এক মজার জট। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন সহ আসিয়ান ভূক্ত দেশগুলোর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যেমন সম্পর্ক রয়েছে তেমনি রয়েছে চীনের সঙ্গেও। আসিয়ান ভূক্ত দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ঠিকই একই সঙ্গে চীনের সঙ্গেও তারা ভাল সম্পর্ক চায়। যুক্তরাষ্ট্রের এটা অজানা নয়। আসিয়ানভূক্ত দেশগুলোর সঙ্গে চীনের বাণিজ্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের বাণিজ্যকে ছাড়িয়ে গেছে দু’হাজার সাত সালেই। এ পরিস্থিতিতে গায়ের জোর দেখাতে অভ্যস্ত যুক্তরাষ্ট্র এমন কৌশলে যাবে যাতে হয়ত শান্তি নষ্ট হবে এ অঞ্চলের সব দেশের। চীন যুক্তরাষ্ট্র দু দেশেরই মিত্র দেশে সে এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করবে। আমার সঙ্গে থাকো নইলে...। নইলে যে কি আই এস এর ধ্বংস যজ্ঞে সে তো আমরা এর মধ্যেই দেখতে পাচ্ছি।
×