ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সুমন্ত গুপ্ত

জীবনযোদ্ধা তরুণ উচিং লয়েন

প্রকাশিত: ০৭:০৩, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬

জীবনযোদ্ধা তরুণ উচিং লয়েন

বরগুনার তালতলী উপজেলা সদরের ছাতনপাড়া গ্রাম। পুরো গ্রামে ৪০ ঘর রাখাইন পরিবারের বাস। সেই গ্রামের ছোট্ট কুটিরে জন্মগ্রহণ করেন উচিং লয়েন। মা-বাবার একমাত্র সন্তান উচিং লয়েন। মা আবু গৃহিণী, বাবা চিনতেন শিক্ষকতা করেন ছাতনপাড়া বৌদ্ধবিহারের একটি পাঠশালায়। বাবার আয়েই টেনেটুনে চলে যেত তাদের সংসার। ছোটবেলা থেকে পড়ালেখার প্রতি লয়েনের খুব ঝোঁক। প্রথম শ্রেণী থেকে প্রথম হওয়াটি যেন নিয়ম বানিয়ে ফেলেছিলেন। ফলে প্রথম শ্রেণী থেকে এইচএসসি পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়েছেন তিনি । বাবার হাতেই তার হাতেখড়ি তার পরে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হন ছাতনপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। মজার বিষয় হলো গ্রামে সেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় ব্যাচের ছাত্র ছিলেন তিনি। নতুন স্কুল বলে ছোট ক্লাসে বেঞ্চ ছিল না। বসতে হতো বাড়ি থেকে সঙ্গে আনা মাদুর বিছিয়ে। তবে বিপত্তি বাধত বর্ষায়, প্রতিদিন হাঁটুপরিমাণ কাদা মাড়িয়ে মাদুর ও স্লেট হাতে যেতে হতো স্কুলে। গ্রামীণ পরিবেশে ধীরে ধীরে বেরে উঠতে থাকেন উচিং লয়েন। গ্রামের ছোট নদীর সাঁকো পার হয়ে একদিন ভর্তি হন তালতলী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। ষষ্ঠ শ্রেণীর উচিং লয়েন তখন স্বপ্ন দেখতেন বাবা চিনতেনের মতো শিক্ষক হবেন। শতঅর্থ কষ্টের মাঝেও বেড়ে উঠছিলেন। তিনি ২০০৫ সালে তালতলী মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, দুই বছর পর তালতলী ডিগ্রী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছেন। দুটিতেই জিপিএ-৫। বরিশাল বোর্ড থেকে এইচএসসির রেজাল্টের ওপর ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছেন। তিনি ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের ছাত্র ছিলেন। এইচএসসি পাসের পর বন্ধুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য কোচিং করছে দেখে তারও মন চাইল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বেন কিন্তু কোচিংয়ের টাকা জোগাড় করতে পারলেন না বাবা। তখন পাশে এসে দাঁড়ালেন কাকি, তার সহযোগিতায় ঢাকায় এসে কোচিং করে ‘সি’ ইউনিটে চান্সও পেলেন। শেষে দূরসম্পর্কের এক কাকার সাহায্যে ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষে নতুন চালু হওয়া ‘ট্যুরিজম এ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্টে’ ভর্তি হলেন। প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী লয়েনের ঠিকানা হলো জগন্নাথ হলো। প্রথমদিকে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না। হলের খাবার খাওয়া যেত না। মায়ের কথা মনে করে কাঁদতেন। ঠিকমতো চলার পয়সাও নেই। প্রথম দুই বছর টিউশনি পেলেন না। এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ছেলের লেখাপড়ার খরচ দিলেন মা। মায়ের এই কষ্টে তাঁরও মন খারাপ হতো। ফলে লেখাপড়াও মন বসত না তার। প্রথম বর্ষের ফলাফলের পর দেখা গেল, প্রথম তিনজনের মধ্যে নেই। মনে মনে জেদ চেপে বসল নিয়মিত ক্লাস শুরু করলেন, লেকচার টুকে রাখতেন, লাইব্রেরি বা নেট থেকে রেফারেন্স খুঁজে বের করতেন। যার ফলে অনার্সে প্রথম শ্রেণীতে চতুর্থ হলেন। মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয়। এই মেধাবী ছাত্রটি অনার্সের ফলাফলের জন্য ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ‘ডিনস এ্যাওয়ার্ড’, ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট শিক্ষাবৃত্তি’ পেলেন। ২০১৫ সালের ১ জুলাই রাখাইন নৃগোষ্ঠীর প্রথম মানুষ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। উচিং লয়েনই এ দেশের যে কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম রাখাইন শিক্ষক। যখন নিয়োগপত্র হাতে পেলেন ‘স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল তার। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। প্রথমে বাবাকে ফোন দিয়েছিলেন তার সাফল্যের কথা বলতে- বাবা, আমার তো হয়ে গেছে। মায়ের সঙ্গে কথা হয়নি তার তখন খালি মায়ের কান্নার আওয়াজ শুনেছিলেন তিনি এই কান্না অনন্দের কান্না। ২ আগস্ট থেকে প্রভাষক হিসেবে ক্লাস নেয়া শুরু করেছেন। সেদিন ক্লাসে যাওয়ার আগে একটু নার্ভাস ছিলেন। পরে নিজেকে বলেছেন, ‘কিছুদিন আগেও এই ক্লাসে এসে বসতাম, সবই তো পরিচিত। ভয় কিসের?’ তবে ক্লাসে ঢোকার পর ছাত্রছাত্রীরা তাঁকে দেখে বেশ অবাক হয়েছে বলে মনে হলো তাঁর। নানা প্রশ্ন করল, হাসিমুখে সবগুলোর জবাব দিলেন। সব স্বাভাবিক হয়ে এলো। বিভাগ ও হল নিয়ে এখন ব্যস্ত লয়েন। ভবিষ্যতে পিএইচডির জন্য অস্ট্রেলিয়া যেতে চান। তাঁর বিশ্বাস, ‘রাখাইনদের মতো প্রান্তীয় মানুষেরও ভাল কিছু করার সামর্থ্য আছে। কেবল সুযোগ পাওয়া দরকার।’ উচিং লয়েনের এখন দিন কাটে ব্যস্ততায়। হাউস টিউটর হয়েছেন জগন্নাথ হলের। সময় দেন রাখাইন সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীদের সংগঠনে। পিছিয়ে পড়া নিজের সম্প্রদায়কে এগিয়ে নিতে নানা উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।
×