ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শামীম হাসান

কেটে যাক তারুণ্যের দুঃসময়

প্রকাশিত: ০৭:০৩, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬

কেটে যাক তারুণ্যের দুঃসময়

একসময় যে খেলার মাঠে কিশোর-যুবকদের খেলাধুলার ব্যস্ততায় মুখরিত ছিল, সবুজ-সতেজ, ফুলে-ফুলে ভরপুর শিশুপার্কে ফুলের মতোই শিশুরা ছোটাছুটি করত সেখানে এখন বিদঘুটে চেহারার সারি সারি বাস-ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। বিদঘুটে তো বটেই। যে যেখানে সুন্দর। খেলার মাঠে বা শিশুপার্কে তো বাস-ট্রাকের চেহারা সুন্দর লাগার কথা নয়। মনে হয় ফুলের বনে দানব। কিন্তু এসব দানবের তো কোন দোষ নেই। তাদের তো কিছু করার ক্ষমতা নেই। এই দানবদের পেছনে যে আছে মানুষরূপী মস্ত বড় বড় দানব। এই মহা দানবদের ভাবখানা এমন যেন, করি না কারও পরোয়া, ধার কারও ধারি না। মগের মল্লুক নাকি ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পেয়েছে, তাহলে এটা কি? বাপ-দাদার সম্পত্তি মনে করে যা খুশি তাই করছে। খেলার মাঠ, পার্কগুলো ক্রমেই হয়ে উঠছে গাড়ির ড্যাম্পিং স্টেশন বা আবজর্নার ভাগাড়। একটা সময় মনেই হবে না এখানে কোন নির্মল পরিবেশ ছিল। এই মাঠ বা পার্ক রক্ষার জন্য যাদের দৃষ্টি দেয়ার কথা তাদের দৃষ্টিশক্তি এতই ক্ষীণ যে এসব তাদের চোখেই পড়ে না। অথবা চোখে পড়লেও এতই দুর্বল যে, এগুলো সরানোর মতো শক্তি তাদের নেই। এই দখলবাজরা কি শুধুই মাঠ বা পার্ক দখল করছে। গভীরভাবে ভেবে দেখুন, এই দখলবাজি উদ্বাস্তু করে দিয়েছে হাজারো শিশু-কিশোর ও যুবক হৃদয়কে। যেখানে খেলাধুলা করে অনাবিল আনন্দে মেতে উঠার কথা সেখানে তাদের স্থান নেই। খেলার মাঠ কিশোর-যুবকদের মিলনমেলা। ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশের ভিন্ন ভিন্ন পরিবার থেকে আগত ছেলে-মেয়েদের মধ্যে জানাশোনা হয়। মতবিনিময় হয়। এক ধরনের আত্মিক সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। পরস্পর পরস্পরের বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। খেলার মাঠের এই বন্ধুত্ব অটুট থাকে আজীবন। একজনের বিপদে আরেকজন ঝাঁপিয়ে পড়ে। একজন ভুল পথে গেলে অপরজন সঠিক পথ দেখায়। খেলার মাঠকে ঘিরে আয়োজিত হয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকা-। যা তাদের মানসিক বিকাশে সহায়তা হয়। কিন্তু এই দখলবাজি তাদের বন্ধুত্বের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। মুক্তচিন্তার বিকাশ রোধ করেছে। তাদের মনকে ঠেলতে ঠেলতে গৃহবন্দী করে ফেলেছে। ফুটপাথ বা রাস্তার পাশের খোলা জায়গাটাও দখল করেছে হকাররা বা নির্মিত হয়েছে অবৈধ স্থাপনা। বেশিরভাগ স্কুল-কলেজে নেই খেলার মাঠ। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তো শুধুই কংক্রিটের ডিজিটাল ক্যাম্পাস। কোন প্রতিষ্ঠানে খেলার মাঠ থাকলেও খেলাধুলার প্রতি নজর দেয় কে? শুধুই গোল্ডেন পাওয়ার প্রতিযোগিতা। শুধু ভাল ফলাফল কি একজন ছাত্রকে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করতে পারে? কৈশোর বা প্রথম যৌবনের মন তো আনচান করা মন। একজন শিশুর চারপাশের পরিবেশ হচ্ছেÑ তার বড় শিক্ষক। তাদের শিক্ষা নিতে হবে পরিবেশ থেকে, প্রকৃতি থেকে। বিশ্বজুড়ে পাঠশালা মোর, সবার আমি ছাত্র। প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠার জন্য এই কবির মতো বিশ্ব পাঠশালার ছাত্র হতে হবে। কিন্তু গৃহবন্দী এই কিশোর-যুবক মন সে শিক্ষা পাবে কেমন করে। সে তো বন্ধুহীন। বন্ধনমুক্ত নিঃসঙ্গ মানুষ। কিন্তু মানুষ ভালবাসার বন্ধন ছাড়া ভাল থাকতে পারে না। বন্ধনহীন মানুষ মাঝিবিহীন নৌকার মতো। আর এই বন্ধনের সর্বোউৎকৃষ্ট স্থান হলো পরিবার। একটা সময় ছিল যখন বাইরের পরিবেশ ছাড়াও পারিবারিক পরিবেশ ছিল মানসিক উৎকর্ষতার কেন্দ্রস্থল। তখন বেশিরভাগ পরিবারই ছিল যৌথ পরিবার। নিজের ভাই-বোন, মা-বাবা ছাড়াও ছিল দাদা-দাদি, চাচা-চাচি, ফুফু, চাচাত ভাইবোন। এছাড়া নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল ফুফাত, খালাত ও মামাত ভাই-বোনদের। নিজের আত্মীয়স্বজনে ঘেরা পরিবেশে বেড়ে উঠায় পরস্পরের ভালবাসার বন্ধন ছিল অটুট। একজনের সমস্যা সবার সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হতো। একজনের বিপদে অন্যরা ঝাঁপিয়ে পড়ত। মনের কথা বলার মতো ছিল আপন কেউ। ভালবাসার আবহে বড় হওয়া এই পরিবারের তরুণরা কখনই নিঃসঙ্গ হয় না। হতাশায় ভোগার মতো পরিবেশই সৃষ্টি হয় না। কিন্তু কালক্রমে যৌথ পরিবার ভেঙ্গে সব একক পরিবার হয়ে যাচ্ছে। ফলে ভালবাসার বন্ধনের মানুষ দিন দিন কমে যাচ্ছে। এই বন্ধনহীন উদ্বাস্তু মনের তরুণের ভুল পথে পা বাড়ানোর সম্ভাবনা বেশি। তাদের ভুল পথে যাওয়ার একটি বড় কারণ হলো ডিজিটাল আসক্তি। এই আসক্তি মাদকাসক্তির চেয়ে কোন অংশে কম নয়। একই পরিবারে বসবাস করলেও দেখা যায় সবাই ব্যস্ত যার যার মোবাইল বা ল্যাপটপ নিয়ে। ভার্চুয়াল বন্ধুদের সঙ্গে ফেসবুক বা চ্যাটিংয়ে ব্যস্ত। এসব কারণেও অনেক পরিবারে পারিবারিক বন্ধন আলগা বিশেষ করে ছোট একক পরিবারে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে একসময়ে বন্ধুরা গোল হয়ে বসে আড্ডা দিত। সেখানে নির্মল আড্ডা ছাড়াও সাহিত্য, সংস্কৃতি বা রাজনৈতিক চর্চা হতো। এখনও বন্ধুরা বসে, তবে যে যার মতো ব্যস্ত মোবাইল নিয়ে। পাশাপাশি বসে আছে কিন্তু কাছাকাছি নয়, মন অন্য কোথাও। আগে বন্ধুত্বের পাশাপাশি তার পরিবারের সঙ্গেও আত্মীয়ের মতো সম্পর্ক সৃষ্টি হতো। কিন্তু আজকাল এক বন্ধু আর এক বন্ধুর মনের খবর কতটুকু রাখে? বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে ফেসবুক। ফেসবুকে বন্ধুত্ব শুধু সংখ্যায় বাড়ে, আত্মিকভাবে নয়। তাছাড়া ভাইভার, স্কাইপি, হোয়াটসএ্যাপসহ ইন্টারনেটের অন্য মাধ্যমের কল্যাণে বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়। ইচ্ছে করলেই মুহূর্তের মধ্যেই ভাল জগৎ বা খারাপ জগতে প্রবেশ করা যায়। হাত ছানি দিয়ে ডাকে অন্ধকার জগৎ। যে ছেলে বা মেয়ে এখনও স্কুল কলেজে মায়ের হাত ধরে যায় তার হাতে যদি বিশ্ব চলে আসে তাহলে তার তো ভুল হতেই পারে। বিশেষ করে বন্ধনহীন তরুণ এই ভুল বেশি করে থাকে। একটা সময় ছেলে ধরার কথা শুনা যেত। তবে কেউ ছেলে ধরা দেখেছে বা ছেলে ধরার পর কি হয়েছে তা খুব একটা জানা যায় না। তথ্যপ্রযুক্তির এই বর্তমান যুগেও নাকি আছে অদৃশ্য ছেলে (তরুণ) ধরা। ইন্টারনেটের সকল মাধ্যমে তারা ফাঁদ পেতে রেখেছে। বন্ধনহীন উদ্বাস্তু তরুণেরা এই ফাঁদে পা দেয়। তারপর হারিয়ে যায়। কখনও কখনও ফেরত আসে। তবে মানুষ হিসেবে নয়। রক্তপিপাসু রাক্ষস হয়ে। তারা রক্ত স্নান করতে পছন্দ করে। তাদের মনুষত্ব-মানবতা বলতে কিছু নেই। নির্দ্বিধায় মানুষের সমস্ত রক্ত বের করে আনে। তারা রক্ত নেশায় এতটাই বিভোর যে, নিজের রক্তও নির্বিকারভাবে ঢেলে দেয়। সারা বিশ্বে চলছে রক্তের এই হোলি খেলা। বাংলাদেশও সাম্প্রতিক দেখল এই হোলি খেলা। নিরপরাধ দেশী ও বিদেশী মেহমানের রক্তে রঞ্জিত হলো বাংলাদেশের মানচিত্র। শোনা যাচ্ছে এটা নাকি ওই অদৃশ্য ছেলেধরাদেরই কাজ। আর রক্তপিপাসু ঐ ছেলেগুলো আর কেউ নয়, আমাদেরই সন্তান, যারা এক সময় হারিয়ে গিয়েছিল। ভালবাসার বন্ধন সবচেয়ে শক্তিশালী বন্ধন। আমাদের সন্তানদের ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ রাখতে হবে। আর এই বন্ধনের প্রধানতম উৎস হচ্ছে পরিবার। পরিবার হতে হবে ভালবাসায় ভরপুর। মা-বাবা বিশেষ করে মা হচ্ছে পরিবারের নিউক্লিয়াস। যাকে ঘিরে ভালবাসা আবর্তিত হয়। মনে করতে হবে মা শুধু একজন মানুষ বা নারী নন, তিনি হচ্ছেন একটি প্রতিষ্ঠান। যেখানে শুধুই ভালবাসা উৎপাদন হয় এবং যা আত্মিক বন্ধনের সৃষ্টি করে। তাই মা-বাবার প্রতি সন্তানদের বিশ্বাস ও ভরসা রাখতে হবে। পাশাপাশি সন্তানদের শুধু ভালবাসলেই হবে না, তাদের সময় ও সঙ্গ দিতে হবে যেন তারা নিঃসঙ্গতায় না ভোগে। অনাদর-অবহেলার কারণে যাতে আর কোন সন্তানকে ছেলেধরা ছিনিয়ে নিতে না পারে। তারুণ্য উপভোগ করার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। শারীরিক ও মানষিক উৎকর্ষতার উপযোগী সৃষ্টিশীল ও মননশীল কার্যক্রমের ব্যবস্থা করতে হবে। বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। উপেক্ষা করলে পিছিয়ে পড়তে হবে। মনে করতে হবে এটি শুধু প্রয়োজনের এবং উন্নয়নের। এটি নেশার কিছু নয়, নিজেকে যুগোপযোগী করার মাধ্যম। শুধু এর ব্যবহারের ভাল এবং খারাপ বিষয়ে নিজের ও সন্তানদের সচেতন করতে হবে। কিভাবে বুঝবেন আপনার সন্তান ডিজিটাল আসক্তিতে আসক্ত হচ্ছে বা ভুল পথে পা বাড়াচ্ছে? যদি কখনও দেখেন আপনার সন্তান যখন তখন ইন্টারনেটে ব্যস্ত, শোওয়ার সময় মোবাইল সঙ্গে নিয়ে বা কানে হেডফোন লাগিয়ে বিছানায় যাচ্ছে, কম্পিউটার বা ল্যাপটপের মনিটর একটু কোনাকুনি করে রাখছে যাতে সরাসরি অন্যের দৃষ্টি না পড়ে, যদি দেখেন ডিস্টার্ব হওয়ার কথা বলে ইন্টারনেটে পড়াশোনা বা প্রজেক্ট ডাউনলোড করার নামে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে অথবা যখন সন্তানের দৈনন্দিন কার্যক্রম আপনি জানতে বা বুঝতে পারছেন না তখন বুঝতে হবে আপনাকে সতর্ক হওয়ার ও সন্তানকে সতর্ক করার সময় হয়েছে। ছবি : বুলবুল আহমেদ
×