ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গোলাম কুদ্দুছ

আস্থার ঠিকানা শেখ হাসিনা

প্রকাশিত: ০৩:৪১, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬

আস্থার ঠিকানা শেখ হাসিনা

(শেষাংশ) নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঠিক এক বছর পর বিএনপি-জামায়াত পুনরায় মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি জানিয়ে দেশব্যাপী লাগাতার অবরোধ কর্মসূচী ঘোষণা করে। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচী পরিহার করে ভাংচুর, রেললাইন উত্তোলন, থানা ও সরকারী ভবন আক্রমণ, উপর্যুপরি পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করে নিরীহ সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করতে থাকে। তাদের এসব কর্মসূচীতে সাধারণ মানুষের কোন ধরনের অংশগ্রহণ না থাকলেও দেশের অর্থনীতি এবং শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জনসমর্থনহীন ধ্বংসাত্মক এ আন্দোলনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহ সোচ্চার হয়ে ওঠে। বিএনপি-জামায়াতের এ আন্দোলন বুমেরাং হয়ে দাঁড়ায় এবং দেশে-বিদেশে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়। পরিস্থিতি মোকাবেলায় শেখ হাসিনা চরম ধৈর্য এবং বিচক্ষণতার পরিচয় দেন। গণতন্ত্র নয়, যেনতেনভাবে শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাত করাই যে তাদের মূল উদ্দেশ্য এ সত্য মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ থেকে ড. ইউনূসকে অপসারণের কারণে একটি বৃহৎ শক্তি, তাদের কতিপয় সহযোগী এবং তাদের নিয়ন্ত্রিত কিছু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করতে চেয়েছে। দেশের সুশীল সমাজের একটি অংশও প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে তাদের ইন্ধন যুগিয়েছে। এ সময় জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু নির্মাণে সরকার দুর্নীতি করেছে মর্মে বিশ্বব্যাংককে দিয়ে অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। সরকার এ অভিযোগকে মিথ্যা ও বানোয়াট হিসেবে উল্লেখ করে বলে যে, যেখানে পদ্মা সেতুতে একটি টাকারও ঋণ ছাড় দেয়া হয়নি; সেক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং ষড়যন্ত্রমূলক। শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে জাতীয় সংসদে প্রদত্ত ভাষণে পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেন যে, বাংলাদেশ কোন দুর্নীতি করেনি, বিশ্বব্যাংককে তাদের অভিযোগ প্রমাণ করতে হবে, তা না হলে বাংলাদেশ তাদের কাছ থেকে পদ্মা সেতুর জন্য কোন ঋণ গ্রহণ করবে না। বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু নির্মাণ করবে বলে তিনি ঘোষণা দেন। শেখ হাসিনার আত্মপ্রত্যয়ী উচ্চারণ, আত্মমর্যাদা এবং দেশপ্রেম মানুষকে ভীষণভাবে উদ্দীপ্ত করে। তাঁর বলিষ্ঠ ভূমিকায় পদ্মা সেতু এখন আর স্বপ্ন নয়, রেল-সড়ক-গ্যাস লাইনযুক্ত পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ বহুমুখী এই সেতুর নির্মাণ কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে এবং আগামী দু’বছরের মধ্যে সমাপ্ত হবে বলে সরকার ঘোষণা করেছে। কিছুদিন আগে বিশ্বব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান ড. কৌশিক ঢাকায় এসে সরকারের উর্ধতন মহলের সঙ্গে দেখা করে পদ্মা সেতু বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ভূমিকা ভুল ছিল উল্লেখ করেন এবং পদ্মা সেতুসহ সকল প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের সহায়তা প্রদানের নতুন প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল আমাদের দেশের একটি প্রবাদের কথাÑ ‘ঠেলার নাম বাবাজি’। শেখ হাসিনার সততা এবং সাহস বাংলাদেশকে শুধু কলঙ্কের হাত থেকেই রক্ষা করেনি, তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্যও এক শিক্ষণীয় উদাহরণ তৈরি করেছে। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার সাহসী উদ্যোগ ও ভূমিকা তাঁকে বিশেষ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসরাইলের ফিলিস্তিনীদের ওপর বর্বর হামলা এবং নারী-শিশু হত্যার বিরুদ্ধে জাতিসংঘের গত অধিবেশনে শেখ হাসিনা বলিষ্ঠ বক্তব্য রেখেছেন। তিনি ইসরাইলের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপের জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি বৃহৎ শক্তিগুলোকে আধুনিক সমরাস্ত্র উৎপাদন ও বিক্রির পরিবর্তে শিশুদের হাতে বই তুলে দেয়ার আহ্বান জানান। মধ্যপ্রাচ্যে আইএসের উত্থানের ফলে নবগঠিত সৌদি সামরিক জোটকে শেখ হাসিনা এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, বিশ্বের মুলসমানদের পবিত্রতম স্থান মক্কা-মদিনা আক্রান্ত হলে বাংলাদেশ তা রক্ষায় সৈন্য পাঠাতে এক মুহূর্তও দেরি করবে না। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীতে বাংলাদেশী সৈন্যদের ব্যাপক অংশগ্রহণ, সফল অভিযান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মানবিকবোধ, সাহসী উচ্চারণ এবং সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে তাঁর সুদৃঢ় অবস্থান বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রশংসিত। দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করার পর থেকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। বিশ্বজুড়ে যখন অর্থনৈতিক মন্দা চলছিল সে সময় শেখ হাসিনার রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা এবং যথাযথ কর্মপন্থা গ্রহণের ফলে সারাবিশ্বকে বিস্মিত করে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬%-এর ওপরে ধরে রাখে। চলতি অর্থবছরে সাড়ে ৭% প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব বলে মতামত ব্যক্ত করেছে। এর ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী ৫টি দেশের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশের তালিকাভুক্ত হয়ে আমাদের মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। গত ৭ বছরে জাতীয় বাজেটের আকার ৪ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে তা প্রায় সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৮ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ৩০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। রফতানি আয়, কৃষি এবং শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধিও প্রশংসনীয়। খাদ্য ঘাটতির বাংলাদেশ আজ শুধু খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতাই অর্জন করেনি, উল্লেখযোগ্য পরিমাণ চাল বিদেশে রফতানিও করছে। বর্তমানে মাথাপিছু আয় প্রায় ১৪০০ ডলার। দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনসংখ্যা ৫২ থেকে ২২ শতাংশে নেমে এসেছে। দেশের উত্তরাঞ্চলের মঙ্গা পরিস্থিতি এখন শুধু দুঃসহ অতীত। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং নারীর ক্ষমতায়নে শেখ হাসিনা সরকারের সাফল্য আজ বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। শুধু পদ্মা সেতু নয়, হাতিরঝিল প্রকল্প, যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারসহ রাজধানী ঢাকা এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নতুন সড়ক, সেতু, ফ্লাইওভার নির্মাণ ও বিভিন্ন মহাসড়ককে ৪ লেনে উন্নীত করার ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থায় অভাবনীয় অগ্রগতি আজ দৃশ্যমান, যা যাতায়াত ব্যবস্থাকে সহজতর করেছে। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণ করার সময় দেশের বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতের অবস্থা ছিল চরম বিপর্যস্ত। ২০০১ সালে প্রথম মেয়াদে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতা ছেড়ে আসার সময় যেখানে দেশের বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতা ছিল সাড়ে চার হাজার মেগাওয়াট সেখানে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের দায়িত্বহীনতা ও ব্যর্থতার ফলে ২০০৮ সালে তা কমে এসে দাঁড়ায় ৩৭০০ মেগাওয়াটে। লাগাতার লোডশেডিংয়ে শিল্প-কারখানাগুলোর অস্তিত্ব পড়ে যায় হুমকির মুখে। মানুুষের জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে শেখ হাসিনা বিদ্যুত এবং জ্বালানি সঙ্কট দূরীকরণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করেন। নিন্দুকদের উদ্দেশ্যপূর্ণ নানা সমালোচনাকে গুরুত্ব না দিয়ে আশু, স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করে তিনি বিদ্যুত ও জ্বালানি সঙ্কট মোকাবেলা করেন। বর্তমানে দেশের বিদ্যুত উৎপাদনের সক্ষমতা ১৪০০০ মেগাওয়াট। শেখ হাসিনা সরকারের আরেকটি বড় সাফল্য হলো সমুদ্র আইন সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের এবং আইনী লড়াইয়ের মাধ্যমে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমানা নির্ধারণ ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা। এর ফলে গভীর সমুদ্রের টেরিটরিয়াল এরিয়া, ইকোনমিক জোন এবং কন্টিনেন্টাল এরিয়ায় বাংলাদেশের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ সমুদ্রের প্রায় দেড় লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকার প্রাণিজ, খনিজ ও সব ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকারপ্রাপ্ত হয়। ভারতের সঙ্গে সীমান্ত এলাকার বিরোধ নিষ্পত্তি এবং ছিটমহল বিনিময় তাঁর সরকারের আরও একটি বড় সাফল্য। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রতিরক্ষা বাহিনীর আধুনিকায়নে শেখ হাসিনা নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। সাবমেরিন, বিমানবাহী জাহাজ সংযুক্তি এর মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচার, একাত্তরের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন, রাজনৈতিক কর্মসূচীর নামে জ্বালাও-পোড়াও, মানুষ হত্যা কঠোরহস্তে প্রতিরোধ, নানা নামে নানা পরিচয়ে জঙ্গীবাদের উত্থান ও সশস্ত্র তৎপরতা রোধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ, বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় ভারতের বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপের গোপন ঘাঁটি উচ্ছেদ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি স্থাপন শেখ হাসিনাকে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে বিশ্বে নেতৃত্বের কাতারে শামিল করেছে। শেখ হাসিনা পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ পরিবারের সব সদস্যকে হারিয়েছেন। নিজের জীবনের ওপর বার বার হুমকি এসেছে; কিন্তু এসবকে তোয়াক্কা না করে তিনি এগিয়ে চলেছেন মানুষের কল্যাণে, সন্ত্রাস, ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত আধুনিক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ নির্মাণে। এ পথে কাঁটা আছে, গর্ত-নালা আছে, আছে ষড়যন্ত্র, আছে বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতিটি মুহূর্তে আছে জীবনের ঝুঁকি; কিন্তু তাতে কী, তিনি তো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কন্যা- মানুষের ভালবাসা আর দেশপ্রেমে উজ্জীবিত এক দেশনায়ক তিনি। শুধু বাংলার ষোলো কোটি মানুষ নয়, বিশ্বের সন্ত্রাসকবলিত অধিকারহারা প্রতিটি মানুষের লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা ও পথপ্রদর্শক তিনি। ইতিহাস একদিন প্রমাণ করবে শেখ হাসিনার শাসনকাল বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সময়। লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
×