ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা

প্রকাশিত: ০৩:৪০, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬

সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা

জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলে ২০১৫ সালের ২০ অক্টোবর দেশের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১৫/১৬-২০১৯/২০) অনুমোদন করা হয়। এই পরিকল্পনার সময় মৌল দুটি লক্ষ্য হিসেবে ১. প্রবৃদ্ধি বাড়ানো এবং ২. নাগরিকদের ক্ষমতায়ন পরিকল্পনা দলিলের শিরোনামের সঙ্গে উল্লিখিত হয়। এই পরিকল্পনার ভিত হিসেবে দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অবতরণিকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনা সকলের জন্য অমর প্রণোদনাময়ী বাণী হিসেবে উল্লিখিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু পরিকল্পনাকে দেশের বিদ্যমান এবং তর্কাতীত রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার ভিত্তিতে প্রণয়নের প্রয়োজন বলে উল্লেখ করে সকলের জন্য সুস্পষ্ট করে বলেন যে, জাতিকে দৃঢ় সঙ্কল্পবদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে প্রযুক্ত সাহস ও বলিষ্ঠতা নিয়ে গৃহীত পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশ গঠনের লক্ষ্যে নিবেদিত হতে হবে। বঙ্গবন্ধুর এই বাণীতে সন্দিপীত হয়ে বেশ কম সময়ে পরিশীলিত অবয়বে এই সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করে প্রধানমন্ত্রী ও পরিকল্পনা কমিশনের চেয়ারম্যান এবং পরিকল্পনামন্ত্রী প্রশংসনীয় ও অনুকরণীয় কাজ করেছেন। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে ২০১৬ সালের মূল্যমাত্রায় সর্বমোট ৩১৯০২.৮ বিলিয়ন টাকা বিনিয়োগ করা হবে বলে স্থির করা হয়েছে। এর মধ্যে গণক্ষেত্রে বিনিয়োগ হবে ৭২৫২.৩ বিলিয়ন এবং ব্যক্তি খাতে হবে ২৪৬৫০.৫ বিলিয়ন টাকা। ব্যক্তি খাতে এই বিনিয়োগ সার্বিক বিনিয়োগের ৭৭%-এরও বেশি। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে এই বিনিয়োগের জন্য আহরণ করা হবে ২৮৮৫১ বিলিয়ন টাকা (৯০.৪%) এবং বিদেশী উৎস থেকে সহায়তা হিসেবে আসবে প্রায় ৩০৫২ বিলিয়ন টাকা (৯.৬%)। এই পরিমাণ বিনিয়োগের জন্য ২০১৬ সাল থেকে জাতীয় সঞ্চয় মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ২৯.১% থেকে ২০২০ সালে ৩২.১%-এ উন্নীত করতে হবে। এর ফলে ২০১৬ সালে প্রক্ষেপিত প্রকৃত প্রবৃদ্ধির হার বার্ষিক ৭% থেকে ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে ২০২০ সালে ন্যূনপক্ষে ৮%-এ উন্নীত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সময়ে ২০১৬ সালের মুদ্রাস্ফীতির হার বার্ষিক ৬.২% থেকে ২০২০ সালে বার্ষিক ৫.৫%-এ নামিয়ে আনা হবে। প্রক্ষেপণ অনুযায়ী বিনিয়োগ অর্জন করলে ২০২০ সালে দেশের বার্ষিক মাথাপিছু আয় দাঁড়াবে ২২০০ মার্কিন ডলার। একই সঙ্গে সকল নাগরিককে প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করে দারিদ্র্যের অভিঘাত তাৎপর্যমূলকভাবে কমিয়ে আনা হবে। ২০২০ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্য রেখার নিচে মোট জনসংখ্যার ৮.৯%-এরও কম অবস্থান করবে এবং তাদের মানবসম জীবনযাপনের জন্য সরকারের তরফ থেকে যথা প্রয়োজন হস্তান্তরধর্মী পরিশোধন বিস্তৃত ও গভীরতর করা হবে। ২০১৬ সালের মূল্যমাত্রায় সপ্তম পরিকল্পনাকালে কৃষিতে গণবিনিয়োগ হবে ৪১৮ বিলিয়ন, শিল্পে ১৯৮ বিলিয়ন এবং বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতে ১০১৩ বিলিয়ন টাকা। সপ্তম পরিকল্পনায় প্রক্ষেপিত গণবিনিয়োগের ৬.৬% কৃষিতে, ১৫% বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতে, ২৪% পরিবহন ও যোগাযোগ উন্নয়নে, প্রায় ৯% স্বাস্থ্য খাতে, ১৬% শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে প্রয়োগ করা হবে। শিল্প খাতে গণবিনিয়োগ হবে সর্বমোট প্রায় ১৯৮ বিলিয়ন টাকা। শিল্প ও কৃষি খাতে ব্যক্তি-বিনিয়োগ গণ খাতে বিনিয়োগের চাইতে হবে অনেক বেশি। সামগ্রিক উন্নয়নের ফলে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে কৃষির অবদান সমকালীন ১৮% থেকে প্রায় ১৩%-এ নেমে আসবে, শিল্পের অবদান ৩৩%-এ উন্নীত হবে, সেবা খাতের অবদান ৫৪%-এ থাকবে, বিদ্যুত উৎপাদন বাড়বে ২৩ হাজার মেগাওয়াট, পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে মোট বিনিয়োগ প্রযুক্তি হবে প্রায় ১৫৫২ বিলিয়ন টাকা। তর্কাতীতভাবে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার দুটি বৈশিষ্ট্য প্রতিভাত হয়। (১) এই পরিকল্পনা আগের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাগুলোর তুলনায় বিশাল ও অধিকতর সুবিন্যস্ত। বিশেষত ২০০১Ñ২০০৮ পর্যন্ত খালেদা-নিজামী সরকার ও তার পরের সংবিধান লঙ্ঘনকারী স্বৈরতান্ত্রিক শাসন পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার পরে ২০০২ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত দেশের সমন্বিত উন্নয়নের জন্য কোন পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়নি। খালেদা জিয়ার আগের সরকার অনুসরণীয় অবয়বেও যথাসময়ে চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নে ব্যর্থ হয়েছিল। জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচিত সরকার ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের জন্য পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা সুঠাম অবয়বে প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করেছিল। ২০০৯ থেকে শুরু করে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করে তা সফল ও সুবিন্যস্ত করতে তার সরকার সক্ষম হয়েছে। ২০১৫-এ খালেদা-নিজামী ও ফখরউদ্দীন-মঈনউদ্দীন প্রশাসনের ২০০২ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত গোষ্ঠীগত স্বার্থ উদ্ধারের অপচেষ্টার বিপরীতে জাতীয় উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেয়ার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয়েছে। এই পরিকল্পনার মুখবন্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এর ভিত্তিতে জাতি হিসেবে আমরা উন্নয়ন-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়িত করতে এবং তার ভিত্তিতে একটি ন্যায়নিষ্ঠ ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ার পথে এগিয়ে যেতে পারব। (২) আগেকার পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাসমূহ এবং পরিকল্পনাবিহীন কালের আপেক্ষিকতায় সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ব্যক্তি-উদ্যম ও বিনিয়োগকে কৃষি ও শিল্প খাতের প্রসারে সর্বাত্মক সুযোগ দেয়া হয়েছে এবং একই সঙ্গে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ বাড়িয়ে অতি দরিদ্রদের অনুকূলে ন্যূনতম গ্রহণযোগ্য মানের জীবনধারণের সহায়তা প্রদানের ভিত্তিতে সকলের জন্য নিজকে বিকশিত করার সুযোগ সৃষ্টি ও সমতুল্য করা হয়েছে। জনগণের অনুকূলে প্রদত্ত সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি যে এই রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে সকল নাগরিকের জন্য স্বাধীন সত্তায় সমৃদ্ধি অর্জন করার লক্ষ্যে তার এমন বহুমাত্রিক ও বস্তুনিষ্ঠ সমর্থন এর আগে প্রথম ও পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ছাড়া অন্য কোন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বা অন্তর্বর্তীকালীন আর্থ-সামাজিক কার্যক্রমে প্রতিফলিত হয়নি। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার বাস্তবায়নের কতিপয় মৌল কৌশল পরিকল্পনা দলিল থেকে অনুধাবন করা যায় : এই পরিকল্পনায় প্রক্ষেপিত কৃষি ও শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধির প্রক্রিয়ায় একক বাজার সৃজন সবচেয়ে বেশি ফলোৎপাদক হবে বলে ধরা হয়েছে। পদ্মা সেতু নির্মাণের মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ অঞ্চলকে অন্য অঞ্চলসমূহের সঙ্গে একটি একক বাজারের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। এর সঙ্গে সড়ক ও রেল যোগাযোগ বিস্তৃত এবং উন্নীত করে উৎপাদন, উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাতকরণ ও সেসবের ভোগ বা অবক্ষয়কে সুসংহত যোগসূত্রে আন্তঃখাত বিবর্তন এবং উন্নয়নের ফলপ্রসূ উপকরণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট করা হয়েছে। একই সময়ে টেলিযোগাযোগ বিস্তৃত ও নিবিড় করে তথ্য যোগাযোগের এই মাধ্যমকে নিপুণতর শিক্ষা, যোগাযোগ, উৎপাদন ও বিপণনের ক্রমবর্ধক উপকরণ হিসেবে যোগ করা হয়েছে। নতুন বন্দর স্থাপন, বিদ্যমান বন্দরের উন্নয়ন এবং আন্তঃদেশসহ সব অবকাঠামোমূলক সম্প্রসারণ, বাণিজ্যের প্রসার, ব্যক্তি উদ্যোগের ভিত্তিতে উন্নয়নের মৌল ভিত্তি ও সঞ্চালক হিসেবে অগ্রণী করার জন্য এর আগে এই ধরনের আন্তঃখাত সমন্বয়মূলক কার্যক্রম গ্রহণ কিংবা অনুসরণ করা হয়নি। (১) কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে উৎপাদন বাড়ানোর মৌল উপকরণ হিসেবে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। ২০২০ সালের মধ্যে সমকালীন ১৩ হাজার ৫শ’ মেগাওয়াট থেকে ২৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন বাড়ানোর কার্যক্রমের রূপরেখা সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সুনির্দিষ্টভাবে স্থান পেয়েছে। এর সঙ্গে যথা প্রয়োজন সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন প্রসারিত করে দেশের সকল এলাকাকে বিদ্যুতায়িত করে সামগ্রিক উৎপাদন বৃদ্ধি, একটি জ্ঞান উন্মুখ সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং কুসংস্কারমুক্ত প্রগতিশীল সমাজ প্রতিষ্ঠিত করার কার্যক্রম সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সুবিন্যস্ত করা হয়েছে। এর ফলে গ্রাম ও শহরের সংযোগ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প হতে বৃহদাকার শিল্প স্থাপনকরণের দৃঢ় বুনিয়াদের আগে অন্য কোন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এত দৃঢ় ও সুসংহতভাবে দেয়া হয়নি। একই সঙ্গে আন্তঃখাত সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে বস্তুনিষ্ঠ উপকরণ উৎপাদন হার প্রযুক্ত করে সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক পরিবর্তন, বিবর্তনকে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার আলোকে সংবেদনশীল কাঠামোয় আনা হয়েছে। (২) প্রাথমিক শিক্ষা সর্বজনীন করে উচ্চশিক্ষার পর্যায়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষাকে প্রাধান্য দিতে এর অবকাঠামোমূলক উন্নয়ন প্রসারিত করে, একই সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবা পরিব্যাপ্ত এবং সকলের জন্য লভ্য করে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আওতায় সমাজে সকলের সমভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ তৈরির মাধ্যমে সবক্ষেত্রে দক্ষ শ্রমিক সৃষ্টি করার বিস্তৃত কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। এ ধরনের বিপুল ও বিশাল কার্যক্রম এর আগে নেয়া হয়নি। (৩) দারিদ্র্য, বিশেষত চরম দারিদ্র্য দূর করার উদ্দেশ্যে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে কর্মসংস্থানের পরিধি বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে অসহায় ব্যক্তিবর্গকে রাষ্ট্র থেকে ন্যূনতম মানসম্পন্ন জীবনধারণে সক্ষম রাখার জন্য হস্তান্তরমূলক কার্যক্রম ও ব্যয়ের পরিধি বাড়ানো হয়েছে। ফলে দেশে দারিদ্র্যসীমা, বিশেষত চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানরত লোকগোষ্ঠীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমানোর কার্যক্রম প্রযুক্ত করার প্রস্তাব এই পরিকল্পনায় স্থান পেয়েছে। এক্ষেত্রে এর চাইতে ব্যাপক ও অধিকতর সুবিন্যস্ত কার্যক্রম এর আগে গ্রহণ করা হয়নি। নিঃসন্দেহে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্যমাত্রা বিশাল ও বিস্তৃত। এই প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ, পরিকল্পনার তত্ত্ব এবং তথ্যের সংহত ও নিবিড় বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বলা যায়, এসব লক্ষ্য অর্জনে সরকারের দৃষ্টিকোণ থেকে কতিপয় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে : (১) এই পরিকল্পনার মূল ভিত্তি সঞ্চয় বর্ধনাদেশের সার্বিক সঞ্চয় মাত্রা সমকালীন মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদের ২৯% থেকে ন্যূনপক্ষে ৩২%-এ বাড়াতে হবে। এ পরিমাণ সঞ্চয় বাড়াতে হলে সরকারের আয় বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তি-সঞ্চয় উৎসাহিত করতে হবে। ব্যক্তি সঞ্চয় উৎসাহিতকরণের প্রক্রিয়ায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে আকর্ষণীয় অবয়বে অধিকসংখ্যক আর্থিক হাতিয়ার সৃষ্টি এবং মূলধন বাজারকে বিস্তৃত ও গভীর করতে হবে এবং সঞ্চয় ও বিনিয়োগের মাধ্যমায়নকে অধিকতর সক্রিয়, নিপুণ এবং মিতব্যয়ী প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত করতে হবে। এই লক্ষ্যে বিস্তারিত কার্যক্রম প্রণয়ন করার অবকাশ রয়েছে। (২) সার্বিকভাবে দেশের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ক্রমবর্ধনীয় মূলধন : উৎপাদন হার ৪.৫%-এ অনুকল্পিত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুত উন্নয়শীল দেশসমূহে অর্জিত উৎপাদনশীলতা এ দেশে দৃষ্ট বা প্রক্ষেপিত ক্রমবর্ধনীয় মূলধন : উৎপাদন হার তথা উৎপাদনশীলতা থেকে তাৎপর্যমূলক মাত্রায় বেশি। এরই প্রেক্ষিতে সবক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য কার্যক্রম প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা লক্ষ্যানুুগ হবে। আন্তঃক্ষেত্র বিশ্লেষণভিত্তিক সহগ নির্ধারণ করে সকল উন্নয়ন প্রকল্প ও কার্যক্রমে তার ইতিবাচক প্রতিফলন ঘটানোর ওপর দৃষ্টি দিতে হবে। এই ক্ষেত্রে যথা ঈপ্সিত বিশ্লেষণ অগ্রবর্তী করার পরিধি এই পরিকল্পনায় এখনও বিস্তৃত। (৩) বর্ধিত রফতানি আয় এবং বিদেশ থেকে শ্রমিক প্রেরিত অর্থ যাতে অধিকতর মাত্রায় মূলধন দ্রব্য অর্থাৎ কলকব্জা ও অন্যান্য অববায়িত প্রযুক্তি এবং প্রয়োজনীয় মাধ্যমিক দ্রব্যাদি আমদানি ও ব্যবহারকরণের জন্য সর্বাত্মক মাত্রায় ব্যবহৃত, একই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ক্রমবিকাশমান প্রযুক্তির উন্নয়ন অর্জন হতে পারে তার জন্য সুঠাম কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জাতীয় ভোগমাত্রা বাড়ানোর যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে তা পরিশীলিত করে অববায়িত প্রযুক্তি ও প্রয়োজনীয় মাধ্যমিক পণ্যাদির আমদানি মাত্রা বাড়িয়ে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের জন্য ক্রমবর্ধমান বাজার সৃষ্টি ও সংরক্ষণের যুক্তিসঙ্গত কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। এই ধরনের কার্যক্রম এখনও সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় পূর্ণাঙ্গভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। (৪) কৃষি ক্ষেত্রে অধিকতর উৎপাদন অর্জন করার লক্ষ্যে ভারতের সঙ্গে অস্তিত্বমান ৫৩টি সাধারণ নদীর প্রবাহ সুনির্দিষ্ট চুক্তির আওতায় নিশ্চিত করে ভূমির ওপরে লভ্য সমস্ত পানি সম্পদের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে নদী-অববাহিকাভিত্তিক উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কর্মানুগ হবে। একই সঙ্গে কৃষি ক্ষেত্রে সবুজ বিপ্লবের পরবর্তী পর্যায়ে অধিকতর উচ্চ ফলন (উফশী), খড়া ও বন্যা সহিষ্ণু বীজ উদ্ভাবন ও ব্যবহার এবং কৃষি যন্ত্রীকরণ প্রসার ঘটাতে হবে। কৃষি উৎপাদন যাতে অধিকতর উৎপাদনপ্রসূত মূল্য হ্রাসের শিকার না হয় তার জন্য লাগসই শস্য বীমা, পণ্য বিনিময়াগার ও ভবিষ্যত বাজার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এই লক্ষ্যে সুবিন্যস্ত কার্যক্রম এখনও গ্রহণ করা হয়নি। তেমনি কৃষি গবেষণাকে সুবিন্যস্ত ও বিস্তৃত করে আমিষ জাতীয় ফসলাদির অধিকতর উৎপাদন এবং সার্বিকভাবে ফসল নিবিড়তা বাড়াতে নগদ ফসল যথা পাট, চা, রাবার উৎপাদনে অধিকতর মনোযোগী হতে হবে। (৫) উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সৃষ্টি ও বিস্তৃত করার সঙ্গে তাদের সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। সকল অবকাঠামো ব্যবহারের পরিধি নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে লাগসই সংরক্ষণের কার্যক্রম সুনির্দিষ্টভাবে গ্রহণ ও অনুসরণ করতে হবে। এই লক্ষ্যে ক্ষেত্র বিশেষে ব্যক্তি উদ্যোগ ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকারে যোগাযোগ, সহযোগিতা ও দায়িত্ব সঞ্চালনের যথাযথ প্রণালী ও অবয়ব স্থিরিকৃত করতে হবে। একই সঙ্গে বাণিজ্যবান্ধব সময়ানুগ এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিবর্তনশীল একটি বিদেশী মুদ্রার পরিবর্তে ন্যূনপক্ষে ৪টি শক্তিশালী বিদেশী মুদ্রার সঙ্গে সম্পর্কিত করে টাকার মান নির্ধারণ ও অনুসরণ করা কর্মানুগ হবে। (৬) আঞ্চলিক বাণিজ্য প্রসারিত করতে হবে। ভারত, নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্যের মাধ্যমে উৎপাদন, ভোগ এবং বিনিয়োগের সর্বাত্মক সুযোগ সৃষ্টি ও ব্যবহার করতে হবে। বিশেষত বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী ভারতীয় রাজ্যসমূহ যথা পশ্চিম বাংলা, মেঘালয়, অসম, অরুণাচল, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, মণিপুর ও ত্রিপুরার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আনুষ্ঠানিক বাণিজ্যের প্রসারকে অধিকতর গুরুত্ব দিতে হবে। এই লক্ষ্যে স্পষ্টতর ও বহুমাত্রিক কার্যক্রম ও প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। ব্যক্তি উদ্যোগের ভিত্তিতে উন্নয়ন কর্মকা-ের সিংহভাগ সম্প্রতি প্রযুক্ত হওয়ার প্রেক্ষিতে ভারত পরিকল্পনা কমিশন বিলুপ্ত করে তার স্থানে নীতি কমিশন প্রতিষ্ঠিত করেছে। আমাদের দেশে সকল ক্ষেত্রে সমন্বিতভাবে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সার্বিক দিকনির্দেশনা ও উদ্যোগের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিকল্পনা কমিশনের ভূমিকা সক্রিয় মাত্রায় বিদ্যমান। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা যথাযথভাবে জনগণের উন্নয়ন ও কল্যাণে বাস্তবায়িত করে মালয়েশিয়ার মতো একটি বলিষ্ঠ ও চলিষ্ণু মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য পরিকল্পনা কমিশন তার ভূমিকা যৌক্তিকভাবে প্রদর্শন করতে সমর্থ হবে। পঞ্চম ও ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা সফলভাবে প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে জননেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার প্রধান হিসেবে যে দূরদৃষ্টি, দৃঢ়তা ও শৃঙ্খলাবোধ দেখিয়েছেন তার বিস্তৃততর ও উৎকর্ষতর প্রয়োগ সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে এসব চ্যালেঞ্জ সফলভাবে মোকাবেলা করতে পারবে বলে জাতি নিঃসন্দেহ। বঙ্গবন্ধু প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য মুক্তিযুদ্ধে প্রদর্শিত জাতির যে সর্বজনীন একাগ্রতা ও দৃঢ় সঙ্কল্প প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেছেন তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একাগ্রচিত্তে প্রয়োগ করে ২০২০ সালে অর্থাৎ সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা সমাপনী বছরে দেশকে নিঃসন্দেহে মধ্য আয়ের দেশে রূপান্তরিত করা যাবে বলে প্রায় সব অর্থনীতিবিদ, ব্যবস্থাপক ও প্রশাসকরা আশা করছেন। লেখক : সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য
×