ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পাহাড়ের তিন জেলায় হরতাল

পার্বত্য এলাকায় ভূমি হারানোর শঙ্কায় বাঙালীরা

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬

পার্বত্য এলাকায় ভূমি হারানোর শঙ্কায় বাঙালীরা

মোয়াজ্জেমুল হক/জীতেন বড়ুয়া/মোহাম্মদ আলী ॥ রবিবার তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে পাঁচটি বাঙালী সম্প্রদায়ের সংগঠনের উদ্যোগে পালিত হরতালের নেপথ্যে রয়েছে ভূমি হারানোর শঙ্কা। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশন ইস্যুতেই পাহাড়ে বসবাসরত বাঙালীদের মাঝে উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নে প্রধান সমস্যা পাহাড়ের ভূমির মালিকানা। তিন পার্বত্য জেলায় পাহাড়ী-বাঙালীদের মধ্যে ভূমি বিরোধকে কেন্দ্র করে আন্দোলন চলমান থাকার পাশাপাশি নতুন করে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে ভূমি নিষ্পত্তি কমিশন আইন-২০০১ ও সংশোধনী ২০১৬ কে কেন্দ্র করে। এ নিয়ে ক্ষোভের দানা বেঁধেছে পাহাড়ে বসবাসরত বিশাল বাঙালী জনগোষ্ঠীর মাঝে। প্রসঙ্গত, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির আলোকে ১৯৯৯ সালের ৩ জুন গঠিত ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের প্রথম চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হক চৌধুরী দায়িত্ব গ্রহণের আগেই ইন্তেকাল করেন। ২০০০ সালের ৫ এপ্রিল কমিশন পুনর্গঠিত হয়। চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পান বিচারপতি আবদুল করিম। দায়িত্ব গ্রহণের কিছুদিন পর শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি পদত্যাগ করেন। এরপর ২০০১ সালের ২৯ নবেম্বর কমিশনের তৃতীয় চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পান বিচারপতি মাহমুদুর রহমান। তিনি জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) বিরোধিতার মুখে কাজই শুরু করতে পারেননি। ২০০৭ সালে বিচারপতি মাহমুদুর রহমান ইন্তেকাল করেন। এরপর ২০০৯ সালের ১৬ জুলাই বিচারপতি খাদেমুল ইসলাম চৌধুরীকে তিন বছরের জন্য এ কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে নিয়োগ দেয়া হয়। দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি কাজ শুরু করেন। তিনি পার্বত্য তিন জেলায় কিছু মতবিনিময় ছাড়াও কমিশনের বৈঠকও করেন। তাঁর আমলে প্রণীত আইনানুযায়ী খাগড়াছড়িতে কমিশনের সদর দফতর স্থাপন করা হয়। ২০১২ সালের ১৮ জুলাই চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁর মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এরপর কমিশনের এ পদটি প্রায় দুই বছর শূন্য পড়ে থাকে। ২০১৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মোঃ আনোয়ার উল হককে কমিশনের পঞ্চম চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়া হয়। এদিকে, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে সরকার ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠন করার পর পাহাড়ের বিভিন্ন সংগঠন এ কমিশনকে একতরফা বলে আখ্যা দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে আসছে। চলতি বছর ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনে কিছু সংশোধনী আনা হলে এবার বাঙালীরা বিগড়ে বসে। যে কারণে তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশন নিয়ে রবিবার প্রথমবারের মতো হরতাল-অবরোধ ও মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করেছে তিন পার্বত্য জেলায়। এ কর্মসূচীতে বাঙালীদের ৫টি সংগঠন সম্পৃক্ত হয়েছে। এগুলো হচ্ছে পার্বত্য সম অধিকার আন্দোলন, পার্বত্য নাগরিক পরিষদ, পার্বত্য গণপরিষদ, বাঙালী ছাত্র পরিষদ ও পার্বত্য বাঙালী ছাত্র ঐক্য পরিষদ। হরতাল পালিত হয়েছে স্বাভাবিকভাবে। তবে কোন ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেনি। রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে এ কর্মসূচী চলাকালে দূরপাল্লার ও অভ্যন্তরীণ সড়কের কোন যানবাহন চলাচল করেনি। বিক্ষিপ্তভাবে দোকানপাট বন্ধ ছিল। হরতাল আহ্বানকারীরা রাস্তায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে তাদের কর্মসূচীর পক্ষে বক্তব্য দিয়েছে। এদিকে, হরতালের সমর্থনে তিন জেলায় বিভিন্ন পয়েন্টে বাঙালী সংগঠনগুলো খ- খ- মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে। বাঙালী ছাত্র পরিষদের খাগড়াছড়ি জেলা শাখার নেতা মাঈনউদ্দিন ও এসএম মাসুম রানার নেতৃত্বে হরতালের সময় সড়কে পিকেটিং করা হয়। এ সময় শহরজুড়ে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন ছিল। অনুরূপ অবস্থা দেখা গেছে, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে। পার্বত্য নাগরিক পরিষদের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার আলকাস আল মামুন ভুইয়া জনকণ্ঠকে জানান, পার্বত্য জনগণের আন্দোলনকে উপেক্ষা করে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১ ও এর সংশোধনী ২০১৬-এর বাস্তবায়নের জন্য তড়িঘড়ি করে রাঙ্গামাটিতে এ বৈঠক আহ্বান করেছে। যা বাঙালী জনগণের মনে আঘাত করেছে। এদিকে রবিবার রাঙ্গামাটি সার্কিট হাউসে অনুষ্ঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী বলেন, সংশোধিত পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনের আইনে প্রত্যেকের ভূমির অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী বলেন, সংশোধিত পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশন আইনের মাধ্যমে পাহাড়ের ভূমিবিরোধ শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান হবে। এই আইনের মাধ্যমে প্রত্যেকের ভূমি অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে কোন সম্প্রদায় বঞ্চিত হবে না। এজন্য তিনি সকলকে সহায়তা করার আহ্বান জানিয়েছেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ অ াইন ২০১৬-এর সংশোধনী অধ্যাদেশ জারির পর রাঙ্গামাটি সার্কিট হাউসে বৈঠকের প্রাক্কালে কমিশনের সদস্য, প্রশাসনের কর্মকর্তা ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে মতবিনিময় কালে গওহর রিজভী এ কথা বলেন। এ অনুষ্ঠান শেষে রাঙ্গামাটি সার্কিট হাউসে ভূমি কমিশনের বৈঠক বসে। বৈঠকে কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ার উল হক সভাপতিত্ব করেন। সভায় সন্তু লারমাসহ কমিটির ৯ সদস্য উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে কমিশন চেয়ারম্যান সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকদের বৈঠক ফলপ্রসূ হয়েছে বলে জানান এবং ভূমি কমিশন আইন নিয়ে উদ্বেগের কোন কারণ নেই বলে অবহিত করেন। আমাদের বান্দরবান প্রতিনিধি জানিয়েছেন, সেখানকার বাঙালী সংগঠনগুলোও অনুরূপ হরতাল পালন করেছে। তবে সবকিছু স্বাভাবিক ছিল।
×