ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর এম আবদুর রহিম আর নেই

প্রকাশিত: ০৪:৫৯, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬

বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর এম আবদুর রহিম আর নেই

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য এম আবদুর রহিম (৮৯) আর নেই। রবিবার বেলা এগারোটা ২০ মিনিটে রাজধানীর ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন)। তিনি স্ত্রী, ২ পুত্র, ৪ কন্যাসহ অসংখ্য আত্মীয়স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তাঁর বড়পুত্র এম. ইনায়েতুর রহিম হাইকোর্টের বিচারপতি এবং ছোট ছেলে ইকবালুর রহিম এমপি জাতীয় সংসদের হুইপ। মরহুমের প্রথম নামাজে জানাজা রবিবার বিকেলে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় সর্বস্তরের শোকার্ত মানুষের ঢল নামে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রবীণ এই রাজনীতিকের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং তাঁর মাগফিরাত কামনায় এক মিনিট নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে শোকার্ত পরিবারের সদস্যদের সান্ত¡না দেন প্রধানমন্ত্রী। মরহুমের প্রতি রাষ্ট্রপতির পক্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন তাঁর সামরিক সচিব। এরপর জাতীয় সংসদের স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন। শ্রদ্ধা নিবেদনের আগে মরহুমের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রথমে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। নামাজে জানাজার পর আবদুর রহিমের লাশ হেলিকপ্টারযোগে দিনাজপুরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে গোর-এ-শহীদ বড় ময়দানে তাঁর দ্বিতীয় নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। বাদ আছর দিনাজপুর সদর উপজেলার জালালপুর গ্রামের নিজ বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে মরহুমের লাশ দাফন সম্পন্ন হয়েছে। এদিকে এম আবদুর রহিমের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পৃথক শোক বাণীতে তাঁরা মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। এক শোক বার্তায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর মৃত্যুতে দেশ একজন বিশিষ্ট রাজনীতিক, আইনজীবী ও সমাজকর্মী এবং আওয়ামী লীগ একজন ত্যাগী নেতাকে হারাল। দিনাজপুরের মানুষ ওই অঞ্চলের উন্নয়নে এই বিশিষ্ট নেতার অবদানের কথা চিরদিন গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। এছাড়া গভীর শোক প্রকাশ করেছেন জাতীয় সংসদের স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, ডেপুটি স্পীকার মোঃ ফজলে রাব্বী মিয়া, বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ, চীফ হুইপ আ স ম ফিরোজ, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন, জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান ও পরিবেশমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু প্রমুখ। বার্ধক্যজনিত জটিলতা নিয়ে গত ২ আগস্ট দিনাজপুরের জিয়া হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন আবদুর রহিম। সেখানে তাঁকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য ৯ আগস্ট তাঁকে ঢাকা এনে বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় রবিবার তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মরহুমের চার কন্যার মধ্যে ডাঃ নাসিমা বেগম ও ডাঃ নাদিরা বেগম ঢাকায় চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত রয়েছেন। অপর দুই কন্যা নাফিসা বেগম ও নাজিলা বেগম গৃহবধূ। মুক্তিযুদ্ধকালীন পশ্চিমাঞ্চলীয় জোনের চেয়ারম্যান প্রয়াত রাজনীতিক আবদুর রহিম ছিলেন দেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য। স্বাধীনতার পর তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি, সে সময় বঙ্গবন্ধু সভাপতি হিসেবে এই দলের দায়িত্ব পালন করেন। এম. আবদুর রহিম ১৯২৭ সালের ২১ নবেম্বর দিনাজপুর সদর উপজেলার শঙ্কপুর ইউনিয়নের জালালপুর গ্রামের এক সম্ভান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বৃহত্তর দিনাজপুর অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। পাক বাহিনী দিনাজপুর আক্রমণ করলে এম আব্দুর রহিমকে আহ্বায়ক করে দিনাজপুরে মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। মানবিক মূল্যবোধ আর দেশাত্মবোধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে তিনি ভারতের পতিরাম, রায়গঞ্জ, কালিয়াগঞ্জ, বালুরঘাট, গঙ্গারামপুরসহ বিভিন্ন এলাকার শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মরহুম আবদুর রহীম তৎকালীন মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর এবং বর্তমান ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেন। প্রয়াত এই রাজনীতিকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে তৎকালীন পাকিস্তানী সেনাশাসক সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচার করে তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদ-ে দ-িত করেন। ‘৭৫ পরবর্তী সামরিক শাসকদের কোন প্রলোভনই তাঁকে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। তাঁর লেখা ধর্মের মুখোশ ও ৫ম সংশোধনীর মাজেজা নামক দুটি গ্রন্থই ব্যাপক সাড়া জাগায়। স্টাফ রিপোর্টার দিনাজপুর থেকে জানান, মরহুম এম. আব্দুর রহিম তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে একজন সৎ, নির্ভীক, সমাজসেবক ও প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ হিসেবে ব্যাপক সুনাম ও খ্যাতি রয়েছে। তিনি পেশাগত জীবনে একজন আইনজীবী ছিলেন। আইন পেশাতেও তিনি ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছেন। তিনি দিনাজপুর জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ছিলেন। তাঁর দেশ, জাতি ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হিসেবে ব্যাপক সুনাম রয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি স্বাধীনতার জন্য নিবেদিত প্রাণ হিসেবে কাজ করেছেন। ছাত্রাবস্থায় রাজশাহী কলেজে ভাষা আন্দোলনের কর্মসূচীতে সংযুক্ত ছিলেন। মুসলিম লীগ সরকারের হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর যুক্তফ্রন্টের একজন কর্মী হিসেবে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনী প্রচারাভিযানে অংশ নেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যদের বিরুদ্ধে দায়ের ঐতিহাসিক আগরতলা মামলার তিনি লিগ্যাল এইড কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে সারাদেশকে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য যে ১১ বেসামরিক জোনে ভাগ করা হয়, এম. আব্দুর রহিম ছিলেন পশ্চিম জোনের জোনাল চেয়ারম্যান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর দিনাজপুর গোর-এ-শহীদ বড় ময়দানে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। ১৯৭২ সালের ১১ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের জন্য গঠিত কমিটির ৩৪ সদস্যের মধ্যে তিনি একজন সদস্য ছিলেন। তিনি ১৯৯১ সালে দিনাজপুর সদর আসন থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য পুনরায় নির্বাচিত হন। তিনি দীর্ঘদিন দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগ ও দিনাজপুর জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর মৃত্যুতে দিনাজপুর-৪ আসনের সাংসদ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও দিনাজপুর-২ আসনের সাংসদ খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী এ্যাড মোস্তাফিজুর রহমান এমপি, সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের প্রশাসক আজিজুল ইমাম চৌধুরী, দিনাজপুর-১ আসনের সাংসদ মনোরঞ্জনশীল গোপাল, দিনাজপুর-৬ আসনের সাংসদ শিবলী সাদিক, দিনাজপুর চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, দিনাজপুর প্রেসক্লাব, দিনাজপুর মোটরপরিবহন মালিক সমিতি, দিনাজপুর মোটর পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন, দিনাজপুর জেলা আইনজীবী সমিতিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠনের পক্ষ থেকে শোক প্রকাশ করা হয়েছে।
×