ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

লন্ডনের চিকিৎসা বাংলাদেশে সম্ভব, তাই ফিরে এসেছেন নিজস্ব জল হাওয়ায়

অটুট মনোবল নিয়ে এখনও অসুন্দরের বিরুদ্ধে সৈয়দ হক

প্রকাশিত: ০৪:৫৭, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬

অটুট মনোবল নিয়ে এখনও অসুন্দরের বিরুদ্ধে সৈয়দ হক

স্টাফ রিপোর্টার ॥ শরীরে অসুখ। বেশ ধকল যাচ্ছে। তাই বলে মনোবল হারাননি সৈয়দ শামসুল হক। সকল অন্যায় অসুন্দরের বিরুদ্ধে অহর্নিশ যোদ্ধা তিনি। এখনও একইরকম লড়াকু। ভরপুরপ্রাণ। দৃঢ়চিত্ত। জীবনের উৎসবে আছেন আগের মতোই। বাংলাদেশের অগ্রগণ্য কবি সব্যসাচী লেখক ক্যান্সার নিয়ে সামান্যই ভাবীত। লন্ডনে যে চিকিৎসা চলছিল ঢাকায়ও তা অব্যাহত আছে। স্বদেশের আলো হাওয়া জলের স্পর্শে গতি পেয়েছে লেখালেখি। সৃষ্টির নিজস্ব জগতে গভীর ডুব দিয়েছেন। ভক্ত অনুরাগী পাঠক এ সময় তার ধ্যান ভঙ্গের কারণ না হয়ে বরং প্রার্থনা করবেন, এমন প্রত্যাশা পরিবার ও ঘনিষ্টজনদের। ফুসফুসে ক্যান্সার আক্রান্ত সৈয়দ হক গত শুক্রবার ভোরে দেশে ফেরেন। পরিবারের একাধিক ঘনিষ্ট সূত্র জানায়, লন্ডনের রয়্যাল মার্সেডন হাসপাতালে যে চিকিৎসা চলছিল একই চিকিৎসা ঢাকায় সম্ভব। এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পরই তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। গত কয়েক মাসে বাংলার জল হাওয়ার সঙ্গে, মানুষের সঙ্গে যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছিল, সেটি দূর করতে ব্যাকুল ছিলেন কবি। এই ব্যাকুলতাও আমলে নেয় পরিবার। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ৮০ বছর বয়সী সৈয়দ হক বর্তমানে বেশিরভাগ সময় গুলশানের নিজ বাসভবনে কাটাচ্ছেন। বাসায় যেমন আছেন, যেতে হচ্ছে হাসপাতালেও। ইউনাইটেড হাসপাতালের ভারতীয় বিশেষজ্ঞ ডাঃ শান্তনু চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা চলছে তাঁর। জানা যায়, ফুসফুসে ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণে রাখতে লন্ডনে নিয়মিত কেমোথেরাপি ও রেডিও থেরাপি দেয়ার হয় কবিকে। বিদেশের হাসপাতালে ৬টি কেমোথেরাপি নেয়ার পর শনিবার থেকে ঢাকার চিকিৎসা পর্ব শুরু হয়েছে। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ঢাকায় প্রায় একই চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে কবিকে। কেমোথেরাপির পাশাপাশি চলবে ইমুইনোথেরাপি। কেমোথেরাপি প্রচ- যন্ত্রণার। ২১ দিন পর পর এই যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে কবিকে। শরীর কিছুটা দুর্বল। তবে কবির খুব ঘনিষ্ট একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, সৈয়দ শামসুল হক একদমই ভেঙ্গে পড়েননি। মানসিকভাবে তিনি খুবই শক্ত। সৃষ্টির জগতে আগের মতোই ডুবে আছেন। সব ধরনের লেখালেখি চলছে। ঠিক এই মুহূর্তে একটি উপন্যাস লেখার কাজ করছেন তিনি। এটি প্রায় শেষ পর্যায়ে। চলছে কবিতা লেখাও। একই সূত্র জানায়, কবির শরীরের এখন যে অবস্থা লন্ডনেও প্রায় অভিন্ন ছিল। তখনও অসুস্থতা তাঁকে দুর্বল করতে পারেনি। অসুখ নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করেননি কবি। লিখে গেছেন। কিছুদিন আগে বাংলা একাডেমিতে জাতীয় অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলামের জন্মদিন উদ্যাপন করা হয়েছে। তখন লন্ডনে থেকেই চমৎকার একটি লেখা তৈরি করে পাঠান সৈয়দ শামসুল হক। তার আগে গুলশানে হলি আর্টিজানে জঙ্গীদের চালানো নৃশংসতার বিরুদ্ধে কবিতা লিখে প্রতিবাদ করেছেন তিনি। গত ঈদে বিভিন্ন ঈদ সংখ্যায়ও যথারীতি লিখেছেন। শুধু তাই নয়, দেশের কথা দেশের মানুষের কথা তার ভাবনাজুড়ে আছে। হলি আর্টিজানে হামলার পর সাংস্কৃতিক কর্মীরা গান কবিতার দীর্ঘ মিছিল বের করেন। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে গুলশান পর্যন্ত মিছিলের সঙ্গে না থাকতে পারলেও কবি লন্ডনে বসেই খোঁজ নিয়েছেন। মানসিকভাবে মিছিলের সঙ্গে থাকার কথা আয়োজকদের জানিয়ে টেক্সট ম্যাসেজ পাঠিয়েছেন। বর্তমানে দেশের প্রিয় পরিবেশে কবির মনোবল আরও দৃঢ় বলে জানায় সূত্রটি। এদিকে ঢাকায় আসার পর থেকেই কবির খোঁজ নিচ্ছেন সুহৃদরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কবির সঙ্গে লন্ডনে দেখা করে এসেছিলেন। এখনও কবির সার্বক্ষণিক খোঁজখবর নিচ্ছেন বলে জানা যায়। সাধারণ ভক্তরাও খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করছেন। ব্যাকুল হয়ে এমনকি বাসভবনের সামনে চলে যাচ্ছেন। গণমাধ্যমের কর্মীরা নানাভাবে তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। কিন্তু পরিবারের পক্ষ থেকে কেউ কথা বলতে রাজি হচ্ছেন না। পারিবারিক সূত্র জানাচ্ছে, কবি বিশ্রামে আছেন। দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি দূর হতে আরও কয়েকদিন লাগতে পারে। এ অবস্থায় কারও সঙ্গে দেখা করা সম্ভব হবে না। এছাড়া চিকিৎসকদেরও এ ব্যাপারে কড়া নিষেধ রয়েছে। পুরো সময় প্রতিটি মুহূর্ত কবির প্রতি যতœবান থাকার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। কবিপতœী লেখিকা আনোয়ারা সৈয়দ হক সব বিষয় দেখাশোনা করছেন। কবির দেশে ফিরে আসার ঘটনাটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কেউ কেউ ভুল করেছেন। এ কারণে পরিবারের সদস্যদের মাঝে কিছুটা মন খারাপের ঘটনা ঘটেছে বলেও জানা যায়। এ প্রসঙ্গে কবিতা পরিষদের সভাপতি ড. মুহাম্মদ সামাদ জনকণ্ঠকে বলেন, সৈয়দ শামসুল হক দেশের অত্যন্ত শক্তিমান কবি। আমাদের ভীষণ ভালবাসার মানুষ। তার অসুস্থতার খবরে অনেকেই আবেগাক্রান্ত। তবে, সৈয়স শামসুল হক সব সময় সাহসী। নির্বিক। ফাইট করতে জানেন। তার নিজের মনোবল দেখে খুব উৎসাহ বোধ করছি। একই বিষয়ে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ জনকণ্ঠকে বলেন, কবির চিকিৎসা চলছে। কিছুদিন আগে তিনি লন্ডনে চিকিৎসা নিয়েছেন। এখন একই চিকিৎসা নিচ্ছেন ঢাকায়। জীবনের উৎসবে দিব্যি আছেন তিনি। এটা অনেক আনন্দের। এ অবস্থায় তাঁর সংগ্রামের সঙ্গে আমরা আছি। মৃত্যু যে কারও যখন তখন হতে পারে। ডাক্তারও তা নিশ্চিত করে বলতে পারেন না। সৈয়দ হককে যেমন চিনি, তিনি অসুস্থতার কথা ভেবে সময় নষ্ট করার মতো মানুষ নন। সৃষ্টির সম্ভার সমৃদ্ধ করতেই সময় দিচ্ছেন তিনি। কবি পরিবারের সূত্রে জানা যায়, তারাও আপাতত কবির চিকিৎসা ও লেখালেখির বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সকলেই কবির জন্য প্রার্থনা করবেন, এমনটি তাদের একমাত্র চাওয়া। সৈয়দ শামসুল হক চিকিৎসার জন্য গত এপ্রিলে যুক্তরাজ্যে যান। সেখানে চিকিৎসকরা তার ফুসফুসে ক্যান্সার শনাক্ত করেন। লন্ডনের রয়্যাল মার্সডেন হাসপাতালে চার মাস চিকিৎসা চলে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন লেখিকা-মনোচিকিৎসক আনোয়ারা সৈয়দ হক।
×