ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

চিকিৎসাসেবা আইনের খসড়া চূড়ান্ত

বেসরকারী হাসপাতাল ক্লিনিকে গলাকাটা ফি নিয়ন্ত্রণে আনা হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৬:১৯, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬

বেসরকারী হাসপাতাল ক্লিনিকে গলাকাটা ফি নিয়ন্ত্রণে আনা হচ্ছে

নিখিল মানখিন ॥ অবশেষে বেসরকারী চিকিৎসাসেবা আইন-২০১৬ এর খসড়া চূড়ান্ত হতে যাচ্ছে। খুব শীঘ্রই তা অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে উত্থাপন করা হবে। পরে আইনে পরিণত হওয়ার জন্য যাবে জাতীয় সংসদে। খসড়া আইনে সাধারণ মানুষের সহজ সেবাপ্রাপ্তির বিষয়সমূহ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আর বেসরকারী হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পরীক্ষা-নিরীক্ষার গলাকাটা ফি নিয়ন্ত্রণে আনা হচ্ছে। এ আইনে চিকিৎসকদের ইচ্ছামতো ভিজিট ফি আদায়ের লাগাম টেনে ধরা হচ্ছে। বেসরকারী চিকিৎসাসেবা আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে জনসাধারণের নিরাপদ ও মানসম্মত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতকরণ, স্বাস্থ্যসেবা দানকারী (চিকিৎসক, নার্স, চিকিৎসা সহায়তাকারী, মিডওয়াইফ) এবং গ্রহীতার (রোগী) সুরক্ষা প্রদানসহ স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোর যথাযথ পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে যুগোপযোগী আইন দরকার এবং সরকার সময়ে সময়ে প্রজ্ঞাপন দিয়ে বেসরকারী সেবা প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসকের আদায়যোগ্য ফি ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফি নির্ধারণ করবে এবং এসব ফি’র তালিকা দৃশ্যমান স্থানে টানাতে হবে। ফি আদায়ের রসিদ থাকা আবশ্যক। চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বার হবে দুই কক্ষের। একটিতে রোগী দেখা এবং অন্যটিতে বসা। মুক্তিযোদ্ধা ও দরিদ্র রোগীদের ১০ ভাগ শয্যায় বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকতে হবে। বিদেশী চিকিৎসকরা এখনকার মতোই সরকারের অনুমতি নিয়ে বিনামূল্যে অথবা বাণিজ্যিকভাবে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে সেবা দিতে পারবেন। একইভাবে অনুমতি সাপেক্ষে বিদেশী অর্থায়নে বেসরকারী চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান করা যাবে। সরকারের ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, লাইসেন্স প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ অথবা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির লিখিত অভিযোগ ছাড়া এই আইনের আওতায় পড়ে এমন অপরাধ বিচারের জন্য আদালত গ্রহণ করবে না। তবে দ-নীয় অপরাধগুলো আমলযোগ্য ও আপোসযোগ্য হবে। কোন চিকিৎসকের ইচ্ছাকৃত অবহেলার (অপরাধসম) ফলে রোগীর মৃত্যু হলে বাংলাদেশ দ-বিধির ৩০৪ ক ধারার (মৃত্যুদ- ছাড়া অন্য শাস্তি) বিধান অনুযায়ী দ-িত হবেন। চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ হলে এবং তা যদি নিবন্ধনকারী প্রতিষ্ঠান বিএমডিসির বিশেষজ্ঞ কমিটির তদন্তে প্রমাণিত হয় তাহলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক সর্বোচ্চ ২ বছরের কারাদ- বা সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা অর্থদ- অথবা উভয় দ-ে দ-িত হবেন। অনুমোদন ছাড়া বেসরকারী চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করলে ন্যূনতম ৫ লাখ টাকা অর্থদ- বা দুই বছর কারাদ- বা উভয় দ-ে দ-িত হবেন। আর স্বাস্থ্যসেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানের কোন সম্পত্তির ক্ষতি, বিনষ্ট, ধ্বংস বা নিজ দখলে নিলে সংশ্লিষ্ট অপরাধী তিন বছরের কারাদ- বা সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা অর্থ বা উভয় দ-ে দ-িত হবেন। সরকারী ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার সময়ে বেসরকারী হাসপাতালে সেবা দিলে ওই সেবাদানকারীর শাস্তি এক লাখ টাকা জরিমানা অথবা ৬ মাসের কারাদ- অথবা উভয় দ-ে দ-িত হবেন এবং আদালত উপযুক্ত মনে করলে বেসরকারী চিকিৎসাসেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানের সম্পূর্ণ বা আংশিক অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারবে। কোন চিকিৎসক অতিরিক্ত ফি আদায় করলে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা এবং পেশাগত নৈতিকতা লঙ্ঘন করলে অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায় নিবন্ধন সাময়িক অথবা স্থায়ীভাবে বাতিল হবে। প্রতিটি হাসপাতাল ও ব্যক্তিগত চেম্বারে সেবা প্রদান সংক্রান্ত রেজিস্টার রাখতে হবে। এতে রোগীর তথ্য সংরক্ষিত থাকবে। তা না করলে ৬ মাসের কারাদ- বা এক লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দ- হবে। সন্দেহজনক মৃত্যু, আত্মহত্যা, বিষ প্রয়োগ, বেআইনী গর্ভপাত, অগ্নিদগ্ধ, দুর্ঘটনাজনিত ও লাঞ্ছিত হওয়াসহ যে কোন ধরনের আঘাতজনিত ক্ষতি নিয়ে কোন রোগী আসার পর এসব ঘটনা চিকিৎসকের কাছে অপরাধ মনে হলে থানাকে লিখিতভাবে জানানো আবশ্যক। দেশের যে কোন স্থানে বেসরকারী চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান করা যাবে। তবে শর্ত হলো- এ আইন কার্যকর হওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে ইতোপূর্বে স্থাপিত সব বেসরকারী চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানকে উপধারা ২-এ বর্ণিত শর্ত ও পদ্ধতিতে লাইসেন্স নিতে হবে। তা না করলে কার্যক্রম বন্ধ। যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখালে ১০ দিন অতিরিক্ত সময় পাবে। সরকার সময়ে সময়ে গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে লাইসেন্স প্রদান ও নবায়ন ফি নির্ধারণ করবে। আইন লঙ্ঘন করলে প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল। তবে আত্মপক্ষ সমর্থনে সময় থাকবে ১৫ দিন। উপযুক্ত কারণ দেখাতে পারলে আরও ১৫ দিন বাড়ানো যাবে। এরপরও সংক্ষুব্ধ হলে আদেশ জারির ৩০ দিনের মধ্যে সরকারের কাছে আপীল করা যাবে। লাইসেন্স বাতিল হলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অন্য কোন হাসপাতালে জরুরীভিত্তিতে সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে। সরকার থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বেসরকারী চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে সেবা সংক্রান্ত কাগজ ও যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করতে পারবে। বেসরকারী চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানসমূহের বিরুদ্ধে অভিযোগ ॥ বেসরকারী হাসপাতালে দরিদ্র রোগীদের জন্য নির্ধারিত ফ্রি সিট সুবিধা বাস্তবায়ন করার তাগিদ দিয়েছে সরকার। দেশের অধিকাংশ বেসরকারী হাসপাতালে ফ্রি সিট সুবিধা নেই বলে অভিযোগ উঠার প্রেক্ষিতে এ তাগিদ দেয়া হয়। বেসরকারী হাসপাতাল-ক্লিনিকে মোট শয্যার ১০ শতাংশ শয্যা গরিবদের জন্য ফ্রি রাখার বিধি থাকলেও সেটি কেউ মানছে না। এতে বেসরকারী হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে পারেন না অনেক দরিদ্র রোগী। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, স্বাস্থ্য অধিদফতরের নীতিমালায় লাইসেন্স প্রাপ্তির শর্ত হিসেবে বলা আছে, হাসপাতাল-ক্লিনিকে ১০ শতাংশ বেড দরিদ্রদের ফ্রি দিতে হবে। লাইসেন্স গ্রহণের সময় এ অঙ্গীকার করেও পরে এই নির্দেশনা মানছে না অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান। ত্রুটি এখানেও আছে। গরিবদের ফ্রি বেড দেয়া হলেও তাদের অন্যান্য চিকিৎসা খরচ কে বহন করবে সে সম্পর্কে নীতিতে কিছু বলা হয়নি। বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে গরিবের ফ্রি বেড আছে এ তথ্যটি জানেন না অনেকেই। সূত্রটি আরও জানায়, দেশের শতকরা ৭০ ভাগ বেসরকারী হাসপাতাল ফ্রি সিট ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করে না। প্রথম শ্রেণীর বেসরকারী হাসপাতালগুলোর মধ্যে আধুনিক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রয়েছে ৫শ’টি রোগী শয্যা। কিন্তু এ হাসপাতালে দরিদ্র রোগীদের জন্য ফ্রি সিটের ব্যবস্থা নেই। এভাবে ৩০৪ বেডের ঢাকা এ্যাপোলো হাসপাতাল, ১৮০ বেডের ঢাকা ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল, ১২৫ বেডের চট্টগ্রাম চন্দ্রঘোনার খ্রিস্টিয়ান হাসপাতাল, ১শ’ বেডের ঢাকার সিকদার উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ দেশের অধিকাংশ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর হাসপাতালে দরিদ্র রোগীদের জন্য ফ্রি সিটের ব্যবস্থা নেই। বেসরকারী হাসপাতালের চিকিৎসা খরচ ॥ বেসরকারী হাসপাতালসমূহের চিকিৎসাসেবার খরচ অনেকটা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। প্রতিটি অপারেশনে ১০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা লাগে। প্রতিদিন সিসিইউ সেবা পেতে ৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা এবং আইসিইউ সেবা পেতে লাগে ২০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা। প্রতি সেশনে ডায়ালাইসিস করাতে খরচ হয় প্রায় ৫ হাজার টাকা। এভাবে করোনারী এনজিওগ্রামে ১৫ হাজার টাকা, সিটি স্ক্যানে ৪ থেকে ৬ হাজার টাকা, এমআরআই ৬ থেকে ১০ হাজার টাকা, ইসিজি ৩০০ টাকা, ইকোকার্ডিওগ্রাম ১ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা, এক্সরে ৫০০ টাকা, আল্ট্রাসনোগ্রাম ১ থেকে ৩ হাজার টাকা, কার্ডিয়াক ক্যাথ ১৫ হাজার টাকা, ইউরিন ২০০ টাকা এবং রক্তের হিমোগ্লোবিন, টোটাল কাউন্ট করাতে লাগে ৪৫০ টাকা।
×