ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মীর কাশেম ১৪ হাজার কোটি টাকার মালিক

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬

মীর কাশেম ১৪ হাজার কোটি টাকার মালিক

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ মহান মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামে একদিকে ছিলেন ফকা চৌধুরীর পুত্র সাকা চৌধুরী আরেকদিকে ছিলেন বদর বাহিনীর প্রধান মীর কাশেম আলী। তার ও তাদের সহযোগীর সকল ষড়যন্ত্র নস্যাত হয়ে গেল। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে সাকা চৌধুরী ফাঁসির দড়িতে ঝুলেছে আগে। শনিবার রাতে মীর কাশেম আলীকে অনুরূপ ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হলো। এদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে স্বাধীনতাকামী ও মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর বর্বর নির্যাতন চালিয়ে হত্যার মাধ্যমে সাকার মতো মীর কাশেম আলীও পরিণত হয়েছিলেন দুর্দমনীয় এক হিংস্র দানবে। সাকার বর্বরতা চলেছে তার নিজ বাড়ি রাউজান ও চট্টগ্রাম শহর এলাকায়। আর মীর কাশেম আলী স্বাধীনতাকামীদের নির্যাতনের জন্য শহরের একাংশ জুড়ে চালিয়েছিলেন অনুরূপ নৃসংশতা। সাকার ডাকনাম ছিল খোকন। আর মীর কাশেম আলীর ডাকনাম ছিল মিন্টু। মানিকগঞ্জের সাধারণ পরিবার থেকে আসা এই মীর কাশেম আলী চট্টগ্রামে পড়ালেখার সুবাদে জড়িয়ে পড়েছিলেন স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের সঙ্গে। তার পিতা চট্টগ্রামে তৎকালীন টিএ্যান্ডটির চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী ছিলেন। কলেজ জীবনে তিনি ইসলামী ছাত্রসংঘের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায় নেমে পড়েন। নেতৃত্ব দেন ইসলামী ছাত্রসংঘের কিলিং মিশনের থিঙ্কট্যাঙ্ক হিসেবে। যার জন্য তিনি গড়ে তুলেছিলেন বেশ ক’টি টর্চার সেল। যার মধ্যে সবচেয়ে বড়টি ছিল চট্টগ্রামের ওল্ড টেলিগ্রাফ রোডের মহামায়া নামের ভবনটি। স্বাধীনতাকামীদের ধরে এনে নির্যাতনে নির্যাতনে হত্যা করা হতো। ফলে এ ভবনটি ‘ডেথ ফ্যাক্টরি’ হিসেবে পরিচিতি পায়। এখানে তার ও তার সহযোগীর নেতৃত্বে স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে। নির্যাতনে প্রাণ হারিয়েছে বেশ কয়েকজন। চিরতরে পঙ্গু হয়েছে বহু। এই মহামায়া ভবন যা পরবর্তীতে ডালিম ভবন হিসেবে পরিচিতি পায়। এর প্রতিটি ইট-পাথরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অসহায় মানুষের কান্না। রক্তের স্রোতে ভেসে গেছে এ ভবনের প্রতিটি ফ্লোর। এসব অপকর্মের প্রধান হোতা তথা প্রধান জল্লাদ ছিলেন এই মীর কাশেম আলী। পাপ যেহেতু বাপকেও ছাড়ে না বলে প্রবাদ রয়েছে তারই সঠিক প্রতিফলন ঘটেছে মীর কাশেম আলীর ক্ষেত্রে। সেই পাপের বোঝা নিয়ে ঐতিহাসিক বিচারের রায় নিয়ে শনিবার তাকে ঝুলতে হয়েছে ফাঁসির দড়িতে। তার ও চ্যালাচামু-াদের দ্বারা নির্যাতিত এবং স্বজন হারানোর বেদনায় এতদিন যারা গুমরে গুমরে কেঁদেছেন এখন তারা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন; এই জল্লাদের ফাঁসিতে উল্লসিত হয়েছেন। প্রসঙ্গত, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার পর জামায়াতের অর্থ যোগানদাতা ও নির্বাহী পরিষদের সদস্য ধনকুবের মীর কাশেম আলীর সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদ- হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এ রায় সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ বহাল রেখেছে। সর্বশেষ মীর কাশেম আলীর রিভিউ পিটিশনও খারিজ হয়ে গেছে। রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার সর্বশেষ প্রক্রিয়ায় তিনি সায় না দেয়ায় সব প্রক্রিয়া শেষে শনিবার রাতে তার মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়েছে। এর আগে তিনি তার নিখোঁজ ছেলেকে না পাওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার বিষয়ে কোন কথা বলার সিদ্ধান্ত দিয়ে সময়ক্ষেপণের কৌশল নিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা টেকেনি। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে শহীদ জসিমকে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যার পর কর্ণফুলী নদীতে ফেলে গুম করার দায়ে মৃত্যুদ- বহাল রাখা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাঙালী খান নামে পরিচিতি পাওয়া এই জল্লাদ মীর কাশেম আলী স্বাধীনতার পর বিদেশে পালিয়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে দেশে ফিরে এসে তিনি এনজিও প্রতিষ্ঠা করে ইসলামী বিভিন্ন দেশের অনুদানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে একপর্যায়ে টাকার কুমির হয়ে যান। মীর কাশেম আলীর বিত্তভৈবব ও সম্পদ নিয়ে এ পর্যন্ত প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যে তিনি সর্বোচ্চ সম্পদের মালিক। যার পরিমাণ সরকারী খাতায় হাজার কোটি টাকারও বেশি। তবে বেসরকারীভাবে প্রচার আছে তার অর্থের পরিমাণ প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। বিদেশী ব্যাংকেও রয়েছে তার কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ ও সম্পদ। এসব অর্থের অধিকাংশ আর্থিক ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে রয়েছে। তার নিজ নামে সম্পদ প্রদর্শন করা হয়েছে তুলনামূলক কম। তবে অপ্রদর্শিত অর্থের পরিমাণ আরও হাজার কোটি টাকা বলে বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে, যা নানা নামে রাখা হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের যোগানেও রয়েছে এ অর্থ। তবে বেশিরভাগ সম্পদই বিভিন্ন কোম্পানির ট্রাস্ট ও প্রাইভেট সংস্থার নামে। ঢাকা কর অঞ্চল-৫ এর সার্কেল ৫০ এর করদাতা এই মীর কাশেম আলী। যার ইটিআইএন নম্বর ০৭৬-১০৩-৯৬৬৩। পৈত্রিকসূত্রে তিনি ঢাকার মিরপুরের দক্ষিণ মনিপুরের ২৮৭ নম্বর প্লটের বহুতল ভবনের মালিক। তার ব্যক্তিগত নামে ঢাকার মোহাম্মদপুরে একতা সোসাইটির ৫ কাঠা জমি ও মানিকগঞ্জের হরিরামপুরে সাড়ে ১২শতক জমি রয়েছে। এছাড়া ধানম-ির বহুতল ভবন কেয়ারি প্লাজার অবিক্রীত প্রায় ২শ’ বর্গমিটারের মালিকানাও তার। অবশিষ্ট অংশ তিনি বিক্রি করে দিয়েছেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তার শেয়ারের পরিমাণ প্রায় ২৮ হাজার। স্ত্রীর নামে রয়েছে ১শ’ এবং দুই ছেলে, তিন মেয়ের নামে রয়েছে ৫শ’ শেয়ার। এছাড়া ইসলামী ব্যাংকের ২ হাজার ১১৩ শেয়ার, কেয়ারি লিমিটেডের ১৪ হাজার শেয়ার, কেয়ারি টেলিকমের ১০ হাজার, কেয়ারি টুলস এ্যান্ড সার্ভিসেসের ১হাজার শেয়ার তার নিজের নামে। চট্টগ্রামে কেয়ারি ইলিশিয়াম নামের বহুতল বিশিষ্ট কমার্শিয়াল ও আবাসিক ভবনের মালিকানাও তার। টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপে পর্যটকদের চলাচলের জন্য কেয়ারি সিন্দবাদ নামের বেশ কয়েকটি প্রমোদ তরির মালিকও তিনি। আয়কর বিভাগের তথ্য অনুযায়ী কেয়ারি ঝর্ণা লিমিটেডের ২০, কেয়ারি তাজ লিমিটেডের ৫, কেয়ারি সান লিমিটেডের ৫, কেয়ারি স্প্রিং লিমিটেডের ২০, সেভেন স্কাই লিমিটেডের ১শ’, মীর আলী লিমিটেডের ২৫ এবং দিগন্ত মাল্টি মিডিয়া লিমিটেডের ১শ’ শেয়ার রয়েছে এই মীর কাশেম আলীর নামে। মীর কাশেম আলী কেয়ারি লিমিটেডের চেয়ারম্যান, ইবনে সিনা ট্রাস্টের সদস্য, ইবনে সিনা হাসপাতালের পরিচালক, ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক, এ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিয়াল লিমিটেডের সদস্য এবং ফুয়াদ আল খতিব চ্যারিটি ফাউন্ডেশনের সদস্য। বিভিন্ন ইসলামিক দেশের আর্থিক অনুদানে তিনি দেশে বিভিন্ন এনজিও প্রতিষ্ঠানের নামে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশন, রাবেতা আল আলম আল ইসলামী, ইবনে সিনা ট্রাস্ট, এ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রাস্ট, ফুয়াদ আল খতিব চ্যারিটি ফাউন্ডেশন এবং এ্যাসোসিয়েশন অব মাল্টি পারপাস ওয়েলফেয়ার এ্যাসোসিয়েশন থেকে তিনি নিয়মিত ভাতা নিতেন। এছাড়াও তিনি ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট এ্যান্ড বিজনেসম্যান চ্যারিটি ফাউন্ডেশন, আল্লামা ইকবাল সংসদ, আন্তর্জাতিক ইসলামিক ইউনির্ভাসিটি চট্টগ্রাম, দারুল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি, সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজি এ্যান্ড ফিশ, বাইতুশ শরফ বাংলাদেশ, ইসলামিক ট্রাস্ট ও ইসলামিক ইকোনমিক রিসার্চ সেন্টারের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য। এছাড়া তার মালিকানায় বিভিন্ন সংস্থার নামে প্রায় ২শ’ কোটি টাকার ঋণ আছে বলেও প্রদর্শিত আছে তার ট্যাক্স ফাইলে। মূলত কর ফাঁকি দিতেই এসব ঋণ নেয়া হয়েছে এবং তা প্রদর্শিত করা হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞ সূত্রে জানানো হয়েছে। প্রসঙ্গত, ১৯৭১ সালে মীর কাশেম আলী ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক। মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামে তিনি তার আলবদর বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে গঠন করেন ডেথ স্কোয়াড। মহামায়া ভবনকে বানিয়েছিলেন নির্যাতন কেন্দ্র। সেখানেই মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামীদের তার চ্যালাচামু-ারা ধরে এনে নির্যাতন চালাত। নির্যাতনে অনেকের প্রাণপ্রদীপ নিভে যেত। এর আগে ১৯৭০ সালে তিনি চট্টগ্রাম সরকারী কলেজ শাখার ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন। একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকে ৬ নবেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম শহর শাখা ছাত্রসংঘের সভাপতির পদেও আসীন ছিলেন। তার পৈত্রিক বাড়ি মানিকগঞ্জ হলেও ছাত্র জীবন কেটেছে চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামে তাকে মিন্টু নামেই চিনত তার সংগঠনের সদস্য, কলেজ জীবনের সাথী ও শুভাকাক্সক্ষীরা। তার নেতৃত্বে চট্টগ্রামে ৫টি নির্যাতন কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছিল। তন্মধ্যে প্রধান ছিল মহামায়া ভবন (ডালিম হোটেল)। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ইসলামী ছাত্রসংঘের নাম বদলে হয়ে যায় ইসলামী ছাত্রশিবির। এই ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হয়েছিলেন মীর কাশেম আলী। রাবেতা আল আলম আল ইসলামী নামে বিদেশী এনজিও সংস্থার এদেশী পরিচালক হন মীর কাশেম আলী। এরপর যোগ দেন জামায়াতে ইসলামে। ১৯৮৫ সালের জামায়াতের শূরা সদস্য হিসেবে আসীন হন। দেশে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার শুরু হলে ২০১২ সালের ১৭ জুন মীর কাশেম আলী গ্রেফতার হন। ২০১৪ সালের ২ নবেম্বর ট্রাইব্যুনালে তাকে ফাঁসির দ- দেয়া হয়। গত ৩০ নবেম্বর ফাঁসির দ- থেকে খালাস চেয়ে তার পক্ষ থেকে আপীল করা হয়। গত ৮ মার্চ আপীলের রায়ে ফাঁসির দ- বহাল রাখা হয়। গত ১৯ জুন তিনি রিভিউ আবেদন করেন। গত ৩০ আগস্ট প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপীল বিভাগ তার রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেয়। এরপর প্রাণভিক্ষা চাওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে নানা টালবাহানা চালিয়ে গত শুক্রবার রাষ্ট্রপতির প্রাণভিক্ষা চাইবেন না বলে জেল কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেন। এতেই তার মৃত্যুদ- কার্যকরে পূর্ববর্তী সকল প্রক্রিয়া অবসান হয়ে শনিবার রাতে তাকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়। এ জল্লাদকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- কার্যকর করায় মহামায়া ভবনসহ তার প্রতিষ্ঠিত টর্চার সেলগুলোতে নির্যাতিত ও প্রাণ হারানোর স্বজনরা তার সকল সম্পদ ও অর্থ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করে তা মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের কল্যাণে ব্যয় করার দাবি জানিয়েছেন।
×