ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

কে এই মীর কাশেম

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬

কে এই মীর কাশেম

স্টাফ রিপোর্টার ॥ কে এই মীর কাশেম আলী। একাত্তরের ইসলামী ছাত্রসংঘের চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত জামায়াতের খাজাঞ্চী। মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৭ সালের ইসলামী ছাত্রসংঘের পরিবর্তে ইসলামী ছাত্রশিবির নামে রাজনীতি শুরু করে। তখন মীর কাশেম আলী ছিলেন ঐ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। এর পর তাকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। অতঃপর মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তাকে মৃত্যুদ- প্রদান করা হয়েছে। যেভাবে বদর কমান্ডের উত্থান হয়েছিল, তেমনি তার পতনও হয়েছে। একাত্তরে মীর কাশেমের নির্দেশেই চট্টগ্রাম টেলিগ্রাফ অফিসসংলগ্ন এলাকায় হিন্দু মালিকানাধীন মহামায়া ভবন দখল করে নাম দেয়া হয় ডালিম হোটেল। সেখানে গড়ে তোলা হয় বদর বাহিনী চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঘাঁটি ও বন্দীশিবির-নির্যাতন কেন্দ্র (টর্চার সেল)। নির্যাতনের ভয়াবহতার দিক থেকে ডালিম হোটেল অন্যগুলোকে হার মানায়। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বানচাল করতে মীর কাশেম আলী ২৫ মিলিয়ন ডলার খরচ করে লবিষ্ট নিয়োগ করেন। একাত্তরের পর এই মানবতাবিরোধী অপরাধী প্রচুর বিত্ত বৈভবের মালিক হন। আন্তর্জাতিক আপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন সূত্রে মীর কাশেম আলী ও তার পরিবারের সদস্য সম্পর্কে জানা গেছে। মীর কাশেম আলী, পিতা- মৃত মীর তায়েব আলী, মাতা- মৃত রাবেয়া বেগম, (সৎ মাতা- মৃত ডলি বেগম) সাং- মুন্সীডাঙ্গী সুতালরি, থানা- হরিরামপুর, জেলা- মানিকগঞ্জ, বর্তমান ঠিকানা- বাসা নং-২৮৭ মোল্লাপাড়া, দক্ষিণ মনিপুর, ওয়ার্ড নম্বর-১৩, মিরপুর-২, ডিএমপি, ঢাকা (শূরা সদস্য জামায়াতে ইসলামী কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ)। জন্ম তারিখ ৩১-১২-১৯৫২। বয়স-৬৩ বৎসর। আসামি মীর কাশেম আলী প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত বরিশালে অবস্থিত আদর্শ বিদ্যালয়ে ১৯৫৮-১৯৬২ সাল পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। ১৯৬৩-১৯৬৫ সাল পর্যন্ত ফরিদপুর জেলা স্কুলে লেখাপড়া করে ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে লেখাপড়া করে ১৯৬৭ সালে এসএসসি পাস করেন। ১৯৬৭-১৯৬৮ শিক্ষাবর্ষে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে লেখাপড়া করে ১৯৬৯ সালে এইচএসসি পাস করেন। অতঃপর তিনি চট্টগ্রাম কলেজে ১৯৬৯-১৯৭০ শিক্ষাবর্ষে বিএসসি অনার্স প্রথম বর্ষে পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে ভর্তি হয়ে অধ্যয়নরত ছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে তিনি চট্টগ্রাম কলেজের পদার্থ বিজ্ঞানে অনার্স প্রথম বর্ষের লেখাপড়া স্থগিত করেন। অতঃপর ১৯৭১-১৯৭২ শিক্ষাবর্ষের বিএ পাস কোর্সে সাবেক আদর্শ কলেজ বর্তমানে আইডিয়াল কলেজ, ৬৫, সেন্ট্রাল রোড ধানম-ি, ঢাকা থেকে অধ্যয়ন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৯৭৩ সালের বিএ (পাশ) পরীক্ষা (১৯৭৪ সালে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত হয়)। উক্ত পরীক্ষায় তৃতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালের এমএ প্রিলিমিনারি পরীক্ষা মে-জুন ১৯৭৬ সালে অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত পরীক্ষায় তৃতীয় বিভাগে এবং ১৯৭৫ সালে এমএ ফাইনাল পরীক্ষা (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর/১৯৭৭ সালে অনুষ্ঠিত হয়)। উক্ত পরীক্ষায় অর্থনীতিতে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। আসামি বিবাহিত, তার স্ত্রী নাম খন্দকার আয়েশা খাতুন, তিনি একজন গৃহিণী। তার দুই ছেলে তিন মেয়ে। বড় ছেলে মীর মোহাম্মদ বিন কাশেম (সালমান), ১৯৭৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বর্তমানে ইবনে সিনা হাসপাতাল, ঢাকায় ডেন্টাল ইউনিটে ডেন্টিস্ট হিসেবে চাকরি করেন। দ্বিতীয় ছেলে মীর মোহাম্মদ বিন কাশেম প্রকাশ আরমান, ১৯৮৪ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লিংকন ইউনিভার্সিটি থেকে ব্যারিস্টারি ডিগ্রী লাভ করেন। বর্তমানে তিনি ঢাকায় আইন পেশায় নিয়োজিত আছেন। আসামির তিন কন্যার মধ্যে বড় কন্যা তায়েবা ১৯৮১ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হোম ইউকোনোমিক্স কলেজ, ঢাকা থেকে এমএ ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি বিবাহিতা। স্বামীর নাম সাইফুল ইসলাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক। বর্তমানে পিএইচডি করার জন্য সুইডেনে আছেন। দ্বিতীয় মেয়ে সুমাইয়া রাবেয়া ১৯৮৬ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন বিষয়ে লেখাপড়া করার জন্য মালয়েশিয়াতে আছেন। তার স্বামী সালেম মালয়েশিয়াতে বিবিএ অধ্যায়নরত। তৃতীয় মেয়ে তাহেরা তাসনিম ১৯৮৮ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে লন্ডন ক্যাম্পাসে আইন বিষয়ে অধ্যায়নরত। তিনি অবিবাহিতা। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে অধ্যায়নরত থাকাবস্থায় ১৯৬৭ সালে ইসলামী ছাত্রসংঘের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন। চট্টগ্রাম সরকারী কলেজে অধ্যায়নরত থাকাকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘের কলেজ শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম শহর শাখার ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি নিযুক্ত হন। ৬ নবেম্বর ১৯৭১ তারিখে ১৯৭১-১৯৭২ সেশনের ইসলামী ছাত্রসংঘের প্রাদেশিক কার্যকরী পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। অতঃপর পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত হন। (তথ্যসূত্র ঃ দৈনিক আজাদী ১ আগস্ট ১৯৭১, দৈনিক আজাদী ২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১, দৈনিক সংগ্রাম ৭ নবেম্বর ১৯৭১, দৈনিক সংগ্রাম ১৪ নবেম্বর ১৯৭১, দৈনিক সংগ্রাম ২৪ নবেম্বর ১৯৭১, দৈনিক পাকিস্তান ৮ নবেম্বর ১৯৭১)। ১৯৭৭ সালে ইসলামী ছাত্রসংঘের পরিবর্তিত সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতি পদে নিযুক্ত হন। আসামি মীর কাশেম আলী ১৯৮০ সালে ঢাকায় রাবেতা আল আলম, আল ইসলামী এনজিওর কোঅর্ডিনেটর হিসেবে থাকাকালীন জামায়াতে ইসলামীর কর্মী হিসেবে যোগদান করে সদস্য পদ গ্রহণ করেন (আসামির নিজস্ব বক্তব্য)। তিনি ১৯৮০ সালের পরে জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদের সদস্য নিযুক্ত হন (আসামির নিজস্ব বক্তব্য) এবং তিনি ১৯৮৫ সাল থেকে জামায়াতে ইসলামীর শূরা সদস্য হিসেবে নিয়োজিত আছেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে দখলদার পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং এদেশীয় তাদের দোসর জামায়াতে ইসলাম, নেজামে ইসলাম পার্টি, পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কনভেনশন ও কাউন্সিল) পিডিপিসহ কতিপয় রাজনৈতিক দলের নেতা, শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামসসহ তাদের অনুসারীরা পারস্পরিক যোগসাজশ ও চক্রান্তে রাজনৈতিক, সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় বিদ্বেষ প্রসূত কারণে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ, নারী নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট অপহরণ, আটক, নির্যাতন, গুম, উচ্ছেদ, বিতাড়ন ইত্যাদি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস এ্যাক্ট ১৯৭৩ এর ৩(২) ধারায় উল্লিখিত অপরাধসমূহ চট্টগ্রামসহ সারাদেশে ব্যাপকভাবে সংঘটিত করেন। উক্ত সংঘটিত অপরাধসমূহের মূলধারার সহিত সম্পৃক্ত হয়ে অভিযুক্ত আসামি মীর কাশেম আলী নিজেও সরাসরি অপরাধ সংঘটনে জড়িত ছিলেন। মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার কারণে ট্রাইব্যুনাল তাকে মৃত্যুদ- প্রদান করেন। সর্বশেষ সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগও চূড়ান্ত আইনী লড়াইয়ে মৃত্যুদ- বহাল রাখেন।
×