ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কবে ওই টাকা দেশে আসবে বলতে পারেন না কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোন কর্মকর্তা

সাত মাসেও রিজার্ভ চুরির তদন্ত রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬

সাত মাসেও রিজার্ভ চুরির তদন্ত রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি

রহিম শেখ ॥ বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির সাত মাস পার হলেও আলোর মুখ দেখেনি তদন্ত প্রতিবেদন। একাধিকবার এ প্রতিবেদন প্রকাশের কথা বলা হলেও তা থেকে সরে আসেন খোদ অর্থমন্ত্রী। গত মাসে তিনি জানান, চলতি মাসের মধ্যেই এ প্রতিবেদন প্রকাশ করবেন। প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংকের বেশ কয়েক কর্মকর্তার নাম এলেও তাদের বিরুদ্ধে এখনও ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ঢিমেতালে চলছে দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সিআইডি, পুলিশ, এফবিআইয়ের তদন্ত। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে চুরি যাওয়া ৮ কোটি ১০ লাখ ডলারের মধ্যে উদ্ধার হওয়া দেড় কোটি ডলার নিয়ে প্রাথমিক তদন্ত শেষ করেছে ফিলিপিন্সের ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস। ঘটনার প্রথম চার মাস শুনানি হলেও শেষ তিন মাস কোন শুনানি করেনি দেশটির সিনেট। অন্যদিকে রিজার্ভের চুরি যাওয়া অর্থ ফেরত আনতে গত ২৬ আগস্ট ফিলিপিন্সের আদালতে অভিযোগ দায়ের করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রিজার্ভ থেকে চুরি হয়ে যাওয়া টাকার মধ্যে প্রায় ১২২ কোটি টাকা দ্রুত দেশে আনা সম্ভব বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ঠিক কবে এই নাগাদ অর্থ দেশে আসবে, তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোন কর্মকর্তা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সিস্টেম হ্যাক করে গত ৪ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে গচ্ছিত বাংলাদেশ ব্যাংকের এ্যাকাউন্ট থেকে হ্যাকাররা ৯৫১ মিলিয়ন ডলার চুরির চেষ্টা করে। পরে বেশকিছু পেমেন্ট বন্ধ করে দিয়ে বেশির ভাগ অর্থচুরি ঠেকানো গেলেও ৮১ মিলিয়ন ডলার ফিলিপিন্সে স্থানান্তরে সক্ষম হয় হ্যাকাররা। ওই অর্থ ফিলিপিন্সের আরসিবিসি ব্যাংকের জুপিটার ব্রাঞ্চের চারটি এ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়। ঘটনাটি তদন্তে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করছে মার্কিন গোয়েন্দা এফবিআই। যুক্তরাষ্ট্রের তদন্তকারীরা মনে করছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সিস্টেম হ্যাক অভ্যন্তরীণভাবেই হয়েছে। সম্প্রতি এফবিআই জানিয়েছে, দায়ীদের এখনও শনাক্ত করা যায়নি। তবে দ্রুত শনাক্তের চেষ্টা চলছে। নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম থেকে চুরি হওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের যেসব কর্মকর্তাকে দায়ী করেছে ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিটি, তাদের বিরুদ্ধে এখনও কোন ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। যদিও দায়ীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি বিধিতে মামলা করার সুপারিশ করেছিল অর্থ মন্ত্রণালয়। এদিকে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় একটি মামলা করা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে। মামলাটি তদন্ত করছে সিআইডি। সেটিও চলছে ঢিমেতালে। এ প্রসঙ্গে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মির্জা আবদুল্লাহিল বাকী জনকণ্ঠকে বলেন, রিজার্ভে চুরির সঙ্গে ৩০ বিদেশী নাগরিককে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের অনেকেই ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন। সিআইডি প্রযুক্তিগত তদন্ত, এফবিআই ও ইন্টারপোলের সহযোগিতায় তাদের প্রকৃত নাম-ঠিকানা উদ্ধার করেছে। একই সঙ্গে তাদের প্রত্যেকের আলাদা প্রোফাইল তৈরি করা হয়েছে। এদের গ্রেফতারের বিষয়ে আন্তর্জাতিক পুলিশী সংস্থা ইন্টারপোলের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। সূত্রে আরও জানা গেছে, রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরির ঘটনা তদন্তে সাবেক গবর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনকে প্রধান করে গত ১৫ মার্চ তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি গত ৩০ মে সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রীর কাছে প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ওই সময়ই জানান, বাজেটের কারণে তিনি ব্যস্ত। বাজেটের পর প্রতিবেদন দেয়া হবে। গত ২১ জুলাই অর্থমন্ত্রী সংসদে বলেন, কয়েক দিনের মধ্যে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। গত ৩০ মে ওই প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর তা পড়ে দেখে প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী মুহিত। সে সময় তিনি জানিয়েছিলেন, বাজেট প্রস্তাব পেশের ১৫ থেকে ২০ দিন পর প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হবে। কিন্তু দীর্ঘসময় পরও ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পারেনি অর্থমন্ত্রী। সবশেষ আগস্টে তিনি জানিয়েছেন, আগামী ২৪ সেপ্টেম্বরের আগেই রিজার্ভ চুরির পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রকাশ করবেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র বলছে, রিজার্ভের চুরি যাওয়া অর্থ ফেরত পেতে কৌশল পরিবর্তন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ কৌশলের অংশ হিসেবে ড. ফরাসউদ্দিন কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনও প্রকাশ করা হচ্ছে না। শুধু তাই নয়, রিজার্ভের অর্থ চুরির সঙ্গে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক ও সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশনকে (সুইফট) দায়ী করা থেকেও সরে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এ মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে চুরি যাওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে। এরই অংশ হিসেবে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক ও সুইফটের সহযোগিতা নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ওই দুই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়ার যে প্রস্তুতি নিয়েছিল, তা থেকে সরে এসেছে। রিজার্ভের চুরি হওয়া অর্থ উদ্ধারে শুধু এই দুই প্রতিষ্ঠানই নয়, সবপক্ষের সহযোগিতা নিশ্চিত করতে গত মাসে যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। ওই সফরে প্রতিনিধি দলটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্ক (ফেড), সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন (সুইফট), ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম এনফোর্সমেন্ট নেটওয়ার্ক (ফিনসেন), যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস, দ্য ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) সঙ্গে বৈঠক করেন। টাকা ফেরত পেতে ফিলিপিন্সের আদালতে অভিযোগ ॥ অবশেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের চুরি যাওয়া অর্থ ফেরত আনতে ফিলিপিন্সের আদালতে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। গত ২৬ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে দেশটির আদালতে অভিযোগ দায়ের করেছে ফিলিপিন্স ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস। আগামী সপ্তাহে এ বিষয়ে শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগের মহাব্যবস্থাপক দেবপ্রসাদ দেবনাথ জনকণ্ঠকে বলেন, চুরি হওয়া যে টাকা ওই দেশের আদালত জব্দ করেছে, সেই টাকা ফেরত আনতে ফিলিপিন্সের স্থানীয় আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক এফিডেভিটের মাধ্যমে সেখানকার আদালতে আবেদন করেছে। তিনি বলেন, দেশটির ক্যাসিনো ব্যবসায়ী কিম অং যে দেড় কোটি ডলার দেশটির মুদ্রাপাচার প্রতিরোধ কাউন্সিলে জমা দিয়েছেন, সেই টাকা যে আমাদেরÑ এটা প্রমাণিত হলেই ওই দেড় কোটি ডলার আমরা পেয়ে যাব। দেবপ্রসাদ দেবনাথ আরও বলেন, ফিলিপিন্সের ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস সেখানকার আদালতে আমাদের পক্ষে গত ২৬ আগস্ট একটি আবেদন জমা দিয়েছে। শুনানি শেষ হলে টাকা ফেরত পাওয়া যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। ১২২ কোটি টাকা দ্রুত ফেরত পাওয়ার আশা বাংলাদেশ ব্যাংকের ॥ রিজার্ভ থেকে চুরি হয়ে যাওয়া টাকার একটি অংশ দ্রুত দেশে ফেরত আনা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ টাকার পরিমাণ প্রায় ১২২ কোটি। সম্প্রতি জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত সরকারী প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে। বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, ফিলিপিন্সের ক্যাসিনো ব্যবসায়ী কিম অং চুরি করা টাকা থেকে ১৫ দশমিক ২৫ মিলিয়ন ডলার ফিলিপিন্সের এ্যান্টি-মানি লন্ডারিং কাউন্সিলের কাছে জমা দিয়েছে। বাংলাদেশকে এ টাকা ফেরত দেয়ার জন্য কাউন্সিল ও কিম অং আদালতে আবেদন করলে গত ১ জুলাই আদালত তা বাজেয়াফত করার আদেশ দেয়। পরে ফিলিপিন্সের স্থানীয় আইন অনুযায়ী সেই দেশের ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে টাকা ফেরত দেয়ার জন্য আবেদন করেছে। এখন আদালত আদেশ দিলেই বাংলাদেশ ১২২ কোটি টাকা ফেরত পাবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা বলেন, পৃথিবীর সবাই জানে চুরি যাওয়া এ টাকা আমাদের। তবু এ টাকা ফেরত পেতে মামলার কোন বিকল্প নেই। কবেনাগাদ টাকা পাওয়া যাবেÑ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আশা করছি দ্রুতই টাকা ফেরত পাব। এর বেশি কিছু আপাতত বলা সম্ভব নয়।
×