ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

গোপালগঞ্জে উন্নয়নে বাধা ॥ থমকে গেছে গ্রীন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের নির্মাণ কাজ

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬

গোপালগঞ্জে উন্নয়নে বাধা ॥ থমকে গেছে গ্রীন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের নির্মাণ কাজ

নীতিশ চন্দ্র বিশ্বাস, গোপালগঞ্জ ॥ গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের জলিরপাড়ে দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহৎ ব্যক্তি-মালিকানাধীন শ্রমঘন শিল্পপার্ক সাসকো গ্রীন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে এলাকার লাখো মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির দ্বার উন্মোচিত হবে। উন্নয়নের ক্ষেত্রে আরেক ধাপ এগিয়ে যাবে গোপালগঞ্জ এবং বিবেচিত হতে পারে দক্ষিণাঞ্চলের একটি ইকোনমিক জোন হিসেবে। কিন্তু এর প্রয়োজনীয়তা ও সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক সুফল বিবেচনায় না এনে একটি স্বার্থান্বেষী মহল এর বিরোধিতা করছে এবং ভূমিদস্যুতা, সংখ্যালঘু নির্যাতন, অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ইত্যাদি নানা অভিযোগ এনে এ উন্নয়নের কাজটিকে থমকে দিতে চাইছে। গোপালগঞ্জের উন্নয়নের ক্ষেত্রে বরাবরই উদ্যোক্তার অভাব রয়েছে। এ কারণে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের দৌড়ে গোপালগঞ্জ আগে থেকেই অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এর ওপর যদি আবার বাধা আসে তো সেক্ষেত্রে উন্নয়ন অবশ্যই পিছিয়ে পড়বে, যা গোপালগঞ্জবাসীর জন্য কখনই সুখকর নয়। পদ্মা সেতুর বাস্তবতা, দেশজুড়ে প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়নমুখী উদ্যোগের পাশাপাশি গোপালগঞ্জকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার বানিয়ারচর এলাকায় নিচু পতিত বা এক-ফসলী বিস্তর জমিতে সাসকো গ্রীন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক নির্মাণের উদ্যোগ নেন সাসকো গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও যুবলীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ আতিয়ার রহমান দীপু। এ কারণে তিনি ওই বছর থেকেই বানিয়ারচর এলাকায় সম্পূর্ণ বৈধ প্রক্রিয়ায় ন্যায্যমূল্যে সাফ-কবলা ক্রয়ের মাধ্যমে ধীরে ধীরে জমি ক্রয় শুরু করেন এবং সংশ্লিষ্ট সরকারী কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে আলোচিত স্থানে এই শিল্প পার্ক স্থাপনের কাজ শুরু করেন। শিল্পোন্নয়নের এই অগ্রযাত্রায় ওই এলাকার সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ও খ্রিশ্চিয়ান সম্প্রদায়ের মানুষও উৎফুল্লচিত্তে এগিয়ে আসেন। অনেকেই স্বপ্রণোদিত হয়ে তার কাছে জমি বিক্রি করেন। এভাবে গত তিন বছরে তিনি তার এ প্রকল্পের জন্য ন্যায্যমূল্য প্রদানের মাধ্যমে ৩৫ একর জমির ক্রয় দলিল সম্পন্ন করেন এবং সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব লিড প্লাটিনাম স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী তিনি তার এ প্রকল্পের কাজ শুরু করেন। তার এ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে এর মাধ্যমে বছরে অন্তত ৩ হাজার কোটি টাকা অর্জন সম্ভব হবে এবং এলাকার পিছিয়ে পড়া অন্তত ৮ হাজার বেকার দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। কিন্তু তার এ কাজে ঈর্ষান্বিত হয়ে একটি স্বার্থান্বেষী মহল সাধারণ মানুষের স্বার্থকে উপেক্ষা করে এ প্রকল্পের কাজটিকে বাধাগ্রস্ত করছে। এলাকার সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিল্প-পার্কটি যাতে প্রতিষ্ঠিত হতে না পারে সেজন্য প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী বিজিএমইর সাবেক পরিচালক ও আওয়ামী যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আতিয়ার রহমান দীপুকে ভূমিদস্যুতার অপবাদ দিয়ে এর কার্যক্রম বন্ধ করার ষড়যন্ত্র চলছে। মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে এলাকার মানুষকে উসকে দিয়ে এবং কৃত্রিম সাম্প্রদায়িকতার বাতাবরণ সৃষ্টির মাধ্যমে কুৎসা রটনাসহ নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। বানিয়ারচর এলাকার ড. জ্যাকব বৈদ্য ও সঞ্জিত বাকচী জানিয়েছেন, মুকসুদপুরের জলিরপাড় একটি হিন্দু ও খ্রিস্টান অধ্যুষিত এলাকা। এরাই এখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ ও নির্মাণরত প্রতিষ্ঠানের একমাত্র শ্রম বাজারের উৎস। এখানে ভূমি জবরদখল বা সংখ্যালঘু বিবেচনায় অত্যাচার করার এমন কোন ঘটনা এলাকায় ঘটেনি। এলাকার জনগণের সিংহভাগই চায় শিল্প-পার্কটির দ্রুত বাস্তবায়ন। যারা এর বিরোধিতা করছেন, তারা এলাকার একেবারেই চিহ্নিত এবং সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত স্বার্থেই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছেন। বানিয়ারচরের হারু মোহন্ত বলেন, একটি শুভ উদ্যোগকে বানচাল করার জন্য বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে, জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চলছে। ফলে শিল্প পার্কটি নির্মাণে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এতে এলাকার পিছিয়ে পড়া দরিদ্র জনগোষ্ঠী ক্রমেই হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। জানা যায়, ১০-১২ বছর আগে পার্শ্ববর্তী রাজৈর উপজেলার ঘোষালকান্দি এলাকা থেকে বজলু শেখ নামে এক ব্যক্তি ও তার নিকটাত্মীয় ৬-৭টি পরিবার জলিরপাড় এলাকায় আসেন এবং মাদারীপুর বিলরুট ক্যানেলের (এমবিআর) পাড়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সরকারী জায়গায় অবৈধভাবে বসতি স্থাপন শুরু করেন। সেই থেকে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে নানান অপকর্ম করে চলেছেন। এখানে শিল্পপার্কটি প্রতিষ্ঠিত হলে তারা উচ্ছেদ হয়ে যেতে পারেন এমন আশঙ্কায় শুরু থেকেই তারা এ উন্নয়ন প্রকল্পটির বিরোধিতা করে চলেছেন। বানিয়ারচর গ্রামের মাখন ম-ল জানান, ঢাকায় অবস্থানরত বানিয়ারচর গ্রামের এক ডলার ব্যবসায়ী এলাকায় নিজ কর্তৃত্ব খর্ব হওয়ার আশঙ্কায় শুরুতেই এ শিল্পপার্কের বিপক্ষে অবস্থান নেন। বস্তুত তিনিই একজন ভূমিদস্যু। দীর্ঘদিন ধরে তিনি বানিয়ারচর গ্রামের বোচা রাম রায়ের পুত্র পুলিন রায়ের কলিগ্রাম মৌজার এক একর জমি জোর করে দখল করে খাচ্ছেন। এছাড়া একই মৌজায় জলিরপাড় হাই স্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষক জগদীশ চন্দ্র মৃধার ছেলে জগবন্ধু মৃধা ও প্রিয়লাল মৃধার ৯ একর জমি জবরদখল করে খাচ্ছেন। এ মনোকষ্টে ওই প্রধান শিক্ষক দেশ ছেড়ে ভারতে চলে গেছেন। এছাড়াও ওই গ্রামের ভাষারাম ও ভবানী ম-লের ২ একর জমিও তিনি জোর করে ভোগ দখল করছেন। এখানেই তিনি ক্ষান্ত হননি, তিনি বানিয়ারচর সেভেন্থ-ডে এ্যাডভেন্টিস্ট মিশনের ১ একর জমি জবর দখল করে খাচ্ছিলেন, যা সম্প্রতি চাপের মুখে তিনি তা ওই মিশনকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। বানিয়ারচর গ্রামের আনন্দ মল্লিক জানান, জলিরপাড় ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান দীপক বাড়ৈ দুটি দলিলের মাধ্যমে সাসকো গ্রুপের কাছে ৮৬ শতাংশ জমি বিক্রি করেন। কিন্তু জমিটি রেজিস্ট্রি করার সময় দেখা যায় এর মধ্যে একটি জমির কাগজপত্র ভুয়া, যে জমির মালিকানা দাবি করেন ওই এলাকার কপিল হীরা গং। একারণে দীপক বাড়ৈ সাসকো গ্রুপের কাছ থেকে টাকা পান ৪৩ শতাংশ জমির। কিন্তু দীপক বাড়ৈ দাবি করেন ৮৬ শতাংশের টাকা। ফলে মালিকানাস্বত্ব মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত বাকি টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে দীপক বাড়ৈ তার লোকজন নিয়ে এ শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতা শুরু করেন। শিল্প-পার্কটির জন্য প্রথম জমিদাতা গোবিন্দ ম-ল জানান, ন্যায্যমূল্য পেয়েই তিনি ৫৮ শতাংশ জমি সাসকো গ্রুপের কাছে বিক্রি করেছেন। তিনি চান, এখানে এ শিল্প-প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠিত হোক এবং বেকারদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হোক। জলিরপাড় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধীর সাহা জানান, তিনি সাসকো গ্রুপের কাছে ২৮ শতাংশ জমি বিক্রি করেছেন। প্রয়োজন হলে তিনি আরও জমি বিনামূল্যে দান করবেন। এ পর্যন্ত ৩৪ জন জমির মালিক জমি দিয়েছেন এবং তারা ন্যায্যমূল্য পেয়েই জমি হস্তান্তর করেছেন। কারও কাছ থেকে জোর করে কোন জমি নেয়া হয়নি। যারা শিল্পায়নের বিরোধিতা করছেন, তারা নিছক ব্যক্তিগত স্বার্থেই করছেন। তিনি আরও বলেন, এসব আমরা মানব না। অনুন্নত এ এলাকায় শিল্প গড়ে তোলার স্বার্থে আমরা আন্দোলন করব। প্রয়োজন হলে রক্ত দেব, তারপরও এ শিল্প-পার্কের বাস্তবায়ন চাই।
×