ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

গোলাম কুদ্দুছ

আস্থার ঠিকানা শেখ হাসিনা

প্রকাশিত: ০৪:০০, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬

আস্থার ঠিকানা শেখ হাসিনা

‘বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা- বিপদে আমি না যেন করি ভয়’- রবি ঠাকুরের এ প্রার্থনার মূর্ত প্রতীক যেন শেখ হাসিনা। শুধু বাংলাদেশ নয়, সমকালীন বিশ্বের বিস্ময় শেখ হাসিনা। কারও কারও কাছে আমার এ কথাটি বাড়াবাড়ি মনে হলেও ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন থেকে বর্তমান পর্যন্ত যদি তার সাহস, সাংগঠনিক দক্ষতা, দেশপ্রেম, রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা এবং আদর্শের প্রতি অনমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি পর্যালোচনা করি তাহলে এ বক্তব্যের বাস্তবরূপ দৃশ্যমান হবে। নিজের জীবনকে বিপন্ন করেও যে দেশ এবং মানুুষের কল্যাণে সততার সঙ্গে কাজ করে যাওয়া যায় তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত শেখ হাসিনা। মনে রাখতে হবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করার সময় তাঁর দু’কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান। ঘাতকের বুলেট যখন দেশে-বিদেশে তাদের তাড়া করে ফিরছিল তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর আন্তরিকতায় সে দেশে তাদের রাজনৈতিক আশ্রয় মিলেছিল। ১৯৭৫ সালের ২৫ আগস্ট জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে এয়ার ইন্ডিয়ার জাম্বো জেটে দিল্লীর পালাম বিমানবন্দরে পৌঁছলেন বঙ্গবন্ধু পরিবারের জীবিত সদস্যরা। প্রথমে তাদের দিল্লীতে ডিফেন্স কলোনির একটি ফ্ল্যাটে এবং পরবর্তী সময়ে ‘ইন্ডিয়া গেট’ সংলগ্ন পান্ডারা রোডস্থ একটি বাড়ির দোতলা ফ্ল্যাটে স্থানান্তরিত করা হয়। ভারত সরকার শেখ হাসিনার স্বামী পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়াকে ভারতীয় আণবিক শক্তি কমিশনে ‘পোস্ট ডক্টরাল ফেলোশিপ’ প্রদান করে। ফেলোশিপের শর্তানুযায়ী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়াকে বাসা ও অফিস যাতায়াতের সুবিধা ছাড়াও দৈনিক বাষট্টি রুপি (ভারতীয়) পঞ্চাশ পয়সা ভাতা দেয়া হতো। দেশী-বিদেশী সংবাদ জানার জন্য তাদের সম্বল ছিল একটিমাত্র রেডিও। এভাবেই কেটেছে জাতির পিতার দুই কন্যার সাদামাটা শঙ্কিত জীবন। সকলেরই জানা আছে যে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী খুনীচক্র ১৯৭৫-এর ৩ নবেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নৃশংসভাবে খুন করে বঙ্গবন্ধুর চার ঘনিষ্ঠ সহযোগী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামানকে। সারাদেশে দমন-পীড়ন ও নির্যাতন নেমে আসে প্রধানত আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপর। হত্যা, গ্রেফতার, হামলা, মামলা প্রাত্যহিক জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আসীন জেনারেল জিয়াউর রহমানের সহযোগিতায় স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি পুনরায় বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ লাভ করে। এ সময় দালাল আইন বাতিল করে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের অভিযোগ এবং কারাগার থেকে মুক্ত করে দেয়া হয়। একে একে বিদেশে পালিয়ে থাকা যুদ্ধাপরাধী এবং স্বাধীনতাবিরোধীরা ফিরে আসে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তাক্ত বাংলাদেশে। রাজনীতি, অর্থনীতি এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে পুনর্বাসিত হয় এই স্বাধীনতাবিরোধী চক্র। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির ওপর নির্যাতন আর স্বাধীনতাবিরোধীদের লালন যেন ক্ষমতাসীনদের নীতিতে পরিণত হয়। এ সময় সংবিধানকে কেটে-ছিঁড়ে ক্ষতবিক্ষত করে পাকিস্তানী ভাবাদর্শে দেশ পরিচালনার নীতি গ্রহণ করা হয়। দেশের সেই ক্রান্তিকালে ১৯৮১ সালের ১৩-১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার হোটেল ইডেনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনের কাউন্সিল অধিবেশনে এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্তে বিদেশে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়, সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন আব্দুর রাজ্জাক। আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পর কন্যা পুতুলসহ ১৯৮১ সালের ১৭ মে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকায় বিমান থেকে অবতরণ করেন শেখ হাসিনা। সেদিন আকাশে ছিল মেঘ। প্রকৃতি যেন শোকের চাদর গায়ে মলিন বদনে শেখ হাসিনার জন্য অপেক্ষা করছিল। বিমান থেকে নামার পর শুরু হলো অঝোর ধারায় বৃষ্টি; যেন শেখ হাসিনার অশ্রু জল হয়ে ভরিয়ে দিল বাংলার প্রতিটি লোকালয়। লাখ লাখ বঙ্গবন্ধুপ্রেমীর উচ্চকিত সেøাগানের মাঝে তিনি খুঁজে ফেরেন স্বজনের মুখ। আবেগজড়িত কণ্ঠে চিৎকার করে বলেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চাই’। লাখো কণ্ঠে উচ্চারিত সেই সেøাগান আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে ছড়িয়ে পড়ল বাংলার প্রতিটি প্রান্তরে। সেই থেকে শেখ হাসিনার নতুন জীবনের যাত্রা হলো শুরু। এ পথ সঙ্কটের, ঝুঁকি আর মায়া-মমতায় জড়ানো লাখো মানুষের ভালবাসায় পরিপুষ্ট। শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করায় দলের নেতাকর্মী এবং সাধারণ মানুষের মাঝে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়। ইতোমধ্যে ৩০ মে ১৯৮১ প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে বিদ্রোহী সেনাদের হাতে নিহত হলে বিএনপি নেতা বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হয়। জাতির এ সঙ্কটকালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অন্যান্য রাজনৈতিক দল সংগঠিত হওয়ার তাগিদ অনুভব করে। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার, কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল, রাজবন্দীদের মুক্তি, জেল-জুলুম-নির্যাতন প্রতিরোধ, ঘুষ-দুর্নীতি ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাটের বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তোলার আহ্বান জানান শেখ হাসিনা। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র সংঘাত বন্ধ, গঙ্গা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়, সীমান্ত সমস্যার সমাধান ও ছিটমহল বিষয়ে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি বাস্তবায়নে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয় দাবি আদায়ের আন্দোলনে। বিচারপতি সাত্তার এবং পরবর্তী সময়ে জেনারেল এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী তুমুল আন্দোলন গড়ে ওঠে। ৮ দল, ৭ দল এবং ৫ দল যুগপৎভাবে আন্দোলন পরিচালনা করলেও এ আন্দোলনে ছাত্র, সংস্কৃতিকর্মী এবং পেশাজীবীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শেখ হাসিনাসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের গ্রেফতার করেও এরশাদ তার পতন ঠেকাতে পারেননি। তিন জোটের রূপরেখা মোতাবেক বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হন। এরপরের ইতিহাস সকলের জানা। ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ সালে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পরপর তিনটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। অবশ্য ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বিএনপি সরকার একটি ভোটারবিহীন নির্বাচন সম্পন্ন করে; কিন্তু গণবিক্ষোভের মুখে কয়েকদিনের মধ্যেই পদত্যাগে বাধ্য হয়। সূক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগ থাকলেও ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয়লাভের পর বিএনপি সরকারের পরোক্ষ সমর্থনে অবৈধভাবে বাংলাদেশে বসবাসরত বিদেশী পাসপোর্টধারী এবং একাত্তরের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের জন্য অভিযুক্ত গোলাম আযমকে ২৯ ডিসেম্বর ১৯৯১ জামায়াতে ইসলামীর আমির নির্বাচিত করা হয় এবং পরবর্তী সময়ে পরিকল্পিত আইনী প্রক্রিয়ায় তাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্বও প্রদান করা হয়। ১৯৯২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি কর্নেল তাহের মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক প্রতিনিধি সভায় শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে আহ্বায়ক এবং অধ্যাপক আব্দুল মান্নান চৌধুরীকে সদস্য সচিব করে ৭২টি সংগঠন সমন্বয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ গঠন করা হয়। এ সংগঠন ৩ মার্চ ১৯৯২ বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেটে প্রথম জনসভার আয়োজন করে। জাহানারা ইমামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেই সমাবেশে বক্তব্য রাখেন মহীয়সী নারী কবি সুফিয়া কামাল এবং তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সেই মহতী সমাবেশে আমারও বক্তব্য রাখার সুযোগ হয়েছিল। সেদিনের ভাষণে শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা এ আন্দোলনে আওয়ামী লীগের সকল স্তরের নেতা-কর্মীদের ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। আমরা পরবর্তী সময়ে প্রত্যক্ষ করেছি ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্থাপিত ঐতিহাসিক গণআদালতে লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতির পেছনে রয়েছে শেখ হাসিনার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সে সময়ে জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে তিনি সুস্পষ্ট প্রস্তাব উত্থাপন করেন; কিন্তু বিএনপি-জামায়াত সরকার তা নাকচ করে দেয় এবং জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীসহ গণআদালতের সঙ্গে যুক্ত ২৪ দেশবরেণ্য ব্যক্তির নামে রাষ্ট্রদ্রোহের মিথ্যা মামলা দায়ের করে। এ সময় শেখ হাসিনাকে হত্যার বেশ কয়েকটি চক্রান্ত অল্পের জন্য ভ-ুল হয়ে যায় এবং তিনি প্রাণে রক্ষা পান। দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ গণরায় পেয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে। তার সরকার জনজীবনের সঙ্কট দূর করে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরিয়ে আনার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে। বয়স্কভাতা, বিধবাভাতা, মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বৃদ্ধি ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান, আশ্রয়ণ প্রকল্প, কমিউনিটি ক্লিনিক, ভিজিএফ কার্ড চালুসহ অসংখ্য গণমুখী কর্মসূচী গ্রহণ করে। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও শান্তিবাহিনীর প্রধান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমার সঙ্গে সরকারের ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়। এ চুক্তির ফলে পাহাড়ে দীর্ঘদিনের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসান ঘটিয়ে শান্তি স্থাপনের পথ সুগম হয় এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুরক্ষিত হয়। দীর্ঘদিন যাবত ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে বিগত সরকারগুলো কোন আলোচনা ও চুক্তি সম্পাদন করতে ব্যর্থ হওয়ায় বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে মরু প্রক্রিয়া শুরু হয়, পদ্মা ও শাখা নদীসমূহে চর পড়তে শুরু করে। এমনি পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা গঙ্গার পানি চুক্তিকে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেন। অনেক আলোচনা ও বৈঠকের পর অবশেষে ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর দিল্লীতে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ত্রিশ বছর মেয়াদী গঙ্গার পানি চুক্তি নবায়ন করা হয়। এই চুক্তি মোতাবেক বাংলাদেশ শুকনো মৌসুমে সর্বনি¤œ ৩৫,০০০ কিউসেক পানি পাবার নিশ্চয়তা লাভ করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীদের রক্ষা করার জন্য মোশতাক-জিয়া সরকার কুখ্যাত ইমডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি এবং তা আইনে পরিণত করে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে ইমডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল ও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেন। প্রচলিত আইনে এ বিচার শেষ হলেও উচ্চ আদালতে এটি প্রক্রিয়াধীন থাকা অবস্থায় পরবর্তী নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠন করে। এ সময় তারা বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীদের রক্ষা করার জন্য পরিকল্পিতভাবে মামলাটি ঝুলিয়ে রাখে। শেখ হাসিনার ওই মেয়াদের শাসনামলে যমুনা নদীর ওপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতুর কাজ সমাপ্ত করে যানবাহন ও রেল চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। শিল্পায়নের স্বার্থে বিদ্যুত উৎপাদনকে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করে ১৮০০ মেগাওয়াট থেকে ৪৬০০ মেগাওয়াটে উন্নীত করা হয়। ঢাকা মহানগরে যানজট নিরসনে ফ্লাইওভার নির্মাণের সূচনা করা হয়। শেখ হাসিনার দ্রুত ও কার্যকর উদ্যোগের ফলে জাতিসংঘের ইউনেস্কো কর্তৃক ২১ ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’-এর স্বীকৃতি লাভ করে। দেশের ক্রীড়াক্ষেত্রেও এ সময়ে অভাবনীয় সাফল্য অর্জিত হয়। বাংলাদেশ বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলার যোগ্যতা অর্জন এবং টেস্ট পরিবারের সদস্যপদ লাভ করে। ২০০১-এর নির্বাচনে দেশী-বিদেশী চক্রান্তে পরাজিত হয় আওয়ামী লীগ। ক্ষমতায় আসে বিএনপি-জামায়াত। বাংলাদেশের মানুষ নতুন করে ’৭১-এর বিভীষিকার অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়। ক্ষমতা গ্রহণ করার পরপরই বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডাররা দেশব্যাপী আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা শুরু করে। অগ্নিসংযোগ, লুটপাট এবং পাশবিক নির্যাতন চালায় সর্বত্র। অনেক কিশোরী আত্মহত্যা করে নিজের লজ্জা ঢাকবার জন্য। ফাহিমা, মাহিমা, পূর্ণিমা, অজুফারা সারাদেশে বর্বরতার সাক্ষী হয়ে রইল। এ সময়ে আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতাকর্মীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সর্বত্র চলে ত্রাস আর লুটপাটের রাজত্ব। সাংবাদিক মানিক সাহা, হুমায়ুন কবীর বালু, নাটোরের এ্যাডভোকেট মমতাজ উদ্দিন, খুলনার এ্যাডভোকেট মঞ্জুরুল ইমাম, টঙ্গীতে আহসানউল্লাহ মাস্টার এমপি এবং হবিগঞ্জে শাহ এএমএস কিবরিয়াকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দান, সাতক্ষীরার কলারোয়া, গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণ চালানো হয়। এসব বিচ্ছিন্ন আক্রমণ ব্যর্থ হবার পর ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউতে সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে বক্তব্য দেয়ার সময় পরিকল্পিত ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। হামলায় কেন্দ্রীয় নেত্রী আইভী রহমানসহ ২৪ জন নিহত এবং সকল কেন্দ্রীয় নেতাসহ প্রায় পাঁচ শতাধিক আহত হন। মেয়র হানিফসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মানবঢাল বানিয়ে শেখ হাসিনাকে রক্ষা করেন। দ্রুত বুলেটপ্রুফ গাড়িতে উঠে যাবার সময় তার গাড়ি লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলিবর্ষণ করা হয়। কথায় বলে- ‘রাখে আল্লাহ্ মারে কে’। মানুষের দোয়া ও ভালবাসায় শ্রবণযন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হলেও শেখ হাসিনা সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান। বিএনপির এই মেয়াদের শাসনামলে তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় দেশব্যাপী জঙ্গীবাদ ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করে। রাজশাহীর বাগমারায় জঙ্গীনেতা বাংলা ভাইয়ের উত্থান এবং শায়খ আবদুর রহমানের নেতৃত্বে দেশের ৬৩ জেলার ৫০০ স্থানে একযোগে বোমা হামলা চালানো হয়। সিনেমা হল, যাত্রা প্যান্ডেল, আদালত, বার লাইব্রেরিসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বোমা হামলা চালিয়ে জঙ্গীগোষ্ঠী তাদের শক্তিমত্তা প্রদর্শন এবং ভীতির সঞ্চার করতে চেয়েছিল। বগুড়ায় এক ট্রাক গোলাবারুদ উদ্ধার, চট্টগ্রাম বন্দরে সিইউএফএল জেটিতে দশ ট্রাক আধুনিক অবৈধ অস্ত্র খালাসের পেছনে সরকারের উচ্চমহলের সম্পৃক্ততার অভিযোগ এবং প্রমাণ রয়েছে, যা আদালতে বিচারাধীন। বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসনে ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ যখন পরিবর্তন চাইছে তখন যেনতেনভাবে একটি নির্বাচনের মহড়া সাজিয়ে বিএনপির ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার অপচেষ্টা মানুষ প্রত্যক্ষ করে। ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার নামে দেড় কোটি ভুয়া ভোটার তালিকাভুক্তকরণ, নিজ দলীয় লোকদের নির্বাচন কমিশনার নিয়োগদান, উপজেলার নির্বাচনী অফিসার পদে ছাত্রদল-ছাত্র শিবিরের কর্মীদের নিয়োগ মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে নিজেদের পছন্দের লোককে মনোনয়নের স্বার্থে নির্লজ্জভাবে বিচারপতিদের বয়সসীমা বাড়িয়ে দেয়া হয়। চলবে... লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
×