ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্র নিয়ে প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

প্রকাশিত: ০৩:৫৪, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬

রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্র নিয়ে প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

আমরা দেখছি ইদানীং দেশে যে প্রকল্পই হাতে নেয়া হয় সবই নয়-ছয় বলে ঠেকিয়ে দেয়ার একটি প্রচেষ্টা প্রকট। কয়লা খনি থেকে কয়লা তুলতে বাধা দেয়া হচ্ছে। মানুষকে বোঝানো হলো কয়লা তুললে পরিবেশ নষ্ট হবে। কয়লা তুলতে না দিলে কয়লা আমাদের বিদেশ থেকে আমদানি করতে হবে। যেসব রাষ্ট্র কয়লা রফতানি করে তারা লাভের একটি অংশ সিএসআরের আওতায় পরিবেশবাদীদের দেয় পরিবেশ আন্দোলন করার জন্য, যাতে উন্নয়নশীল দেশে তাদের বাজার ঠিক থাকে। এ যুগের সাম্রাজ্যবাদীরা দেশ দখল করে না, করে বাজার দখল। সস্তায় বিদ্যুত পেতে হলে কয়লাতেই যেতে হবে এটা বিশ্বে স্বীকৃত। সেক্ষেত্রে রফতানিকারক দেশগুলো ফার্নেস তেল, জেনারেটরসহ অন্যান্য সামগ্রীর রফতানির বাজার হারাবে। অভিযোগ আছে তারাই আমাদের পরিবেশবাদীদের আন্দোলনে তৎপর রাখে। পরিবেশবাদীরা রামপালের আন্দোলনটিকে জনপ্রিয় করতে পেরেছেন। তারা মানুষকে ভয় দেখাতে পেরেছেন। রামপালে আসলে কি হচ্ছে! পাম্প দিয়ে পানি টানা হবে পশুর নদী থেকে, কয়লা জ্বালিয়ে তাপ উৎপন্ন করা হবে, সেই তাপে পানি বাষ্পীভূত হয়ে যে হিউজ প্রেসার তৈরি হবে তা দিয়ে টারবাইন জেনারেটর ঘুরবে আর এভাবে উৎপন্ন হবে বিদ্যুত। আবার পানি ফুটিয়ে যে বাষ্প তৈরি হলো সেটাকে ঘনীভবনের মাধ্যমে শীতল করে বিশুদ্ধ পানিতে পরিণত করে পাঠানো হবে নদীতে। কিছু ব্যবহার করা হবে অন্য কাজে। হবে একটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট। ব্যস, এই হলো সরল প্রিন্সিপল। কিন্তু মানুষ মনে করছে ওখানে কি না কি আজগুবি সব কাণ্ড ঘটে যাবে। কয়লাভিত্তিক একটি বড় বিদ্যুতকেন্দ্র করতে হলে যে বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হয় তা হলো- সুবিধাজনক জমি, কয়লা পরিবহনের সুবিধা, পানির যোগান, বিদ্যুত সঞ্চালন সুবিধা, নির্মাণ সামগ্রীর সহজপ্রাপ্যতা, নিকটবর্তী বিমানবন্দরের এয়ার ফানেলে চিমনির অবস্থান না থাকা, প্রতœতাত্ত্বিক-ঐতিহাসিক-ধর্মীয়-সামরিক স্থাপনা ইত্যাদি হতে ১০ কিমি দূরবর্তী, পরিবেশ অধিফতরের বিধি-বিধান অনুসরণ, নিকটবর্তী কয়লার উৎস, খুব কম মানুষকে উচ্ছেদ এবং স্থানীয় জনগণের মতামত গ্রহণ করা। এসব দিক বিবেচনা করে সরকার ২০০৯ সালে খুলনা অঞ্চলে বিদ্যুতকেন্দ্রের জন্য তিনটি সম্ভাব্য স্থান নির্বাচন করে। ১. লবণছড়া, খুলনা ২. রামপাল, বাগেরহাট ৩. চুনকড়ি, দাকোপ, খুলনা। চুনকড়ি জায়গাটি ‘ইনিশিয়াল স্ক্রিনিং’-এর অংশ হিসেবেই বাদ পড়ে যায়। এরপর লবণছড়া ও রামপালের মধ্যে বিদ্যুত নির্মাণ গাইডলাইন অনুসরণে বিভিন্ন সীমারেখা, পরিবেশগত ও ফিসিবিলিটি স্টাডির পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়। পরীক্ষাতে রামপাল উত্তীর্ণ হয়। লবণছড়ার বাদ পড়ার কারণ হলো জায়গা কম, বেশি মানুষকে উচ্ছেদ করতে হবে, বিভাগীয় শহরের মাত্র দুই কিলোমিটারের মধ্যে থাকা, নদীর নাব্য কম হওয়া, কয়লা পরিবহনে বেশি দূরত্বের কারণে পরিবহন খরচ বেশি। রামপাল সবচেয়ে বেশি ইন্ডিকেটরে পাস করেছে। এখানে প্রয়োজনীয় জমির পরিমাণ ১৮৩০ একর পাওয়া গেছে। মাত্র ১২৫টি পরিবারকে অন্যত্র সরিয়ে পুনর্বাসন করতে হয় আর বেশিরভাগ হলো নিচু, পতিত জমি, যা মাটি ভরাট করে উঁচু করা হয়েছে, জনবসতি প্রতি বর্গকিলোমিটারে মাত্র ১২১ জন, খুলনা বিভাগীয় শহর হতে ২৩ কিলোমিটার দূরে, নদীর নাব্য প্রায় ৬.৫ থেকে ৭.৫ মিটার, কয়লা পরিবহন খরচ তুলনামূলকভাবে কম, বিকল্প পরিবহন ব্যবস্থা হিসেবে খুলনা থেকে মংলা পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ কাজ প্রক্রিয়াধীন। এই প্রক্রিয়ায় সরকার মাতারবাড়ি, পায়রা, আনোয়ারা, খুলনা এবং মুন্সীগঞ্জেও কয়লাভিত্তিক পাওয়ার প্লান্ট নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো সুন্দরবনকে আন্তর্জাতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দান করে। সে হিসেবে এটি একটি সংবেদনশীল জায়গা। আন্তর্জাতিকভাবে গভীর বনভূমির ১০ কিলোমিটারের মধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ না করার আইন আছে এবং অভয়ারণ্য থেকে এই বাধ্যবাধকতা ২৫ কিলোমিটার। রামপালের বিদ্যুতকেন্দ্রটি সুন্দরবনের প্রান্তসীমানা থেকে ১৪ কিলোমিটার এবং বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হতে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই এলাকার বায়ুপ্রবাহ সুন্দরবনের বিপরীত দিকে। প্রকল্প সফল হলে শুষ্ক মৌসুমে পশুর নদী থেকে প্রবাহের ০.০৫% মানে ২ হাজার ভাগের এক ভাগ পানির প্রয়োজন হবে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে শব্দ ২০০ মিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার ব্যবস্থা থাকবে। প্রথমে ৯১৫ একরের মাঝে মূল বিদ্যুতকেন্দ্রটি হবে ৪৬৫ একর জায়গার ওপর এবং বাকি অংশে থাকবে সোলার প্যানেল ও সবুজায়ন (এৎববহ ইবষঃ)। এই অংশ সফল হলে প্রকল্পের বাকি ৯১৫ একরে করা হবে দ্বিতীয় বিদ্যুতকেন্দ্রটি। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ২ হাজার ৬৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুত পাওয়া যাবে। প্রথম পর্যায়ে আগামী ২০১৮ সালে এ কেন্দ্র থেকে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বিনিয়োগ হচ্ছে প্রায় ১৮০ কোটি মার্কিন ডলার। এই লক্ষ্যে আমাদের পিডিবির সঙ্গে ভারতের ঘঞচঈ সমান অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ‘বাংলাদেশ ভারত মৈত্রী’ বিদ্যুত কোম্পানি গঠন করে। উভয় সংস্থা ১৫ শতাংশ বিনিয়োগ করবে। বাকি ৭০ শতাংশ দেবে ভারতের এক্সিম ব্যাংক ঋণ হিসেবে। রামপাল প্রকল্পে এ যাবত আবিষ্কৃত সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে। এখানে হবে আলট্রা-সুপারক্রিটিক্যাল বিদ্যুতকেন্দ্র। মানে একটি সাধারণ বিদ্যুত কেন্দ্রের কয়লা পোড়ানোর দক্ষতা যেখানে ২৮%, সেখানে আলট্রা-সুপারক্রিটিক্যাল পাওয়ার প্লান্টের দক্ষতা ৪২-৪৩%। অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আমদানিকৃত উন্নত গুণগত মানসম্পন্ন কয়লা এখানে ব্যবহার করা হবে। এখানে ইএসপি থাকবে, যা উদগীরণকৃত ফ্লাই এ্যাশের ৯৯.৯৯ শতাংশ ধরে রাখতে সক্ষম হবে। এই ছাই সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে ব্যবহৃত হবে। একইভাবে এফজিডি স্থাপনের ফলে ৯৬ শতাংশ সালফার গ্যাস শোষিত হবে। এই সালফার গ্যাস থেকে জিপসাম সার তৈরি হবে। রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্রের চিমনীর উচ্চতা হবে ২৭৫ মিটার। এই চিমনি দিয়ে যে কার্বনডাই-অক্সাইড বের হবে তা বিদ্যুতকেন্দ্রের ১.৬ কিলোমিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। মোটামুটিভাবে প্রকল্প এলাকার বায়ুম-লকে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এবং অন্য আন্তর্জাতিক সংস্থার স্বীকৃত মাত্রার সীমার মধ্যে রাখার বাধ্যবাধকতা আছে। অনেকের অভিযোগ ভারতে বনাঞ্চলের ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণের আইনী বাধা আছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে ভারত বাংলাদেশ থেকে আয়তনে ২৩ গুণ বড় আর তাদের জনসংখ্যার ঘনত্ব আমাদের থেকে প্রায় আড়াই গুণ কম। আমাদের চলতে হবে আমাদের হিসাবে এবং আন্তর্জাতিক আইন মেনে। অনেকে পরিবেশেবাদীদের প্রচারে ভীত হয়ে ভাবছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র হলে এসিড বৃষ্টি হবে। এটি আদৌ ঠিক নয়। কার্বনের সঙ্গে এসিডের সম্পর্ক নেই। তাছাড়া গাছের খাবারই হলো কার্বনডাই-অক্সাইড। আমাদের বড়পুকুরিয়াতে ঘনবসতি এবং সবুজে ঘেরা এলাকায় গত দশ বছর একটি সাব-ক্রিটিক্যাল পাওয়ার প্লান্ট চলছে। সেখানে কোন সমস্যা হয়নি। আর রামপালে হচ্ছে তার চেয়ে উন্নত প্রযুক্তির আলট্রা-সুপারক্রিটিক্যাল প্লান্ট। কয়লা পোড়ালে ক্ষতিকর পদার্থ নিঃসরণ হবে- এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। আমাদের দেখতে হবে সরকার যে বলছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করবে, যেগুলো ক্ষতিকারক পদার্থগুলোকে পরিবেশে ছড়াতে দেবে না, উল্টো সেগুলোর কোন কোনটিকে রাসায়নিকভাবে পরিবর্তন করে মানুষের উপকারী বস্তুতে পরিণত করা হবে তা নিশ্চিত হচ্ছে কিনা। ভুলে গেলে চলবে না পৃথিবীতে মানুষের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেই। সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবার গল্প দিয়ে মানুষকে আবেগাপ্লুত করে প্রকল্পটির বিরোধিতা শুরু হলেও এখন তা ভারতবিরোধিতায় চলে গেছে। মানে ভারত এই প্রকল্প থেকে লাভবান হচ্ছে বলে প্রচার করা হচ্ছে। আসল কথা হলো যেনতেনভাবে বিদ্যুতকেন্দ্রটি ঠেকিয়ে দেয়ার জন্য যত রকমের নেতিবাচক প্রচারণা চালানো যায় সচেতনভাবে তা করা হচ্ছে। বিভিন্নজনের বিভিন্ন স্বার্থ আছে। সবাই যার যার স্বার্থে এখানে একত্রিত হয়েছেন। লেখক : ব্যাংকার
×