ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নুরুল ইসলাম বাবুল

ব্যাঙ রাজা আর টুম্পা-টুপন

প্রকাশিত: ০৬:২৬, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬

ব্যাঙ রাজা আর টুম্পা-টুপন

ভোর থেকেই শুরু হয়েছিল মেঘের গুড়–ম-গুড়–ম ডাক। তারপর বৃষ্টি। কখনও রিমঝিম-রিমঝিম। কখনও ঝরছিল মুষলধারে। আর এখন রোদও উঠেছে বৃষ্টিও পড়ছে। তাই দেখে চেচিয়ে উঠল টুম্পা আর টুপন। দৌড়ে উঠানের মাঝখানে চলে গেল। টুপন গান ধরল। টুম্পা আনন্দে নাচতে শুরু করল। দুই ভাই-বোন হাততালি দিতে দিতে বলতে লাগল, ‘রোদ হচ্ছে বৃষ্টি হচ্ছে, খেক শিয়ালের বিয়ে হচ্ছে।’ গত রাতেও বৃষ্টি হয়েছিল। ডোবায়, খাল-বিলে বেশ পানি জমে গেছে। পাশের খালপাড় থেকে একটানা ঘ্যাঙর ঘ্যাং... ঘ্যাঙর ঘ্যাং... ডাক শোনা যাচ্ছে। টুম্পা আর টুপনের কানে বেজে উঠছে ব্যাঙগুলোর সেই ডাক। মেঘের গুড়–ম-গুড়–ম আওয়াজ। একটানা বৃষ্টি। রোদ-বৃষ্টির খেলা। ব্যাঙদের ডাকাডাকি। ঠিক এভাবে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে বর্ষা আসে। টুম্পা-টুপনদের গ্রামের চারদিকে থৈ থৈ করে জল। বর্ষার জল-কাদায় আর বৃষ্টির ফোঁটায় ফোঁটায় আনন্দে মেতে ওঠে ওরা। ব্যাঙগুলো অবিরাম ঘ্যাঙর ঘ্যাং...ঘ্যাঙর ঘ্যাং...করেই যাচ্ছে। একটু আগেই খালপাড়ে গিয়েছিল টুম্পা আর টুপন। একেবারে খালের পাড়ে গিয়ে দাঁড়াতেই ঝুপঝাপ করে লাফিয়ে পড়ল কয়েকটা ব্যাঙ। অনেকটা ওপরের দিকে ছিল ব্যাঙগুলো। টুম্পা-টুপনকে দেখে ভয়ে পানিতে ঝাঁপ দিয়েছে। তা দেখে পানিতে থাকা ব্যাঙগুলোও ডাক থামিয়ে ডুব দিল। অনেক সময় দাঁড়িয়ে থেকেও ব্যাঙগুলোর দেখা পেল না ওরা। তাই মন খারাপ করে বাড়িতে ফিরে এল দুই ভাইবোন। কিন্তু বাড়ি পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই আবার শুরু হয়েছে ঘ্যাঙর ঘ্যাং...ঘ্যাঙর ঘ্যাং...। দুই ভাইবোনের মধ্যে টুম্পা বড়। দুজনের গলায় গলায় ভাব। ছোট ভাই টুপন সব সময় বোনের পিছু পিছু থাকে। একটু আগে খালপাড়ের ব্যাঙগুলো যেভাবে ডাকছিল, এখন সেই ডাক অন্যরকর শোনা যাচ্ছে। টুম্পা কান পেতে শুনল। হ্যাঁ, ব্যাঙদের আনন্দময় ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ ডাক শোনা যাচ্ছে না। শুধু ক্যাঁ ক্যাঁ শব্দ হচ্ছে। টুম্পার মনে হলো ওরা খুব বিপদে পড়ে কাঁদছে। মুহূর্তে খালপাড়ের দিকে দৌড় দিল টুম্পা। টুপন বড় বোনের পিছু নিল। টুম্পা খালপাড়ে পৌঁছেই ভয় পেয়ে গেল। একটা হলদে রঙের মোটা সাপ সবচেয়ে বড় ব্যাঙটার পা খাবলে ধরেছে। ব্যাঙটা ক্যাঁ-ক্যাঁ করে চিৎকার করছে। অন্য ব্যাঙগুলো ভয়ে জড়সড় হয়ে রয়েছে। সাপটা ধীরে ধীরে ব্যাঙের একটা পা গিলে ফেলল। ঠিক সেই সময়ে টুপন একটা ভাঙ্গা ইট এনে টুম্পার হাতে দিল। টুম্পা সাপের দিকে ছুড়ে মারল ইট। ইটের আঘাতে কুঁকড়ে উঠল সাপ। ব্যাঙটা ছাড়া পেয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচল। টুম্পা শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে ঢিল ছুড়েছিল। সাপটা সহ্য করতে না পেরে মরে গেল। টুম্পা-টুপন বাড়ি ফেরার জন্যে পা বাড়াচ্ছিল। ঠিক তখনই খালের মধ্য থেকে একটা ব্যাঙ ডেকে উঠল, দাঁড়াও বন্ধুরা। দুই ভাইবোন পেছন ফিরে তাকাতেই অন্য একটা ব্যাঙ বলল, তোমরা আমাদের রাজাকে আজ প্রাণে বাঁচিয়েছ। তোমাদের অনেক ধন্যবাদ। সেই বড় ব্যাঙটা পায়ের ব্যথায় উঁ করে উঠে বলল, তোমরা না থাকলে ওই দুষ্ট সাপটা আমাকে খেয়েই ফেলতো। আজ থেকে তোমরা আমাদের সবার বন্ধু। টুম্পা কিছু একটা বলতে চাইছিল। কিন্তু আরেকটা ব্যাঙ বলতে লাগল, এর আগেও তোমরা এসেছিলে। তখন আমরা তোমাদের দেখে পালিয়েছিলাম। তোমরা মন খারাপ করে বাড়ি চলে গিয়েছিলে। ব্যাঙটার কথার রেশ ধরে ব্যাঙরাজা বলল, জানই তো দুষ্ট ছেলে-মেয়েরা এসে আমাদের ঢিল ছুড়ে মারে। তাতে অনেক ব্যাঙ আহত হয়। আবার মারাও যায়। তোমরা যে দুষ্টদের দলে নেই তা আমরা বুঝতে পারিনি। কিছু মনে কর না। এই বলে ব্যাঙরাজা অন্যসব ব্যাঙকে হুকুম করল, তোরা সবাই সামনে আয়। আর সুন্দর করে গান ধর। নতুন বন্ধুদের গান শুনিয়ে দে। ব্যাঙরাজার হুকুমে সব ব্যাঙ পাড়ে এলো। একসঙ্গে গান গাইতে লাগল, ঘ্যাঙর ঘ্যাং...ঘ্যাঙর ঘ্যাং...ঘ্যাঙর ঘ্যাং...। কিছুদিন পর নদীর বড় বাঁধ ভেঙ্গে কলকল করে পানি এলো। দিন-রাতের মধ্যে মাঠ-ঘাট ডুবে গেল। পাশের খালেও পানি পড়তে শুরু করেছে। টুম্পা আর টুপন দাঁড়িয়ে দেখছিল গড়িয়ে পড়া পানির স্রোত। একটু দূরে টুম্পার দুজন সহপাঠী গামছা দিয়ে ছোট ছোট মাছ ধরছিল। টুম্পা সেদিকে এগিয়ে গেল। বড় বোনকে লক্ষ্য না করে খালপাড়েই বসেছিল টুপন। ব্যাঙরাজা আর ব্যাঙদের দেখবে সে। কিন্তু ব্যাঙগুলো আজ ভীষণ ব্যস্ত। গড়গড় করে পানি পড়ছে খালে। এখান থেকে চলে যাবে তারা। তাই এত ব্যস্ততা। টুপনকে দেখতেই পায়নি ব্যাঙগুলো। আর টুম্পা সহপাঠীদের সঙ্গে মাছ ধরার খেলায় মেতে উঠেছে। টুপনের কথা একদম ভুলেই গেছে সে। ছোট্টমণি টুপন। এখনও সাঁতার কাটতে জানে না। আসতে আসতে একেবারে খালের কিনারে এসে গিয়েছিল টুপন। তাই হঠাৎ করে পা পিছলে ঝুপ করে খালের পানিতে পড়ে গেল। পড়েই হাবু-ডুবু খেতে লাগল। ঝুপ করে শব্দ হওয়ায় বিপদ টের পেল ব্যাঙগুলো। ব্যাঙরাজা দেখল তাদের বন্ধু টুপন পানিতে পড়ে হাবু-ডুবু খাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাঙরাজা হুকুম করল সব ব্যাঙকে। রাজার হকুমে ব্যাঙগুলো ক্যাঁ-ক্যাঁ করে বিপদ সঙ্কেত বাজাতে লাগল। একসঙ্গে এতগুলো ব্যাঙের ক্যাঁ-ক্যাঁ শব্দে ঘুরে তাকাল টুম্পা। এতক্ষণ পর টুপনের কথা মনে পড়ল। কোথায় টুপন? দৌড়ে খালপাড়ে এল টুম্পা। এসেই দেখল পানিতে ডুবে যাচ্ছে আদরের ছোট ভাই। তড়িঘড়ি করে টুম্পা একটু নিচে নামল। হাত বাড়িয়ে তুলে আনল টুপনকে। তেমন কিছু হয়নি ওর। একটু যা পানি খেয়েছে। টুম্পা পেটে চাপ দিয়ে তা বের করে দিল। ব্যাঙরাজা এগিয়ে এসে টুপনকে বলল, সাঁতার না শিখে একা-একা পানির কিনারে এসো না বন্ধু। টুম্পা ব্যাঙরাজাকে ধন্যবাদ জানাল। ব্যাঙরাজা বলল, বিপদে সাহায্য করাই তো বন্ধুর কাজ। টুম্পা মাথা নেড়ে বলল, ঠিক তাই। তখন অন্য ব্যাঙগুলো গান গাইতে শুরু করল, ঘ্যাঙর ঘ্যাং...ঘ্যাঙর ঘ্যাং...ঘ্যাঙর ঘ্যাং...। টুপন আনন্দে হাততালি দিতে লাগল। অলঙ্করণ : আইয়ুব আল আমিন
×