ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সমাজ গঠনে নাটকের জুড়ি নেই

প্রকাশিত: ০৪:০৫, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬

সমাজ গঠনে নাটকের জুড়ি নেই

স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর বগুড়ার রঙ্গমঞ্চ যখন প্রায় নট (অভিনেতা) শূন্য তখন গুণী নাট্যজনেরা কয়েক তরুণ তরুণী নিয়ে গঠন করেন নাট্যগোষ্ঠী। সেদিনের সেই তরুণদের একজন সৈয়দ সুলতান আলম। বয়স ৬৫ বছর। বয়সের ছাপ পড়তে দেননি মুখাবয়বে। সময় পেলে এখনও দাপটের সঙ্গে মঞ্চে অভিনয় করে শক্তিমান অভিনয় শৈলীর পরিচয় দেন। সেদিনের ও আজকের দর্শক তার অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে তাকে ধন্য করে। সৈয়দ সুলতান আলম যিনি সুলতান নামেই বেশি পরিচিত। স্মৃতির পাতা মেলে ধরলেন এভাবে- কেবলই মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন হয়েছে। তরুণদের মধ্যে বিজয়ের আনন্দের রেশ। দেশ গঠনে সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে সাজাবার প্রস্তুতি নেয় তারা। এরই মধ্যে সেদিনের প্রবীণ নাট্যজন ডা. ননী গোপাল দেবদাস, শিক্ষক তাজমিলুর রহমান, ডা. ফজলুল করিম, ওস্তাদ দবির উদ্দিন, শ্যামল ভট্টাচার্য বৈঠক করে নাটকের দল গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। তাদের মধ্যে তাজমিলুর রহমান নাটক লিখতেন। বাকিরা কেউ অভিনয় কেউ আবৃত্তি করতেন। স্কুল কলেজের নাটকে এবং পাড়া মহল্লায় অভিনয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছে এমন তরুণ তরুণীদের খুঁজতে থাকেন। এক পর্যায়ে ডাক পড়ে সুলতানের। তখন তিনি কলেজের শিক্ষার্থী। স্মৃতির পাতা থেকে সেই তারিখটি বের করলেন। সেদিন ছিল ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৫ তারিখ। সন্ধ্যায় আকবরিয়া হোটেলে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন। এমন সময় অভিনেতা শফি হাসান আলো (যিনি ওই সময়ের চলচ্চিত্র অভিনেতা ও নৃত্য পরিচালক আহমেদুর রহমান রানুর ছোট ভাই) সুলতানকে ডেকে বলেন, জিলা স্কুলের শিক্ষক তাজমিলুর স্যার ডেকেছেন। উত্তরা সিনেমা হলের ওপর তলায় এক কক্ষে তারা গেলেন। সেখানে নাট্যদল গঠনের বৈঠক চলছিল। ওই দিনই গঠিত হয় বগুড়া নাট্য গোষ্ঠী। তারপর টগবগিয়ে এগিয়ে চলা। নাট্য গোষ্ঠীর সুলতান অভিনয় করেন অন্ধকারের নিচে সূর্য, ফলাফল নি¤œচাপ, সুবচন নির্বাসনে। প্রতিটি নাটকেই তার অভিনয় দর্শক প্রশংসিত হয়। বিশেষ করে ফলাফল নি¤œচাপ নাটকে সৎ পুলিশ ইন্সপেক্টরের চরিত্রে সুলতানের অভিনয় এতটাই হৃদয়গ্রাহী ছিল যে, সেদিনের অনেক পুলিশ অফিসারের মধ্যে তার ছায়া পড়ে। নাটক যে সমাজ গঠনে কত বড় ভূমিকা রাখে তার প্রমাণ দেয় এই নাটক। তার অভিনীত দন্ডকারণ্য নাটক জাতীয় নাট্য প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেয়েছে। এ পর্যন্ত তিনি অনেক মঞ্চ নাটকের দুইশ’র বেশি শোতে অংশ নিয়েছেন। সুলতানকে কৌতুক অভিনেতা হিসেবে বলে অনেকে। সুলতান তীব্র বিরোধিতা করে বলেন, কৌতুক অভিনেতা বলে কিছু নেই। চরিত্রের প্রয়োজনে যে অভিনয় দর্শককে বিনোদন দেয়, হাসায় তা কৌতুক নয়। সত্তরের দশকের তার এই কথা বর্তমানের মঞ্চ নাটক, টিভি নাটক চলচ্চিত্রে প্রমাণিত হয়েছে। নাটকের গল্প চরিত্রটিকে যেভাবে প্রতিফলিত করে অভিনেতাকে তাই করতে হয়। প্রবীণ অভিনেতা সুলতান বলেন, অভিনয়ের অনেক কিছুই হাতে কলমে শিখিয়েছেন বগুড়ার সংস্কৃতজন মৃণাল কান্তি সাহা। সদাহাস্য ‘সেন্স অব হিউমার’ সুলতানের আরেক বড় গুণ। তার সঙ্গে কথা বললে মনে হবে জীবনে কোন দুঃখবোধ নেই! যত দুঃখবোধ তা এক ফুৎকারে উড়িয়ে দেন। সেক্সপিয়ারের কথায় মনে করেন জীবনটাই নাট্যমঞ্চ। সত্তরের দশকে সুলতান দিলীপ সোমের ‘শহর থেকে দূরে’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। বছর কয়েক আগে এই প্রবীণ বয়সেও নাটক শঙ্খনাদ ও টিভির ধারাবাহিক নাটক রমিজের আয়নায় দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। অভিনয় তাঁর অস্থিমজ্জায় মিশে আছে। কিশোর বেলায় অভিনয় করেছেন ঐতিহাসিক পটভূমির নাটক সোহরাব রুস্তম নাটকে। তারপর পাড়া মহল্লায় নাটক থেকে নাট্য মঞ্চ। মঞ্চের নাটক, সিনেমা ও টিভি নাটক তাকে দিয়েছে সম্মান। তবে সুলতান মঞ্চ নাটককেই অভিনয় শিল্পীর সরাসরি পরীক্ষা হিসাবে মনে করেন। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলেই সার্থক হতে পারে শিল্পী। সুলতান সার্থক কিনা সেই রায় দেবে দর্শক। স্ত্রী দুই সন্তান নিয়ে সুলতান তার নিজের ঘরে জীবনের বাস্তব অভিনয় করে চলেছেন। Ñসমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×