ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

স্বর্ণোজ্জ্বল মঞ্চের যবনিকা

প্রকাশিত: ০৪:০৪, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬

স্বর্ণোজ্জ্বল মঞ্চের যবনিকা

পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলা সদরে আখড়াবাড়ি, যা কেন্দ্রীয় কালীবাড়ি হিসেবে বেশি পরিচিত। এ কালীবাড়িতে এক সময়ে স্থায়ী মঞ্চ ছিল। একে কেন্দ্র করে প্রগতিশীল নাট্য আন্দোলন গড়ে ওঠে। এখানে নিয়মিত মঞ্চায়ন হয়েছে দেশাত্মবোধক নাটক ও যাত্রাপালা। এতে অভিনয় করতেন স্থানীয় অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। প্রতিটি মঞ্চায়নেই নাট্যামোদি মানুষের ঢল নেমেছে। রাত জেগে পালা উপভোগ করেছে হাজারো মানুষ। সময়ের বিবর্তনে স্থায়ী মঞ্চ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হারিয়ে গেছেন অভিনয়শিল্পীরা। এখন সে ধরনের নাট্য আন্দোলন গড়ে তোলার নেতৃত্বেরও অভাব রয়েছে। নিয়মিত যাত্রা এবং নাটক মঞ্চায়নের মাধ্যমে সংস্কৃতি চর্চার যে ধারাটি প্রবহমান ছিল, তা আজ ইতিহাস। গত শতকের পঞ্চাশ এবং ষাট দশকের কথা। সে সময়ে থানা সদর বলতে ছিল পুলিশ স্টেশন আর হাতেগোনা গোটা কতক ছোটখাটো সরকারী দফতর। অবস্থাপন্নদের টিনের ছাউনি দেয়া বসতঘর। মাঝে মধ্যে ছনের ছাউনি। এখানে ওখানে সাপ্তাহিক হাটের চালাঘর। স্থায়ী দোকানও ছিল হাতেগোনা। পুরো শহরে পাকা রাস্তা বলতে ছিল ইট বিছানো সরু গলির এবড়ো খেবড়ো এক-দুটি রাস্তা। সবে ভারত ভাগ হয়ে পূর্ব পাকিস্তান হয়েছে। স্থানীয় প্রবীণদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ওই সময়টাতে সাব-রেজিস্ট্রার আবদুল করিম মিয়ার নেতৃত্বে থানা সদরে গড়ে ওঠে নাট্যান্দোলন, যা পুরো বরিশাল অঞ্চলে ব্যাপক সাড়া জাগায়। একই সময়ে তার নেতৃত্বে কালীবাড়ির বিশাল আটচালা ঘরের নিচে স্থাপিত হয় স্থায়ী নাট্যমঞ্চ। নাট্যমঞ্চ বলতে কাঠের পাটাতন। তিন দিকে কাপড় ঘেরা উইংস। সামনে পর্দা। এতেই নিয়মিত মঞ্চায়ন হয়েছে দেশাত্মবোধক নাটক। আবার যখন যাত্রাপালা হয়েছে, তখন আটচালার ঠিক মাঝখানে মঞ্চ করা হয়েছে। ওই সময়ে আবদুল করিম মিয়া ছাড়াও যারা নাটক ও যাত্রায় নিয়মিত অভিনয় করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হচ্ছেন সত্যরঞ্জন সরকার, ডা. নারায়ণ চন্দ্র সরখেল, ডা. জগদিশ চন্দ্র সরখেল, ডা. হরিপদ রায়, নগেন্দ্রনাথ সাহা, কায়কোবাদ মিয়া, সুধন্য রঞ্জন দাস, রমেশ দত্ত প্রমুখ। প্রবীণরা আরও একটি উল্লেখযোগ্য তথ্য জানিয়েছেন, ওই সময়ে সাধারণত নারী চরিত্রে পুরুষ অভিনয় করতেন। নারীরা মঞ্চে অভিনয় করছে, এমন দৃশ্য সে সময়ে ছিল কল্পনাতীত। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, সমাজের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে গলাচিপার সেই স্থায়ী নাট্যমঞ্চে স্থানীয় নারীরা দাপটের সঙ্গে পুরুষের পাশে থেকে অভিনয় করেছেন। সাব-রেজিস্ট্রার আবদুল করিম মিয়ার বদলিজনিত বিদায়ের পরে তৎকালীন গলাচিপা থানায় একই পদে আরেক নাট্যামোদি নিহাররঞ্জন চৌধুরী যোগ দেন। তিনি নাট্য আন্দোলনের এ ধারাটি আরও বেগবান করে তোলেন। নবাব সিরাজউদ্দৌলা যাত্রাপালার নাম ভূমিকায় তার অভিনয় আজও প্রবীণদের কাছে স্মরণীয় স্মৃতি হয়ে আছে। সত্তর দশক পর্যন্ত গলাচিপা কালীবাড়ির এ স্থায়ী নাট্যমঞ্চ নাট্য আন্দোলনকে গতিশীল করে রেখেছে। স্বাধীনতার পরে পঁচাত্তরে সপরিবারে জাতির জনকের নির্মম হত্যাকা-ের আগ পর্যন্ত স্থায়ী মঞ্চটি ছিল। এ সময়ে তারুণ্যে উদ্ভাসিত যুবকরা নাট্য আন্দোলনের হাল ধরে। তারা মঞ্চ নাটকে রীতিমতো বিপ্লব সৃষ্টি করে। কিন্তু পঁচাত্তরের পরে অব্যাহত সামরিক শাসনে স্থবির হয়ে পড়ে নাট্যচর্চা। এক পর্যায়ে স্থায়ী মঞ্চটি ভেঙ্গে ফেলা হয়। এরপর থেকে নাট্য আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে তেমন নেতৃত্ব সৃষ্টি হয়নি। নাট্যকর্মীদের পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে আসেনি কেউ। মুখ থুবড়ে পড়ে নাট্যচর্চা। ফলে সেই মঞ্চটির সঙ্গে সঙ্গে যবনিকাপাত ঘটে সফল নাট্য আন্দোলনের। আর ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পায় এসব স্বর্ণোজ্জ্বল অতীত। Ñশংকর লাল দাশ, গলাচিপা থেকে
×