ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

৭ হাজার ৬৪৭ নারী যাত্রীর জন্য বরাদ্দ মাত্র একটি বাস

যাতায়াতে অসহনীয় ভোগান্তিতে কর্মজীবী নারী

প্রকাশিত: ০৩:৫৭, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬

যাতায়াতে অসহনীয় ভোগান্তিতে কর্মজীবী নারী

এমদাদুল হক তুহিন ॥ শহরে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বাড়লেও তাদের যাতায়াতে পরিবহন সমস্যার অন্ত নেই। খোদ রাজধানীতে বিআরটিসি কর্তৃক ১৫টি মহিলা বাসের বরাদ্দ থাকলেও- ঘূর্ণাক্ষরেও চোখে পড়ে না এসব বাস। শুধু মহিলা বাসের অপ্রতুলতা-ই নয়, পাবলিক বাসের চালক-সহকারীর অসহযোগিতামূলক আচরণও দৃশ্যমান। গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ‘সিট খালি নেই’ অজুহাতে তারা নারীকে উঠতে দিচ্ছে না বাসে। দৃষ্টিকটু হলেও সত্য- নারীর জন্য বরাদ্দকৃত সিটেও বসে থাকে পুরুষ! এমন পরিস্থিতে যাতায়াতে প্রতিদিন অসহনীয় ভোগান্তি পোহাচ্ছে কর্মজীবী নারী। বাংলাদেশ লেবার ফোর্স সার্ভে ২০১০ সালের তথ্যমতে, সারাদেশে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা ১৩ লাখ। বিআরটিসির ৪৫০টি বাসের মধ্যে মহিলাদের জন্য বরাদ্দকৃত বাসের সংখ্যা মাত্র ১৭টি। এর মধ্যে রাজধানীতে ১৫টি ও বাকি ২টি চলছে চট্টগ্রামে। এসব বাস চলে আবার দিনের নির্দিষ্ট সময়ে। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় কেবল নির্দিষ্ট সময়ে মহিলা বাসের সুবিধা থাকায় এর উপকার মিলছে না তেমন। অনেকের মতে, গড়ে ৭ হাজার ৬৪৭ জন নারী যাত্রীর জন্য একটি বাসের বরাদ্দ কোন সুফল বয়ে আনছে না। আর কেউ কেউ বলছেন, মহিলা বসের এই বরাদ্দ কেবল লোক দেখানো! শাহবাগ থেকে উত্তরার রাস্তায় নিয়মিত যাতায়াত করেন চিত্রশিল্পী নুসরাত জাহান লাকি। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, রাস্তায় মহিলা বাস কম সময়ই চোখে পড়ে। এছাড়া সাধারণ বাসে উঠতেও বেগ পোহাতে হয়। উঠতে পারলেও সিট পাওয়া যায় মাঝে মধ্যে। এমনকি বেশিরভাগ সময়ই ঝগড়া করে পুরুষদের সিট থেকে উঠাতে হয়। ফার্মগেট থেকে মতিঝিলের একটি বেসরকারী অফিসে যাতায়াত করতে হয় আয়েশা আক্তার আছমাকে। তিনি জানান, অফিস ধরতে বাসে উঠার চেয়ে বিড়ম্বনা আর নেই। দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করেও নির্দিষ্ট সময়ে বাসে উঠা যায় না। ‘সিট নেই’ শব্দটি শুনতে হয় সবচেয়ে বেশি। এছাড়া বহু নারীকেই সহ্য করতে হয় শারীরিক লাঞ্ছনা। প্রতিবাদী হয়ে উঠলে অনেক ক্ষেত্রে সুফল পাওয়া যায়Ñ তবে এক্ষেত্রেও সহ্য করতে হয় বাঁকা চোখের টিপন্নী। গণপরিবহনে নারীদের এই হয়রানির চিত্র তুলে ধরে লেখিকা শাহানা হুদা লিখেছেন, ‘পাবলিক বাসে মেয়েদের হয়রানির কোন শেষ নেই। প্রথম কথা ভিড় ঠেলে, ছেলেদের গুঁতো ধাক্কা খেয়েও যদি কোন মেয়ে বাসে উঠতে চায়, তাকে বলা হয় সিট খালি নাই, মহিলা সিট খালি নাই। মেয়েরা যদি অন্য সিটে বসতে চায়, তখন নানা ধরনের মন্তব্য শুনতে হয়।’ তিনি আরও লিখেন, ‘যদি বাসে ভিড় বেশি থাকে, তাহলে যে কোন বয়সের মেয়েদের হেনস্তা হওয়ার শঙ্কা বেড়ে যায়। শরীরে হাত দেয়া, ব্যাগে হাত গলিয়ে দেয়া, অস্বস্তিকর স্পর্শ সব সহ্য করেই মেয়েরা বাসে, টেম্পো বা হিউম্যান হলারে চলছে।’ অসংখ্য মহিলাযাত্রীর সঙ্গে কথা বলেও পাওয়া গেছে এমন তথ্যই। বুধবার বিকেল ৫টা। সরেজমিনে ফার্মগেটে গিয়ে দেখা যায়, বহুনারী অপেক্ষা করছে বাসে উঠার জন্য। পুরুষরা উঠতে পারলেও নারীরা ছুটছেন এক বাস থেকে আরেক বাসের দরজায়। একই চিত্র লক্ষ্য করা গেছে শাহবাগেও। এ সময় আনিকা নামের এক নারী জানান, দিনের সবচেয়ে ব্যস্ততম সময়ে চালকের সহকারীরা মহিলা সিট খালি নেই বলে বাসে উঠতে দেয় না। ঢাকা শহরে প্রায় ৬ বছর যাবত বসবাস করছেন এমন এক পুরুষ জানান, দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় সর্বোচ্চ একবার চোখে পড়েছে মহিলা বাস! নারীদের এই ভোগান্তি প্রসঙ্গে এ্যাকশন এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেন, শহরে যদি গণপরিবহন পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকতো তাহলে নারীর জন্য আলাদা বাসের প্রশ্ন উঠত না। তাহলে নিশ্চিন্তে আমরা সবাই চলাফেরা করতে পারতাম। এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার কর্মী এলিনা খান জনকণ্ঠকে বলেন, ‘মহিলাদের জন্য বিআরটিসির বরাদ্দকৃত এই বাসের সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। আরও বাস বাড়ানো উচিত।’ তিনি আরও বলেন, ‘বেসকারি পরিবহন মালিকরা যদি ন্যূনতম চারটি বাস রাস্তায় নামায় এক্ষেত্রে তাদের উচিত হবে মহিলাদের জন্য আলাদা করে দুটি বাস বরাদ্দ রাখা। এছাড়া যাতায়াতে নারী যে হয়রানির শিকার হয়Ñ সেক্ষেত্রেও কর্তাব্যক্তিদের আরও বেশি মনোযোগী হওয়া দরকার।’ নারী যাত্রীদের সমস্যার প্রসঙ্গটি তুলে ধরলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশনের (বিআরটিসি) চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, নারী যাত্রীদের ভোগান্তি দূর করতে আমাদের আন্তরিকতা আছে। তবে শহরে যে মহিলা বাসগুলো চলাচল করছে তা অধিকাংশ সময় থাকে ফাঁকা। অনেক নারীই পরিবারের সঙ্গে চলাফেরা করেন, ফলে তারা মহিলা বাসে উঠতে চান না। বাস বাড়ানো হবে কি-না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘ইচ্ছে করলেও বাড়াতে পারছি না। লোকসান দিয়ে বাস চালাতে হচ্ছে। আপাতত মহিলা বাস বাড়ানোর কোন পরিকল্পনা নেই।’
×