প্রকৃতির নরম গায়ে বর্ষার স্যাঁতসেতে শ্যাওলা ধরা আড়মোড়া ভেঙ্গে গেলে আকাশের বিস্তীর্ণ মাঠে নীলের আবছায়া ঘন হয়ে ওঠে। পিচ্ছিল পথ শুকনো ধুলোয় শক্ত হলে আকাশ বালিকা আরও নীল হয়ে নীল শাড়ি পড়া তরুণীর মতো চপল নূপুর বাজিয়ে স্থির ঝুলে থাকে শূন্যতায়। সে নীলের মাঠে সাদা সাদা মেঘখ- কোদাল পড়া জমির মতো ভেসে বেড়ায় নিবির ছন্দে। সেই সঙ্গে নদীর কূল-ঘেঁষে চরে চরে কাশের-ফুল ধুতি গায়ে ব্রাহ্মণের মতো হেলে দুলে চলে অনিন্দ এক দোলনায়। যে দিকে চোখ যায় সেদিকেই কাশবন আর কাশবন, কাশফুল আর কাশফুল। নদীর জলে ছলছল জল-তরঙ্গ নেচে নেচে বয়ে যায় এক দিগন্ত থেকে আরেক দিগন্তে। পরিষ্কার বায়ুরূপ জানান দেয় বর্ষা শেষ- এখন শরৎ কাল। শরতের সে রূপভা-ার থেকে রং ছিটকে পড়ে কেবল প্রকৃতিকেই কখনো নীল, কখনো সাদা মেঘ আর কাশফুলে-ফুলে রাঙায় না; রঙ কবির মনেও ছিটকে পড়ে। ভাবাতুর করে তোলে কবির ভাবুক মনকে। তাই তো ‘বিদ্রোহী কবি’র তকমা যে কবির কপলে আঁকা লৌহমূর্তিরূপে সে কবি- কাজী নজরুল ইসলামও শারদশ্রী দেখে আপ্লুত হয়ে শরৎবন্দনা করেন এভাবে-
‘‘এল শারদশ্রী কাশ-কুসুম-বসনা
রসলোক বাসিনী
লয়ে ভাদরের নদী সম রূপের ঢেউ
মৃদু মধুহাসিনী
যেন কৃষাঙ্গী তপতী তপস্যা শেষে
সুন্দর বর পেয়ে হাসে প্রেমাবেশে’’ (কবি কাজী নজরুল ইসলাম)
বর্ষার ঘোর যেন কাটে না। আবছায়া লেগে থাকে প্রকৃতির আচলে। রোদের ফাঁকে ফাঁকে কালো মেঘ উঁকি মারে, ভয় দেখিয়ে ঝপাৎ করে নামে দুই এক আজলা ফোঁটা। হাঁকডাক দিয়ে অকারণ ভরালে ভাদরমাস কবিও রসিকতা করে দেখেন তার ছেলেখেলা-
‘‘ঘনকালো মেঘের আঁধার একটু হাসে একটু কাঁদে
রোদের সাথে লুকোচুরি খেলাটা বেশ জমিয়ে তোলে
এই যে এখন মনটা ভালো এই যে এখন মনটা খারাপ
ইচ্ছে হলেই গালফুলিয়ে কান্না শুরু
ইচ্ছে হলেই রোদের পরে রোদের খেলা.
কখন কী হয় সবাই ভীতু- এমনই যে শরৎ ঋতু’’ (আলাউদ্দিন আল আজাদ, একটু হাসে একটু কাঁদে)
তবে কি চেনা যায় না শরতের রূপ, ভাব, মর্জি? নাকি দুষ্ট ছেলের মতো বাজুতে ঘুঙুর বেঁধে থৈ থৈ করে হেসে বেড়ানোই তার স্বভাব? সে যাই হোক- মনভারের বিষণœ বৃষ্টি নূপুর অবসার নিলে কিশোরীর মতই নেচে উঠে কাশবন, ধানের ক্ষেত, সাদা আকাশ, নেচে উঠে বিবাগী তরুলতা। দৃশ্যে বদলায় কান্না কান্না ছবি। মৃদু ঢেউয়ের মতো কলকল করে বয়ে যায় আনন্দের মিহি সুর। সে সুরে শিশু সরল কবি হাতের কলমে, ভাবের চোখে নাচেন যেন তা-ধিন-ধিন-তা. . .
‘‘শরৎ এলো কী উল্লাসে কাঁপছে নদীর জল
পাখনা মেলে বেড়ায় খেলে প্রজাপতির দল!
বাজলো কাঁসর সাজলো আসর চলরে সবাই চল
মন-গালিচায় বন গালিচায় নামলো খুশির ঢল!!’’. . .(ভবানী প্রসাদ মজুমদার, শরৎ এলো কি উল্লাসে)
ষড়ঋতুর রঙ্গমঞ্চ আমাদের এই দেশ। প্রতিটি ঋতুই এদেশের প্রকৃতিকে আপন সৌন্দর্য ও বৈশিষ্ট্যে দান করে অপরূপ এক রূপ। ফলে প্রকৃতি কখনো হয় প্রাণোচ্ছল চঞ্চলা তরুণী, কখনো হয় দীপ্ত চক্ষু শীর্ণ সন্নাসিনী, কখনো বর্ষশীলা ক্রন্দনরতা অভিমানিনী, কখনো নিষ্প্রভ জরাগ্রস্ত বৃদ্ধা আবার কখনো বা শান্তশিষ্ট স্নেহময়ী জননী...
‘‘বর্ষা হলো শেষ এবার শুরু শরতকাল,
কাশফুলেতে সাজবে পথ, শিশির মাখা সকাল।
ভাদ্র হলো শুরু আজ আসলো শরতকাল,
শিউলী ফুল ফুট্ছে রাতে/ দূর আকাশে/ ভাসবে মেঘের পাল।’’ ... (রুমন মজিদ, বর্ষা হলো শেষ)
বর্ষার বিষণœতা পরিহার করে শরৎ এক অপূর্ব শোভা ধারণ করে আবির্ভূত হয়েছে শান্ত স্নিগ্ধ কোমল রূপ নিয়ে, যেখানে নেই কোনো মলিনতা, আছে কেবল নির্মল আনন্দ আর অনাবিল উচ্ছ্বাস। কী অপূর্ব রঙের খেলা, কী অপূর্ব মায়াবী রঙিন ভুবন সাজায় প্রকৃতি শরৎ এর কালে- তা চোখে না দেখলে তার চিত্রপট কল্পনায় আঁকতে অপারগ যেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চিত্রকরও। শরতের নিজস্ব রূপবিন্যাসে সোনালী রোদে ধোয়া কুঠির, খোলা হাওয়ায় কাশবন, নদীর তরঙ্গ- সবই যেন হয়ে ওঠে স্বাতন্ত্র্যময়। জীবনানন্দের রূপসী বাংলা শরতে যেন ভরে উঠে অপরূপ রূপে...
‘‘আজি কি তোমার মধুর মুরতি
হেরিনু শারদ প্রভাতে!
হে মাত বঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ
ঝলিছে অমল শোভাতে।
পারে না বহিতে নদী জলধার,
মাঠে মাঠে ধান ধরে নাকো আর-
ডাকিছে দোয়েল গাহিছে কোয়েল
তোমার কাননসভাতে!
মাঝখানে তুমি দাঁড়ায়ে জননী,
শরতকালের প্রভাতে...’’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎ)
‘‘শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি
ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলি।
শরৎ তোমার শিশির-ধোওয়া কুন্তলে,
বনের-পথে লুটিয়ে-পড়া অঞ্চলে
আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি।
আজ শরতের আলোয় এই যে চেয়ে দেখি
মনে হয় এ যেন আমার প্রথম দেখা।’’... (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি)
‘‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায়
লুকোচুরির খেলা।
নীল আকাশে কে ভাসালে
সাদা মেঘের ভেলা।
আজ ভ্রমর ভোলে মধু খেতে,
উড়ে বেড়ায় আলোয় মেতে,
আজ কিসের তরে নদীর চড়ে
চখাচখির মেলা।’’... (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায়, গীতবিতান)
গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা মেঘ- সারি বেঁধে উড়ে যাচ্ছে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে, এক নগর থেকে আরেক নগরে, কচুরিপানার ভেলার মতো এ যেন বক-পালকের ভেলা- আহ্। কোদালী আকাশ জাল বিছিয়ে আছে নিড়ান দেয়া মাঠের মতো। তার ফাঁকে ফাঁকে সাহসী সূর্যটা কখনো হেসে উঠে কখনো মলিন মুখে ডুবে সাদা মেঘের আড়ালে- এই মেঘ, এই বৃষ্টি, আবার এই রোদ। মায়াবী শরতের চঞ্চলা দুষ্টমি!
সমুদ্র থেকে একরাশ নীলচে তরল তুলে... নীল আকাশের বিশাল ক্যানভাসে
সাদাটে মেঘের পৃষ্ঠায় চিঠি লেখা হয়। আর অচেনা নগরের পোস্টম্যান বাতাসে ভর করে। নীলচে স্বপ্নেরা জড়ো হয় আমাদের আঙিনায়, ব্যস্ত উঠোনে... খোলা জানালায়...
‘‘মালঞ্চে পুষ্পিত লতা অবনতমুখী-
নিদাঘের রৌদ্রতাপে একা সে ডাহুকী
বিজন তরুর শাখে ডাকে ধীরে ধীরে
বনচ্ছায়া অন্তরালে তরল তিমিরে!
-নিস্তব্ধ পল্লীর পথে কুহকের সুর
বাজিয়া উঠিছে আজ ক্ষণে ক্ষণে ক্ষণে!’’... (জীবনানন্দ দাস, ডাহুকী)
‘‘আমার মন ভেসে যায় যাচ্ছে ভেসে
কাশের ভেলায় হেসে
ও মন আমার’ যে উড়ছে বকের মত
হেলে দুলে হেলে।
বাহিরে আজ আয়রে সখা বাহিরে আজ আয়
দেখরে চেয়ে নয়ন মেলে কী খেলা আজ হায়’’... (সাখাওয়াৎ হোসেন পলাশ, গীতিকাবিতা)
‘‘এখানে আকাশ নীল- নীলাভ আকাশ জুড়ে সজিনার ফুল
ফুটে থাকে হিম শাদা- রং তার আশ্বিনের আলোর মতন;
আকন্দফুলের কালো ভীমরুল এইখানে করে গুঞ্জরণ
রৌদ্রের দুপুর ভ’রে;- বারবার রোদ তার সুচিক্বণ চুল
কাঁঠাল জামের বুকে নিংড়ায়ে দহে বিলে চঞ্চল আঙুল’’... (জীবনানন্দ দাস, এখানে আকাশ নীল)
চর জুড়ে কাশবন। নদীতে ছলছল তরঙ্গ। ছপাতছপাত বৈঠা মেরে মাঝি গান গেয়ে যায় দূর গন্তব্যে। কৃষাণি ঘাটের কাছে দাঁড়ায় বৈদেশী নাগরের আশায়। জলে ঢেউ, মনে বাতাস। অবসর আসে অফুরাণ কাজের পরে। হোগলা পাতার কোলে হেলান দিয়ে বধূ ফুল তোলে রুমালে, পাখায়, বিছানার কুশনে। আর রাতের উজ্জ্বল আকাশ তলে কল্পআবেশে চলে তার কতনা কথন...
‘‘ভেবেছিলাম প্রথম যেদিন
ফুটবে তুমি দেখবো,
তোমার পুষ্প বনের গাঁথা
মনের মতো লেখব।
কথন কালো কাজল মেঘ তো
ব্যস্ত ছিল ছুটতে, ভেবেছিলাম আরো কদিন
যাবে তোমার ফুটতে।
সবে তো এই বর্ষা গেল
শরৎ এলো মাত্র,
এরই মধ্যে শুভ্র কাশে
ভরলো তোমার গাত্র।
ক্ষেতের আলে মুখ নামিয়ে
পুকুরের ঐ পাড়টায়,
হঠাৎ দেখি কাশ ফুটেশে
বাঁশবনের ঐ ধারটায়।
আকাশ থেকে মুখ নামিয়ে
মাটির দিকে নুয়ে
দেশি ভোরের বাতাসে কাশ
দুলছে মাটি ছুঁয়ে।
পুচ্ছ তোলা পাখির মতো
কাশবনে এক কন্যে,
তুলছে কাশের ময়ূর চূড়া
কালো খোঁপার জন্যে।
প্রথম কবে ফুটেছে ফুল
সেই শুধু তা জানে,
তাই তো সে তা সবার আগে
খোঁপায় বেঁধে আনে।
ইচ্ছে করে ডেকে বলি:
‘‘ওগো কাশের মেয়ে,
আজকে আমার চোখ জুড়ালো
তোমার দেখা পেয়ে।
তোমার হাতে বন্দী আমার
ভালোবাসার কাশ,
তাই তো আমি এই শরতে
তোমার ক্রীতদাম।’’... (নির্মলেন্দু গুণ, কাশফুলের কাব্য)
‘‘কি রূপে ওমা সাজালো তোমাকে
তোমার রূপের মোহে পরি, আমি মরি
শরতের ছোঁয়ায় রূপসী তুমি মাগো
সবুজের রাণী, অপূর্ব সুন্দরী।
রিমি ঝিমি বৃষ্টির ছন্দে বর্ষা শেষে
বিলে ঝিলে পদ্ম, শাপলা ফুলে,
রোদেলা দুপুরে ঢেউয়ের মুক্তার ঝিলিক
জড়ায়েছ অঙ্গে তোমার সবুজ আঁচলে।’’...(খান শরীফুল ইসলাম, শরৎ এর রাণী)
শরতের অনুপম রূপবৈভবের মাঝে বেজে ওঠে বাঙালির প্রাণের বাঁশি। আকাশে বাতাসে অনুরণিত হয় উদার মুক্তির আহ্বান। ঘরের বন্ধন ছিন্ন করে অফুরন্ত সৌন্দর্য জোয়ারে ভেসে যেতে চায় মন। বর্ষায় গৃহবন্দি জীবনের অবসান ঘাঁটিয়ে এই শরৎ। ক্লান্তি ভুলতে প্রকৃতি বেড়িয়ে পরে আরেকবার বাকল বদলিয়ে। রূপে-রসে-বৈচিত্র্যে ভরপুর হয়ে ওঠে শরৎকাল। শরৎ যেন জননী জন্মভূমির রূপসী মানসকন্যা। বাংলার প্রাণের প্রতিমাপ্রতিম।
‘‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায়
লুকোচুরির খেলা।
নীল আকাশে কে ভাসালে
সাদা মেঘের ভেলা।
আজ ভ্রমর ভোলে মধু খেতে,
উড়ে বেড়ায় আলোয় মেতে,
আজ কিসের তরে নদীর চড়ে
চখাচখির মেলা।... (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আজ ধারেন ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায়। গীতবিতান।)
শীর্ষ সংবাদ: