ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

জিয়া হায়দার

এ লে বে লে

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৬

এ লে বে লে

(পূর্ব প্রকাশের পর) কাঞ্চু : এমন একজন মারকাটারি খদ্দের এসে বসলো অর্ডার-ফর্ডার... নির্দেশক : যখন সময় হবে তখন ঠিকই দেবে। তোকে মাতবরী করতে হবে না। ওয়েটার, পানি নিয়ে যাও? (ওয়েটার পানি নিয়ে চলে যায়।) মেয়ে : (দাঁড়িয়ে) এটা কি নাটকের মধ্যে? নির্দেশক : না না, তা কেন? মেয়ে : তাহলে... নির্দেশক : ওটা কিছু নয়, এ্যাকশন। (সঙ্গে সঙ্গে মিউজিশিয়ান গীটার বাাজনো শুরু করে) তোমাকে আবার মিউজিক দিতে বললো কে? মিউজিশিয়ান : (থামিয়ে, উঠে দাঁড়ায়) আমি তাহলে ভুল বুঝেছিলাম। কিন্তু স্যার... (মেয়ে ততোক্ষণে বসে পড়ে।) নির্দেশক : কি? মিউজিশিয়ান : ভয়ে বলবো, না নির্ভয়ে বলবো স্যার। নির্দেশক : নির্ভয়ে। মিউজিশিয়ান : কোনো কোনো জায়গায় যদি স্যার দিয়ে ফেলি, তাহলে... নির্দেশক : ঠিক আছে, তখন দেখা যাবে। ছেলে : তার মাথায় ক্যাপ, পরনে ভদ্র পোশাক বড়সর গোঁফ ও জুলফি। বিস্মিতভাবে বলতে বলতে প্রবেশ করে। আলী সাহেবÑ মেয়ে : হাই। (খুশিতে উঠে দাঁড়ায়। ছেলে তাকে হাত তুলে ইশারা করে।) নির্দেশক : (চমকে দাঁড়িয়ে যায়, মেয়েকে) থামো থামো। (ছেলেকে) কি ব্যাপার। ছেলে : এই যে আপনার আর মিউজিশিয়ানের কথাবার্তা, এগুলো কি নাটকে আছে? নির্দেশক : হ্যাঁ। ছেলে : কই আগে তো বলেননি। নির্দেশক : ইমপ্রোভাইজেশন বুঝলে। ছেলে : (না বুঝেই) ও। আমি তাহলে এখন কি করবো। নির্দেশক : আবার কি। তোমার প্রবেশের কিউয়ের জন্যে অপেক্ষা করবে। ছেলে : ওকে। (প্রস্থানের সময় মেয়েকে হাত তুলে ‘ওয়েভ’ করে।) নির্দেশক : (মেয়েকে) রেডি। (মেয়ে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে। উভয়েই বসে পড়ে।)... মেয়েটি বই পড়ার ভান করতে থাকে।... বাইরের দিকে তাকায়। উঠে দাঁড়ায়। ঠিক করতে পারছে না, চলে যাবে কিনা। সামনের দিকে এগিয়ে আসে। দর্শকদের দিকে তাকিয়ে থাকে।... ডায়ালগ। মেয়ে : (এই সংলাপ চলাকালে নির্দেশক এক সময় সিগারেট ধরায়) আমি ওকে ভালোবাসি। না না, ভালোবাসা কথাটা বোধ হয় ঠিক হলো না। ওকে আমার ভালো লাগে। তবে কিনা কিছুদিন থেকে ওই ভালোলাগাটা খুব বেশি বেশি মনে হচ্ছে। বড়ো তীব্রভাবে অনুভব করছি। এই তীব্রতাটুকুর নামই বোধকরি ভালোবাসা। তাই যদি হয়, তা হলে ওকে আমি ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি। মাঝে মাঝে অবশ্য এমনও হয় একই সঙ্গে আরো দু’তিনজনের জন্যেও এই তীব্রতা আমার মনকে বিভ্রান্ত করে দেয়। এ ধরনের ভাব মনে জাগলেই আমি খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি। আমার কি মনে হয় জানেনÑ এই ধরনের ভাব আর আবেগপ্রবণ হওয়াটা আধুনিক, স্মার্ট হওয়ার লক্ষণ। ইদানীং এমনটি আমার প্রায়ই হচ্ছে। আর সে জন্যেই, মানে আমার ভেতরের স্মার্টনেস এতো দ্রুত বিকাশ লাভ করছে বলেই ও আমাকে ভালোবাসে; মানে আমাকে ওর ভালো লাগে। এই ভালো লাগালাগিটুকু আছে বলেই ও আমাকে বলে মেয়ে বন্ধু, আর আমি ওকে বলি ছেলে বন্ধু। (মেয়ের সংলাপ চলাকালে ওয়েটার অন্য কোনো টেবিল থেকে অথবা অন্য কোনো কাজ করে ফিরে যাবার সময় কাঞ্চু তাকে ইশারা করে কাছে ডাকে এবং তার কানে কানে কিছু বলে। নির্দেশক লক্ষ্য করে ও বিরক্তি প্রকাশ করে।) নির্দেশক : মেয়েটি আবারো বাইরের দিকে তাকায়। আবারো ঘড়ি দেখে। মেয়ে : সেই কখন চারটা বেজে গেছে। ও এখনো আসছে না। কি করবো এখন?... তাহলে ততোক্ষণে নিজের কথা নিজের মনকেই শোনাতে থাকি। মেয়ে এই সংলাপটি শুরু করতেই ওয়েটার প্ল্যাটফর্মের টেবিল থেকে মেনু তুলে নেয়। মেয়ে ‘ততোক্ষণে নিজের কথা নিজেকেই শোনাতে থাকি’ বলার সময় তার দু’হাত দু’দিকে শূন্যে অন্যমনস্কভাবে ছাড়িয়ে দেয়। ঠিক সেই মুহূর্তে ওয়েটার মেয়েটির হাত গুঁজে দেয়। মেয়ে হকচকিয়ে যায়। সে সংলাপ থামিয়ে দিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে নির্দেশকের দিকে তাকায়। নির্দেশক : (রেগে) ওয়েটার। ওয়েটার : (কাঞ্চুকে দেখিয়ে) উনিই তো স্যার... কাঞ্চু : এই যে তুই বললি, ইমপো ভাই নাকি কি যেন ভাই, সেটাই একটু... নির্দেশক : ইডিয়ট। (মেয়েকে) চালিয়ে যাও। (ওয়েটার চলে যায়।) মেয়ে : (মেনু দেখিয়ে) এটা কি করবো। নির্দেশক : তাই তো... ঠিক আছে হাতেই রাখো। মেয়ে : ও আমাকে বেড়াতে নিয়ে যাবে। আমাদের ভাষায় ডেট-এ নিয়ে যাবে ওর গাড়িতে। ধরুন কোন লেকের ধারে। তারপর ফিরে এসে যাবো এক পার্টিতে। সেখানে গান হবে, নাচ হবে, হৈ হবে, চৈ হবে, তারপর উল্টোপাল্টা হুল্লোড় হবে, আমোদ হবে, ফুর্তি হবে। সবকিছু হবে আলো আঁধারে। সেই আমাদের গাঙ্গে স্নান করে, ফুর্তির স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে রাত্রি যখন নিজেই বিভোর হয়ে যাবে, তখন এক মধুর ক্লান্তি নিয়ে ঘরে ফিরে যাবো। ফিরে যেতে ইচ্ছে না হলেও ফিরতে হবে। কারণ বাবা-মা বলে দিয়েছেন, ফিরতেই হবে। ওরা যে কী!... কিন্তু ফিরবো যে, যাওয়াই তো হলো না এখনো। ও না এলে তো... নির্দেশক : মেয়েটি অস্থিরতা প্রকাশ করে। মেনুটাকে পাকা করে বাতাস খায়।... চমৎকার হচ্ছে কিন্তু, চমৎকার। মেয়ে : (পাখা করা থামিয়ে) প্রতীক্ষা জিনিসটা সত্যি খুব খারাপ। আমার আরেকজন ছেলে বন্ধু টেলিফোন করেছিলো সকালে। সে বলেছিলো আমাকে নিয়ে একটা লংড্রাইভে যেতে চায়, আগেরবারের মতো। এবারে সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ, যেখানে ওই ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়াতে। কিন্তু আমি তাকে না করে দিয়েছি। আমার ডেট কার সঙ্গে, তা অবশ্য বলিনি। আমাকে ভজানোর জন্যে যা সুন্দর সুন্দর কথা বলছিলো। আমি নাকি ভেরি গুড ফান। ফান কথাটাই ফানি। মানুষ বুঝি তামাশা হতে পারে। তায় আবার মেয়েরা। আসলে কোনো মেয়েকে খোঁচা দিতে ইচ্ছে করলেই ছেলেরা তাকে বলে ফান। কথাটা কিন্তু আমার মনে হয় গালি। অথচ অনেক মেয়ে কথাটাকে খুব পছন্দ করে। কেউ কেউ ওটা হতে পারলে ভীষণ গর্ব অনুভব করে। কিন্তু... নির্দেশক : সে কোমর থেকে ছোট্ট রুমাল টেনে নেয়। মুখটা মোছে। মেয়ে : কিন্তু ওকেও এখন পাওয়া যাবে না। নিশ্চয়ই কারো সঙ্গে বেরিয়ে গেছে। ছেলেগুলো এমনই ফালতু, যেই একজন না বললো অমনি আরেকজনকে হ্যাঁ বলানোর জন্যে তার পিছে লেগে গেলো। আচ্ছা, এমনো তো হতে পারে আমার ডেট অন্য কারো সাথে চলে গেছে। না না, তা হতে পারে না। ও এমনটি করতেই পারে না। আমি যে ওকে ভালোবাসি, মানে আমার ভালো লাগে। আমাকেও যে ওপর ভালো লাগে, খুব ভালো লাগে। (মেয়েটি কেঁদে ফেলে।) নির্দেশক : মেয়েটি আবেগরুদ্ধ বলে কিঞ্চিৎ... কিঞ্চিৎ... (উপযুক্ত শব্দ খুঁজে পায় না, হঠাৎ করে পেয়ে গেছে) ফ্যাৎ ফ্যাৎ করে উঠে। রুমাল দিয়ে চোখ মুছে। মেয়ে : তাহলে, তাহলে... এখন আমি কি করবো। নির্দেশক : মেয়েটি বিমূঢ় হয়ে যায়। পরক্ষণই ছুটে যায় দরজার দিকে। থমকে দাঁড়ায়। ফিরে আসে টেবিলে। রুমালটা কোমরে গুঁজে রাখে। হাতের মেনুসহ বইটা ব্যাগের ভেতর ভরে ফেলে। কাঁধে ঝুলিয়ে নেয়। আবার দরজার দিকে এগিয়ে যায়। পাঁচ পা... (নির্দেশক হাত নেড়ে গুনতে থাকে; কিন্তু মেয়েটি তিন পা যেয়েই থেমে যায়।)... তিন পা যেয়েই থেমে যায়। মেয়ে : কয় পা যেন বললেন। নির্দেশক : (অসন্তুষ্ট কণ্ঠে) পাঁচ। (মেয়েটি এগিয়ে যেতেই) সে আরো দু’পা যেয়েই থেমে যায়। ঘুরে দাঁড়ায়। মেয়ে : ওয়েটার। নির্দেশক : ওয়েটার দ্রুত প্রবেশ করে মেয়েটির কাছে চলে আসে। ওয়েটার : জী। মেয়ে : এখানে একটি ছেলে আসার কথা আছে। সে এলে তাকে বলবে... ওয়েটার : আমি কি তাকে চিনি? মেয়ে : ও, তাইতো। সে দেখতে ফর্সাও নয়, কালোও নয়, মুখটা গোলও নয়, লম্বাটেও নয়, খুব বেটেও না, ঢ্যাঙাও না, ঝাঁকড়া চুল, ঝুলে পড়া গোঁফ (চিবুক পর্যন্ত দেখিয়ে) এই পর্যন্ত জুলফি, পরনে একবারে হাল ফ্যাশনের পোশাক... চিনতে পারবে তো। ওয়েটার : যেমন যেমন বললেন, তেমন তেমন হলে ঠিক চিনতে পারবো। মেয়ে : তাকে বলবে যে আমি এসে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছি। সেও যেন অপেক্ষা করে। আমির আবার আসবো। বলতে পারবে? ওয়েটার : হ্যাঁÑ আপনার নাম বলতে হবে না। মেয়ে : নাম?... নাহ্, একটি মেয়ে বললেই চলবে। আর বলো যে, মেয়েটি ভীষণ দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে চলে গেছে। বলতে পারবে তো। ওয়েটার : দুখু-দুখু ভাব নিয়ে তোÑ ঠিক বলে দেবো। নির্দেশক : মেয়েটি চলে যায়।... মিউজিক, প্যালেস। (মিউজিশিয়ান করুণ সুর বাজাতে থাকে। ওয়েটার হঠাৎ টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখে মেনুটি নেই।) ওয়েটার : এই যে শুনুন। (মেয়েটি থমকে দাঁড়ায়। মিউজিক থেমে যায়।) আমাদের মেনুটা... মেয়ে : ও, ভুলেই গিয়েছিলাম। এটার কথা আগে বলা হয়নি তো। নির্দেশক : (মেয়ে ও ওয়েটারের এ্যাকশন দেখে দেখে) মেয়েটি এগিয়ে আসে। ওয়েটারও এগিয়ে যায়। মেয়েটি ব্যাগ থেকে মেনু বের করে ওয়েটারকে দেয়। মেয়েটি বেরিয়ে যায়। ওয়েটারও ফিরে যায়। (মিউজিশিয়ান সাসপেন্স মিউজিক বাজাতে থাকে।) সাসপেন্স মিউজিক। তোমাকে ওটা বাজাতে বললো কে? মিউজিশিয়ান : (থামিয়ে) আপনার নির্দেশের বাইরে তো স্যার এটা ওটা হয়ে যাচ্ছে তাই... নির্দেশক : থামো প্যালেস। (মিউজিশিয়ান করুণ সুর বাজাতে শুরু করে।) সামান্য নীরবতা। মিউজিক চলতেই থাকে। কাঞ্চু : (কান চুলকাতে চুলকাতে) আবু, তোকে কিচ্ছু হবে না। নির্দেশক : তুই বললেই হবে? কাঞ্চু : হ্যাঁ, কোনো প্ল্যান নেই, কোনো রিহার্সাল ট্রেনিং কিছু নেই... নির্দেশক : তবু হবে। আমি যাতে হাত দিয়েছি সেটা হতেই হবে। কাঞ্চু : কচু হবে। সব ভ-ুল হবে। ওই ইমপো দিয়ে দিয়ে দিয়ে ঠেকাবি? তার চেয়ে ক্ষ্যামা দিয়ে... নির্দেশক : (নিজের আসন থেকে উঠে কাঞ্চুর দিকে কিছুটা এগিয়ে এসে) তোকে আর উপদেশ দিতে হবে না। তোর কাজ তুই কর। বিরক্ত করিসনে। এক্ষুণি ছেলে এসে পড়বে। (ফিরে এসে জাঁকিয়ে বসে। অতপর দর্শকদের দিকে মুখ রেখে) মিউজিক ডিরেক্টর ঘাড় দুলিয়ে দুলিয়ে তন্ময় হয়ে বাজিয়ে চলেছে। (মিউজিশিয়ান আদৌ ঘাড় দোলাচ্ছে না। একটু পর নির্দেশক তার দিকে তাকায়।) তুমি তন্ময় ভাবের এক্সপ্রেশন দিচ্ছো না কেন? (মিউজিশিয়ান ঘাড় দোলাতে শুরু করে) হ্যাঁ, এইতো। (সামান্য পরে) ছেলেটি প্রবেশ করে। (এবারে ছেলেটির পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি, পায়ে স্যান্ডেল-সু, মাথায় ক্যাপ নেই। চুল বেশ ছোট করে ছাঁটা। গোফও নেই।) দাঁড়ায়। দেখে কেউ আছে কিনা। ঘড়ি দেখে। যেয়ে বসে একটি চেয়ারে। বাইরের দিকে তাকায়। ওয়েটার ছেলেটির কাছে আসে। ঘুরে ঘুরে তাকে ভালো করে দেখে। নেতিবাচকভাবে ঘাড় ঝাঁকিয়ে ফিরে যায়। ছেলেটি ওয়েটারের আচরণ দেখে অবাক হয়ে যায়। আবারো ঘড়ি দেখে; মিউজিক স্টপ। ছেলে : মেয়েরা কোনদিনই পাংকচ্যুয়াল হতে পারে না। নিশ্চয়ই এখনো ওর সাজগোজ শেষ হয়নি। (চলবে)
×